Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Tennis

‘আঙ্কল’ না থাকলে ‘ভাইপো’-কে পেতই না ভারতীয় টেনিস

লিয়েন্ডারের টেনিস জীবনটাই প্রায় তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বিদেশ পাঠানো, বিদেশে গিয়ে কোথায় যেতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, ভারতীয় দলে সুযোগ করে দেওয়া, সবটাই প্রায় নিজের হাতে গুছিয়ে দিয়েছিলেন নরেশ আঙ্কল।

ভারতীয় টেনিসের যুগাবসান। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন নরেশ কুমার।

ভারতীয় টেনিসের যুগাবসান। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন নরেশ কুমার। —ফাইল চিত্র

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৪:৫৭
Share: Save:

রাজনীতি, খেলা, বিনোদন, সাহিত্য— যে কোনও জগতেই যত বিখ্যাত হোন না কেন, সাংবাদিকদের কাছে সেই খ্যাতনামী সাধারণত দাদা বা দিদি-তেই সম্বোধিত হন। ব্যতিক্রম ছিলেন নরেশ কুমার। কেউ তাঁকে ‘নরেশদা’ বলে কখনও ডেকেছেন, শোনা যায়নি। তিনি ছিলেন সবার ‘নরেশ স্যর’ বা ‘কুমার সাহাব’।

কুমার সাহাব— ছোটখাটো চেহারা, ধবধবে ফর্সা, মোটা সাদা গোঁফ, ব্যাকব্রাশ করা রুপোলি চুল। কুমার সাহাব— ঝলকহীন পোশাকের পারিপাট্যে এমনই এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর উপস্থিতিটাই শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম আদায় করে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কুমার সাহাব— ক্যালকাটা সাউথ ক্লাব থেকে নাক উঁচু সাহেবদের অল ইংল্যান্ড ক্লাবে অবাধ যাতায়াত, সমান স্বচ্ছন্দ। তাঁকে ‘স্যর’, ‘সাহাব’-এর নীচে নামানোর ন্যূনতম ইচ্ছেটুকুও কখনও কারও হয়নি।

পঞ্চাশের দশকে ভারতীয় টেনিসকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়া কুমার সাহাব বরাবরই ভারতের টেনিস জগতে একটু ব্যতিক্রমী। দিলীপ বসু, সুমন্ত মিশ্রদের সঙ্গে টেনিস কোর্ট দাপানো কুমার সাহাব নিজেকে সচেতন ভাবেই একটু উপরের সারিতে রেখেছিলেন। টেনিস সার্কিটে নেশা করেন না, এ রকম হাতে গোনা যে কয়েক জন আছেন, তিনি তাঁর অন্যতম। ঘড়ি ধরে অনুষ্ঠানে আসতেন। ঘড়ি ধরেই চলে যেতেন। গল্পগুজব, পরনিন্দা-পরচর্চা তাঁর অভ্যাসে ছিল না। ভারতীয় টেনিস সার্কিটে তিনি পরিচিত ‘ম্যান উইথ কালচার’। কুমার সাহাব হিসেবেই তাঁর জায়গা চিরন্তন।

স্ত্রী সুনীতা কুমারের সঙ্গে নরেশ কুমার।

স্ত্রী সুনীতা কুমারের সঙ্গে নরেশ কুমার। আনন্দবাজারের আর্কাইভ থেকে।

ব্যতিক্রম অবশ্য আছে। এক জনের কাছে তিনি ‘নরেশ আঙ্কল’। লিয়েন্ডার পেজ। লিয়েন্ডারের টেনিস জীবনটাই প্রায় তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁকে বিদেশ পাঠানো, বিদেশে গিয়ে কোথায় যেতে হবে, কার কাছে যেতে হবে, ভারতীয় দলে সুযোগ করে দেওয়া, সবটাই প্রায় নিজের হাতে গুছিয়ে দিয়েছিলেন নরেশ আঙ্কল। পরে বেঙ্গল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) ফসল নীতিন সিংহ, বিশাল সিংহকেও বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে তাঁর বড় ভূমিকা ছিল।

আসলে বিটিএ ছেড়ে টাটায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই অন্য জীবন শুরু হয় তাঁর। যোগাযোগ হয় রুশি মোদীর সঙ্গে। সখ্য আরও বাড়তে থাকে। নরেশের বন্ধুতালিকায় যোগ হয় মকবুল ফিদা হুসেন থেকে শুরু করে মাইক ব্রিয়ারলির নাম। সামাজিক ক্ষেত্রেও সক্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিনি এবং স্ত্রী সুনীতা কুমার বহু খ্যাতনামীর নানা অনুষ্ঠানে আলো করে থাকতেন। তবে লাল সুরকির অন্যতম সেরার মূল আকর্ষণ ছিল সবুজ ঘাসের কোর্ট। সেই সময়ে শুধু এই টানেই প্রতি বছর নিয়ম করে উইম্বলডন দেখতে যেতেন। সাউথ ক্লাব এবং অল ইংল্যান্ড ক্লাব, দু’টির সঙ্গেই প্রেম-ভালবাসা তখন থেকে। এর সুবাদেই লিয়েন্ডারকে বিদেশে পাঠানোর কাজটা সহজ হয়েছিল তাঁর পক্ষে।

খেলোয়াড় নরেশের একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল। গ্র্যান্ড স্লামে সাফল্য বলতে সিঙ্গলসে চতুর্থ রাউন্ড এবং ডাবলস, মিক্সড ডাবলসে কোয়ার্টার ফাইনাল হলেও নরেশের খেলার মূল উপজীব্য ছিল টেনিসের রোম্যান্স। যখন উইম্বলডনের প্রেক্ষাপটে নানা উপখ্যান শোনাতেন, তার মধ্যেও মিশে থাকত সেই রোম্যান্স।

কিন্তু নরেশ কুমার মানেই শান্ত, নম্র স্বভাবের এক জন মানুষ, তা নয়। কলকাতার বাড়ির আনাচে-কানাচের শৌখিনতা, আভিজাত্য যতই কোর্টের সিল্কের মতো মসৃণ শটগুলোর সঙ্গে মানানসই হোক, দরকারে তিনি ছিলেন ইস্পাত-কঠিন। সেই কারণেই বার বার তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হয়েছে। সেটা কখনও অল ইন্ডিয়া টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের সঙ্গে, কখনও সহ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে, আবার কখনও তাঁর অধিনায়কত্বে খেলা দলের সঙ্গে।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ও সোমদেব দেববর্মনের সঙ্গে নরেশ কুমার।

জয়দীপ মুখোপাধ্যায় ও সোমদেব দেববর্মনের সঙ্গে নরেশ কুমার। আনন্দবাজারের আর্কাইভ থেকে।

কিন্তু হাজারো মতবিরোধ সত্ত্বেও অধিকাংশ সময়ই যেটা চেয়েছেন, সেটা আদায় করে নিয়েছেন। যেমন ১৯৯০ সাল। তাঁর প্রবল জোরাজুরিতেই জাপানের বিরুদ্ধে ডেভিস কাপে ১৬ বছরের লিয়েন্ডারের অভিষেক হয়। ‘আঙ্কল’ না থাকলে ভারতীয় টেনিসে হয়ত ‘ভাইপো’-কেও পাওয়া যেত না।

তাই ২০২০ সালে যখন প্রথম ও এখনও পর্যন্ত শেষ টেনিস কোচ হিসেবে দ্রোণাচার্য পুরস্কার পান, তখন ভারতীয় টেনিস সমাজ তাঁকে কুর্নিশ করতে দ্বিধা করেনি। সকলেই মেনে নিয়েছিলেন, কুমার সাহাবের হাত ধরেই ভারতীয় টেনিস আরও এক বার স্বীকৃতি পেয়েছিল।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy