সম্মান: ডাবল সেঞ্চুরির পরে তৃপ্ত মায়াঙ্ক আগরওয়াল। তারিফ প্রতিপক্ষ অধিনায়ক ডুপ্লেসিরও। পিটিআই
মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টে যখন তিনি অভিষেক ইনিংসে ব্যাট করতে ক্রিজে পৌঁছলেন, সাদর অভ্যর্থনা জানালেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক। ‘‘এ কী, তোমার ব্যাট তো দেখছি একদম ন্যাড়া। এখনও স্পনসর পাওনি!’’ ভারতীয় ওপেনারের লোগো-হীন ব্যাট দেখে বুলেট ছুড়লেন টিম পেন। সতীর্থদের দিকে তাকিয়ে এর পর তীব্র শ্লেষ মেশানো প্রশ্ন, ‘‘তোমাদের কী মনে হচ্ছে? কত দাম হতে পারে ওর?’’
জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে আসা কারও সেই সময় নাড়িভুঁড়ি এক হয়ে যাওয়ার কথা। একে তো অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মেলবোর্নে সত্তর হাজার দর্শকের সামনে অভিষেক টেস্ট খেলার প্রাণান্তকর চাপ। তার উপর প্রতিপক্ষ বোলারদের তালিকায় মিচেল স্টার্ক, প্যাট কামিন্স, জশ হেজলউড, নেথান লায়নের মতো নাম। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই শুরু করলেন নবাগত। মুখে কথা না বলে ৭৬ এবং ৪২ রানের লড়াকু ইনিংস খেলে যা জবাব দেওয়ার ব্যাটেই দিলেন।
এটাই যে মায়াঙ্ক আগরওয়ালের পৃথিবী। নীরব যোদ্ধার মতো কাজ করে যাও। বিশ্বকাপে পরিবর্ত হিসেবে দলে ঢুকলেন। তিনিও জানতেন, খেলার সুযোগ হয়তো আসবেই না। তবু সকলের শেষে মাঠ ছাড়তেন। কোচেদের তাঁকে গিয়ে বলতে হত, এ বার চলো, বাস ছেড়ে দিচ্ছে। এক বার টিম ম্যানেজমেন্টের এক সদস্য তাঁকে ইংল্যান্ডে এক বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য ডাকলেন। এসেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘হাই, আই অ্যাম মায়াঙ্ক।’’ ভারতের হয়ে খেলে ফেলা কোনও ক্রিকেটার যে ভাবতে পারেন, তাঁকে ক্রিকেট মহলে কেউ না-ও চিনতে পারে, এটাই তো অকল্পনীয়!
ওপেনিং পার্টনার রোহিত শর্মার মতো গলি থেকে রাজপথের কাহিনি তিনি নন। ডোম্বিবলীর শর্মা পরিবারের যেমন স্কুলে ভর্তির পয়সাটুকুও এক সময় জুটত না, সে রকম দারিদ্রের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়নি কর্নাটকের আগরওয়াল পরিবারকে। বাবা অনুরাগ আগরওয়াল যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতার মধ্যে ছেলেকে বড় করতে পেরেছেন। পাশাপাশি, আশ্রমিক অনুশাসনেও বেঁধেছেন তাঁকে। উদাহরণ? কিশোর বয়সেই বাবা বলে দেন, ‘‘ক্রিকেট খেলতে চাইছ, ঠিক আছে। কোনও ফাঁকি দেওয়া চলবে না। আর শুনে রাখো, যদি আমার ব্যবসায় ঢুকতে চাও, ক্লার্ক হিসেবে শুরু করতে হবে। আমার ছেলে বলেই আমার সংস্থায় সরাসরি উচ্চ পদের চেয়ার স্বাগত জানানোর জন্য বসে নেই।’’
সে দিনই জন্ম হয় যোদ্ধা মায়াঙ্কের। যিনি বুঝে যান, সব কিছু আমাকে লড়েই আদায় করতে হবে। বাবার আর্থিক স্বচ্ছলতা মানেই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মাইনি আমি। মেলবোর্নে বক্সিং ডে-তে সেই যোদ্ধার যাত্রা শুরু। আর বৃহস্পতিবার সমুদ্রের স্রোতের মতোই আছড়ে পড়ল সমুদ্রে ঘেরা বিশাখাপত্তনমে। মেলবোর্নে সে দিন একা টিম পেন নন, প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটার কেরি ও’কিফ সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে তীব্র কটাক্ষ ছুড়ে দিয়েছিলেন, ‘‘ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে নাকি ছেলেটা ট্রিপল সেঞ্চুরি করে এসেছে। ক্যান্টিন স্টাফদের বিরুদ্ধে করে থাকবে নিশ্চয়ই।’’ মেলবোর্নেই ব্যাট হাতে ও’কিফদের মুখ ভোঁতা করে দিয়েছিলেন। বিশাখাপত্তনমে যখন ডাবল সেঞ্চুরি করে দু’হাত প্রসারিত করে তুলে ধরলেন, উত্তর পেয়ে গেলেন টিম পেন-ও। স্পনসরের লোগো জ্বলজ্বল করছে মায়াঙ্কের ব্যাটে। মনে হচ্ছিল, একই সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়াকে পিটিয়ে দ্বিশতরান করলেন।
সেটা ছিল ডিসেম্বর। এটা অক্টোবর। দশ মাসেই খেলার বাণিজ্যিক জগতে স্থায়িত্বের সুগন্ধি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। ঠিক যেমন জিতে নিয়েছেন ভারতীয় দল পরিচালন সমিতির আস্থা। ওপেনারদের নিয়ে তৈরি মিউজিক্যাল চেয়ারের মধ্যেও তাই তাঁদের মুখে শোনা গিয়েছে, ‘‘মায়াঙ্ক খেলবে। দেখতে হবে, কে ওর পার্টনার হয়।’’ মায়াঙ্ক সেই আস্থার মর্যাদাই শুধু দেননি, রোহিতের সঙ্গে দুর্দান্ত জুটি গড়ে সিরিজ ১-০ করে ফেলার দিকেও এগিয়ে দিয়েছেন দলকে। পিচে বল ঘুরছে এবং শুরু হয়ে গিয়েছে অশ্বিনের কামাল। বৃষ্টি বিঘ্ন না ঘটালে ভারতের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার টানা চতুর্থ টেস্ট হার হয়তো সময়ের অপেক্ষা।
দিলীপ সরদেশাই, বিনোদ কাম্বলি এবং করুণ নায়ারের পর মায়াঙ্ক চতুর্থ ভারতীয়, যিনি প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিকে ডাবল সেঞ্চুরিতে পরিণত করলেন। কে বলবে, কেরিয়ারের প্রথম দিকে ভাল শুরুকে বড় রানে পাল্টাতে পারতেন না বলেই অনিশ্চয়তার মেঘ ঘিরে ধরেছিল তাঁকে। আর তা থেকেই জন্ম নেয় আত্মবিশ্বাসের অভাব। অসহিষ্ণুতা আর আতঙ্কের চোরা রোগে নিয়মিত ভাবে ভুগতেন তিনি। আর তার প্রভাব পড়ছিল ক্রিকেটে। কোচেদের পরামর্শ এবং বৌদ্ধ উপাসনার অঙ্গ বিপাসনা ধ্যান করে তিনি সেই রোগ সারিয়ে তোলেন। বিশাখাপত্তনমে ওপেনিং জুটিতে ৩১৭ রান ওঠার পরে আশা করা যায়, নতুন ওপেনার নেওয়ার জন্য ফোনলাইনও সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়ে গেল। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে টেস্টে ওপেনিং জুটিতে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান। বিনু মাঁকড়-পঙ্কজ রায়ের ৪১৩ এবং বীরেন্দ্র সহবাগ-রাহুল দ্রাবিড়ের ৪১০ রানের পরে।
ঘরের মাঠে নতুন মরসুমের শুরুতেই নতুন যুগলবন্দির উত্থানে পিছিয়ে পড়া নামগুলো এক বার দেখে নেওয়া যাক। কে এল রাহুল, মুরলী বিজয়, শিখর ধওয়ন, পৃথ্বী শ। বিশেষ করে পৃথ্বীর উপর নির্মম প্রত্যাঘাত করতে পারে ক্রিকেট। টিনএজার হিসেবে তারকাদের গ্রহে ঢুকে লাগাম হারানো ফেরারি গাড়ির মতো ছুটতে গিয়েছিলেন তিনি। আর বাবার কড়া শাসনের মধ্যে মায়াঙ্কের জীবন সব সময় এগিয়েছে ব্রেকে পা রেখে। ডানা মেলে উড়েছেন মায়াঙ্কও। ‘লন্ডন আই’-এর উপরে উঠে প্রেম নিবেদন করেছিলেন বান্ধবীকে। সেই আশিতা এখন তাঁর স্ত্রী। তখন লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু ব্যাট হাতে এবং প্রেমের বাইশ গজে দুঃসাহসিক হয়েও জীবনের হাইওয়েতে দুর্ঘটনা হতে দেননি মায়াঙ্ক। সেই সংযমটাই দেখাতে না পেরে সচিন তেন্ডুলকরের পরে সব চেয়ে আলোড়িত কিশোর প্রতিভা হয়েও পিছিয়ে পড়ছেন পৃথ্বী। তার চেয়ে অনেক দেরিতে শুরু করেও এগিয়ে গেলেন মায়াঙ্ক।
ফের সেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পটা মনে পড়ে গেল!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy