শ্রদ্ধেয়: ক্লাব তাঁবুতে ব্যোমকেশ বসুর সঙ্গে শঙ্কর মালি। ফাইল চিত্র
তিন নম্বর জার্সিটা আমার হাতে তুলে দিয়ে শঙ্করবাবা বললেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে নামছ, জিতে ফিরো। আমাদের জার্সির মান রেখো।’’ আবার সেই মানুষটিকেই দেখেছি, কোনও ফুটবলার ক্লাব ছেড়ে গেলে তাঁবুর একপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন।
বাচ্চা ছেলে আমি খেলতে এসেছি ইস্টবেঙ্গলের মতো দেশের সেরা ক্লাবে। রোমাঞ্চের পাশাপাশি মনে ভয়ও রয়েছে। অনুশীলন করছি সুরজিৎ সেনগুপ্ত, সমরেশ চৌধুরী, শ্যামল ঘোষদের সঙ্গে। লাল-হলুদ জার্সি পরে ওরা সবাই তখন তারকা। তার উপর আবার আমাকে নেওয়া হয়েছে সেই সময়ে ক্লাবের স্বর্ণযুগের সেরা স্টপার অশোকলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায়। ভয়ে ভয়ে বসে আছি। কলকাতা লিগের ম্যাচ। বাড়ি থেকে বুট নিয়ে এসেছি। খেলা শুরুর দু’ঘণ্টা আগে শঙ্করবাবা আমার পাশে রেখে গেলেন জার্সি আর প্যান্ট। সঙ্গে উলের মোজাও। সবার পাশেই যা তিনি রাখতেন।
দক্ষিণ ভারতের মানুষ ছিলেন শঙ্কর পিল্লাই। পদ ছিল ক্লাবের ‘হেড মালি’। কিন্তু তিনিই ছিলেন ড্রেসিংরুমে এবং মাঠে আমাদের অভিভাবক। কোথায় কার বুট ছিঁড়ে গিয়েছে, জার্সি-প্যান্ট কেচে সুন্দর করে রেখে দেওয়া সবই করতেন তিনি। আবার হোটেলে বেশি রাত পর্যন্ত জেগে তাস খেললে বা গল্প করতে দেখলে ধমক দিয়ে বলতেন, ‘‘কাল ম্যাচ আছে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।’’ আমরা সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কথা শুনতাম। কারও সাহস ছিল না সেই আদেশ অমান্য করার। দিনে দিনে পক্বকেশ এবং গোলগাল মানুষটি হয়ে উঠেছিলেন সবার ‘বাবা’। শঙ্করবাবা। যতদূর মনে আছে সত্তরের দশক থেকেই তাঁকে সবাই ওই নামেই ডাকতেন। আমাদের প্রিয় ক্লাবের শতবর্ষের মুখে শঙ্করবাবার কথা ভাবলে এখনও গায়ে শিহরন জাগে।
১৯৭৮ সাল। বরদলৈ ট্রফিতে অসম পুলিশের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে আমার হাত ভাঙল। অস্ত্রোপচার করতে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন উনি। আমাকে বেডে দেওয়া হল। রাত হয়ে গিয়েছে। আমি বললাম, ‘‘বাবা, আমি এবার ঘুমোব। তুমি হোটেলে ফিরে যাও।’’ ঘরে ছোট আলো জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন সকালে উঠে দেখি মাটিতে বসে আছেন শঙ্করবাবা। পরে শুনলাম, সারা রাত ও ভাবেই বসেছিলেন। হোটেলে ফিরে যাননি।
প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস পর ফিরলাম মাঠে। ডুরান্ডে খেলতে গিয়েছি। জিতছি এয়ারফোর্সের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ার্ধে দেখি বুটের গোড়ালিতে একটা পেরেক খচখচ করে বিঁধছে। খুব লাগছিল। কিন্তু শক্তিশালী এয়ারফোর্স তখন ২-১ করে দিয়েছে। প্রচণ্ড ব্যথা করলেও বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। খেলা শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরে দেখি, গোড়ালিতে গর্ত হয়ে রক্ত ঝরছে। সেটা দেখে কেঁদে ফেললেন শঙ্করবাবা। কান্নার কারণ আর কিছু নয়, যে-হেতু বুটের দেখভালের দায়িত্ব তাঁর উপর থাকত, তাই অপরাধবোধে ভুগছেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘‘আমি অনেক দিন পর নেমেছি তো। সে জন্যই সমস্যা হয়েছে।’’
শঙ্করবাবা একটা সময়ে কার্যত আমার পরিবারের লোক হয়ে উঠেছিলেন। বাড়িতে আসতেন মাঝেমধ্যেই। ড্রেসিংরুমে তাঁকে কেউ কিছু বললে আমি প্রচণ্ড রেগে যেতাম। লাল-হলুদ তাঁবুতে নিজের ‘বাবা’-র মতোই অভিভাবক হিসাবে মানত সবাই। ওর অনুরোধ আমি ফেলতে পারতাম না। এ রকম অনেক বার হয়েছে যে, ছিঁড়ে যাওয়া মোজা সেলাই করে এনে বলেছিলেন এটা পড়ে খেলো। নতুনটা রেখে দাও। সেটা তুকতাক বুঝতে পারতাম। কারণ ওটা পরে আগের ডার্বি জিতেছিলাম বলেই ওটা পরে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলতে অনুরোধ করছেন ‘বাবা’।
১৯৯০-তে ইস্টবেঙ্গল সে বার ত্রিমুকুট জয়ের সামনে। শেষ টুর্নামেন্ট রোভার্স কাপ। ফাইনাল ম্যাচ মহীন্দ্রার সঙ্গে। আমাদের কোচ নইমদা। ভাল করে হাঁটতে পারছি না। আমার কুঁচকিতে চোট। সবাই জোরাজুরি করছে মাঠে নামার জন্য। কোচ তো বটেই, ম্যানেজার সুপ্রকাশ গড়গড়ি, কৃশানু-বিকাশদেরও ফিরিয়ে দিয়েছি। টিম মিটিং থেকে বেরিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি আমার জার্সি-প্যান্ট-বুট নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে শঙ্করবাবা। ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘মনা, তোমাকে খেলতেই হবে। এই নাও বুট।’’ ‘না’ করতে পারলাম না। দশ মিনিট মনে হয় খেলেছিলাম। আসলে আমার নামাটা ওঁর কাছে আসল ছিল না, ছিল ‘তুকতাক’। আইএফএ শিল্ড আর ডুরান্ডে দলে ছিলাম আমি। এ বার না নামলে যদি ট্রফি না পাই! সে জন্যই ছিল আকুতি। হাওড়ার বাড়ি থেকে সকাল ছ’টায় মাঠে আসতেন। রাত দশটায় ফিরতেন। সারা দিন আগলে রাখতেন ড্রেসিংরুম। সবার দেখভাল করতেন। আবার তাঁকেই দেখেছি, কোনও ফুটবলার বেরিয়ে যাওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়তে।
শঙ্করবাবা, তোমাকে ভুলব কী করে?
(সাক্ষাৎকার: রতন চক্রবর্তী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy