Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪
ফাইনালে নেই ব্রাজিল, চলে এল স্পেন

সাম্বা নেই তো কী, ক্রুয়েফের শিল্প আছে

কাদের গলায় উঠবে বিশ্বজয়ীর পদক? শনিবার রাতে যুবভারতীর আকাশ থেকে কোন রংয়ের আতসবাজি মালা হয়ে নামবে? স্পেনের লাল আলো ফুটবে নাকি উড়বে ইংল্যান্ডের সাদা-নীল রং?

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৭ ০৩:৫৫
Share: Save:

চব্বিশ থেকে দুই। ওরা দু’টো দল।

বাইশ দিন ধরে চলা টুর্নামেন্টের বাহান্নতম ম্যাচে ঠিক হয়ে যাবে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন কারা। যারাই জিতুক না কেন, ফুটবল পাচ্ছে নতুন খুদে চ্যাম্পিয়ন। স্পেন এর আগে তিন বার ফাইনালে উঠে একবারও জিততে পারেনি। আর ইংল্যান্ড কখনও ফাইনালেই ওঠেনি।

কাদের গলায় উঠবে বিশ্বজয়ীর পদক? শনিবার রাতে যুবভারতীর আকাশ থেকে কোন রংয়ের আতসবাজি মালা হয়ে নামবে? স্পেনের লাল আলো ফুটবে নাকি উড়বে ইংল্যান্ডের সাদা-নীল রং?

যত দিন যাচ্ছে, হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্রাজিলীয় তারকার তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বুধবার রাতের পাওলিনহো বা লিঙ্কন তাতে নতুন সংযোজন। আবেগের বশে চলে যাওয়া যুবভারতী সম্ভবত মনে রাখেনি, বড়দের বিশ্বকাপে শেষবার ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০২ সালে। অনূর্ধ্ব-১৭ বিভাগে শেষবার তারা ট্রফি জিতেছে ২০০৩ সালে। মানে প্রায় পনেরো বছর হতে চলল কোনও ধরনের বিশ্বকাপই সাও পাওলোর উড়ান ধরেনি।

আরও পড়ুন: ফাইনালে ট্রফি নিয়ে মাঝমাঠে সুনীল

বঙ্গীয় আবেগ যা-ই বলুক, বিরাট কোনও অঘটন ঘটে গিয়েছে ব্রাজিলের বিদায়ে, বলা যাবে কি? বরং ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, যে দু’টো দেশে যুব ফুটবলের পরিকাঠামো এবং প্রক্রিয়া সব চেয়ে উন্নত, তারাই যুবভারতীতে শনিবারের ফাইনালে মুখোমুখি হচ্ছে। চিমা ওকোরি যেমন। পরিবারের সঙ্গে এখন ইংল্যান্ডে রয়েছেন। জানালেন, ব্রিউস্টারের হ্যাটট্রিক এবং ফাইনালে ওঠা নিয়ে ইংল্যান্ডে খুব নিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস রয়েছে। চিমা ফোনে বললেন, ‘‘আমি একেবারেই অবাক হচ্ছি না ফাইনালের লাইন-আপটা দেখে। দু’টো দেশেই অ্যাকাডেমি থেকে প্রচুর ফুটবলার উঠে আসছে। ব্রাজিল সেখানে এখনও যেন আবেগ আর প্রতিভা নির্ভর। ট্রেনিং, প্রস্তুতি, পদ্ধতি— এ সবে ওরা এখনও সে ভাবে জোর দেয় কোথায়!’’ ব্রিটিশ ফুটবল সম্পর্কে পরিচিত চিমার মুখে শোনা গেল সাউদাম্পটনের নাম। যারা শুধুই অ্যাকাডেমির ফুটবলার খেলিয়ে ইপিএলে লড়াই করে যাচ্ছে।

একটা সময়ে ব্রাজিলেই তৈরি হয়েছিল স্বপ্নের অ্যাকাডেমি— স্যান্টোস এফ সি। টাইটানিকের যাত্রা শুরুর দিনে প্রতিষ্ঠা যার। টাইটানিক সেই রাতেই ডুবলেও স্যান্টোস থেকে যায় এবং বিশ্ব ফুটবলকে উপহার দিল পেলে নামক রত্ন। পরবর্তীকালে রোবিনহো, নেমারের মতো প্রতিভাও উঠে এসেছে এই অ্যাকাডেমি থেকে। এখন তার সেই রমরমা আর নেই।

চিমার সঙ্গে ফুটবল মাঠে যাঁর দ্বৈরথ সব চেয়ে জমত, সেই সুব্রত ভট্টাচার্যও ‘চিতা’কে ট্যাক্‌ল করার চেষ্টা করলেন না। সহমত হয়ে সুব্রত বলছেন, ‘‘ব্রাজিল একাই দক্ষ নয়। ইংল্যান্ডও যথেষ্ট দক্ষ। ওদের টিমওয়ার্ক দারুণ। এমনি এমনি তো একটা দল বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলে না!’’ স্পেন আর ইংল্যান্ডে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ফুটবল লিগই শুধু হয় না, তাদের প্রত্যেকটা ক্লাবে রয়েছে পরিকল্পনামাফিক যুব ফুটবলের পরিকাঠামো। স্পেনের লা মাসিয়া অ্যাকাডেমি জগদ্বিখ্যাত। সেখান থেকে মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তা, পুয়োল, পিকে-রা বেরিয়েছেন। ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকায় বিশ্বকাপ জেতে স্পেন। ভিসেন্তে দেল বস্কির সেই দলের ন’জন সদস্যই ছিলেন লা মাসিয়ার ছাত্র। তেমনই ইংল্যান্ডের দুই ম্যাঞ্চেস্টার, লিভারপুল, আর্সেনালে লালিত হচ্ছে ব্রিউস্টারের মতো অনেক বিস্ময় বালক। ইংল্যান্ডের অ্যাকাডেমিতে ফুটবলার গড়ে তোলাটা তো একটা বড় ব্যবসাও। প্রত্যেকটি ক্লাব অ্যাকাডেমিতে ফুটবলার তৈরি করে তাদের উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে মোটা টাকা উপার্জন করে।

এ বারের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপেও স্পেনের সব চেয়ে প্রতিশ্রুতিমান এবং টুর্নামেন্টে এখনও পর্যন্ত সব চেয়ে সফল আবেল রুইজ লা মাসিয়া অ্যাকাডেমির ফসল। ডিফেন্সে প্রধান স্তম্ভ ম্যাতিউ খাউমে-ও তাই। স্পেনের তিকি তাকা ফুটবল মানে য়োহান ক্রুয়েফের মায়াবী ফুটবল। বার্সেলোনার সুন্দর ফুটবল। পেপ গুয়ার্দিওলার ফুটবল।

ডাচদের সেই বিখ্যাত টোটাল ফুটবলের সেরা মুখ ক্রুয়েফ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু অমর হয়ে থাকবে তাঁর ফুটবল শিক্ষা। আয়াখ্‌স আমস্টারডামের ফুটবল স্কুল থেকে যে শিক্ষা তিনি তুলে নিয়ে এসেছিলেন বার্সেলোনার লা মাসিয়া অ্যাকাডেমিতে।

কী ছিল ক্রুয়েফের মন্ত্র? না, ফুটবলকে ভালবাসতে হলে বলটাকে ভালবাসতে হবে। আর বলকে ভালবাসা মানে ‘জাগলারি’ নয়, ওয়ান টাচে অন্যকে পাস বাড়িয়ে দেওয়া। ক্রুয়েফ মনে করতেন, বল ধরে রেখে জাদু দেখানোটা সার্কাস, ফুটবল নয়। অনেকে মনে করেন, তাঁর এই মন্তব্য ব্রাজিল ফুটবলকে কটাক্ষ করেই বলা। ‘‘ফুটবল খুব সহজ একটা খেলা। সহজ কাজ করাটাই কঠিন,’’ এই হচ্ছে ক্রুয়েফের ফুটবল মতবাদ। স্পেনের আবেল রুইজ, ম্যাতিউদের মাধ্যমে শনিবার কলকাতার সামনে ক্রুয়েফের সেই অমর পাসিং ফুটবল দেখার সুযোগ।

ব্রাজিলের ফুটবল নিয়ে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত পর্তুগিজ স্লোগান ‘জোগো বোনিতো’ বা ‘দ্য বিউটিফুল গেম’। যা সারা বিশ্বে বিখ্যাত হয়েছিল পেলে-গ্যারিঞ্চাদের জাদুতে। যুগ পাল্টেছে, বদল এসেছে ফুটবলে। সাম্বার চেয়ে কম সৌন্দর্যময় নয় স্পেনের তিকি তাকা। পাসিং ফুটবলের রামধনুতে আবেল রুইজ-রা কিন্তু কলকাতার আকাশকে রাঙিয়ে দিয়ে যেতে পারে।

টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা দল ব্রাজিল নয়, ইংল্যান্ড। তারা সেমিফাইনাল পর্যন্ত করেছে ৬ ম্যাচে ১৮ গোল। ব্রাজিল করেছে ১২ গোল। স্পেন করেছে ১৪ গোল। ফুটবল সৌন্দর্যে তাজমহল গড়তে হলে সেরা পাথর তো গোলই! আত্মজীবনীতে ওয়েন রুনির সেই বিখ্যাত লাইন— ‘ফুটবল যদি জলের নীচে হাসফাঁস করা হয়, তা হলে গোল হল ভেসে উঠে অক্সিজেন নেওয়া’।

পর-পর দু’টো হ্যাটট্রিক করে টগবগ করে ফুটছে রুনির দেশের নতুন নায়ক ব্রিউস্টার। ব্রাজিল ভুলে তাকে নিয়ে যুবভারতী গাইতেই পারে— ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিট্‌ল স্টার, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর!’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy