আগ্রাসী: স্ট্রেট গেমে জয়ের পথে লক্ষ্য় সেন। শনিবার প্যারিসে। ছবি: পিটিআই।
যদি কেউ মনে করে থাকেন, অলিম্পিক্স বোধনে আরব্য রজনী উপহার দেওয়াতেই প্যারিসের চমক শেষ হয়ে গেল, ভুল। ইভেন্ট শুরুর প্রথম দিনেই এমন সব ঘটনার স্রোত চারদিকে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে যে, রুদ্ধশ্বাস অলিম্পিক্সের মঞ্চ তৈরি হয়ে থাকল।
শুটিংয়ে উদ্বেগ দিয়ে শুরু হয়েও ভারতের দিনটা শেষ পর্যন্ত খারাপ গেল না। মনু ভাকের ফাইনালে উঠে পদক সম্ভাবনা তৈরি করলেন। হকিতে জিতে শুরু হল। ব্যাডমিন্টনে এ বার অনেকে একাধিক পদকের আশা করছেন। লক্ষ্য সেন তার মধ্যে অন্যতম পদক সম্ভাবনা। তিনি জিতে শুরু করলেন। লক্ষ্য প্রথম গেম ২০ মিনিটের মধ্যে তুড়ি মেরে জিতে গেলেন ২১-৮ ব্যবধানে। দ্বিতীয় গেমে পিছলে যাচ্ছিলেন। এক সময় ৬-১০ পিছিয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে লড়াই করে ম্যাচে ফিরলেন। দু’বার গেম পয়েন্ট বাঁচিয়ে জিতলেন।
কিন্তু বাকি বিশ্বের জন্য মায়াবী বোধনের রেশ চলতে থাকার মধ্যে আবেগের বলয় তৈরি করে দিলেন সেই ফরাসিরাই। জ়িনেদিন জ়িদান উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাফায়েল নাদালের হাতে অলিম্পিক্স মশাল তুলে দিয়েছিলেন। ফরাসিদের অনেকের কাছে সব চেয়ে আবেগপূর্ণ মুহূর্ত। এক জন নিজেদের দেশের বিশ্বকাপজয়ী অবিসংবাদী নায়ক। অন্য জন রোলঁ গারোজ়ের রাজা। শনিবার ফরাসি ক্রীড়াপ্রেমীরা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা স্যেন নদীর তীরে দেখানো একতা গোটা অলিম্পিক্সে বারবার দেখাবেন। বোধনে টানা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তাঁরা সাড়ে তিন ঘণ্টার অনুষ্ঠান ছেড়ে যাননি। এ দিন স্তাদ দে ফ্রান্স, যেখানে জ়িনেদিন জ়িদান দেশের মাঠে ১৯৯৮-এ বিশ্বকাপ উপহার দিয়েছিলেন, সেখানে লোক উপচে পড়ল। প্রথম দিনেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে রাগবি সেভেন্সে হারিয়ে বিরাট অঘটন ঘটিয়ে দিল ফ্রান্স। কারও কারও মত, প্রায় সত্তর হাজার দর্শক শুধু চেঁচিয়েই জিতিয়ে দিল আয়োজক দেশকে। তারা প্রথম দিনেই দেশের পতাকা জড়িয়ে হাজির হয়ে গান ধরল। কয়েক বছর আগেও রাগবি সেভেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর কথা কেউ ভাবতে পারত না। ফ্রান্স শুধু তাদেরই হারাল না, এর পর ফিজিকে উড়িয়ে সোনাও জিতে নিল। কে বলবে টোকিয়োয় এই দলটা যোগ্যতা অর্জনই করতে পারেনি! ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাকরঁ পর্যন্ত হাজির ছিলেন এই সোনা জয় দেখতে। অলিম্পিক্স মানেই তো এই। অকল্পনীয়, অভাবনীয় সব কৃতিত্বের ফুলকি।
পোর্ত দে লা শ্যাপেল, যেখানে লক্ষ্য সেন ব্যাডমিন্টনে নেমেছিলেন, সেটাও মিনি স্তাদ দে ফ্রান্সের আকার নিয়েছিল। লক্ষ্য মাঝের কোর্টে খেলছিলেন। আর ভর্তি স্টেডিয়াম চিৎকার করে যাচ্ছিল বাঁ দিকের কোর্টের মিক্সড ডাবলস জুটির জন্য। সেখানে তখন চিনের বিরুদ্ধে লড়ছে ফরাসি জুটি। এমন গর্জনের মধ্যে খেলতে গিয়েই কি মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটল? প্রশ্ন করা হল লক্ষ্যকে। তিনিও মেনে নিলেন, এমন শব্দবাণের মুখে খুব একটা পড়েননি। সত্যিই এমন জনগর্জনের মধ্যে লক্ষ্যে স্থির থাকা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মেক্সিকান ওয়েভ উঠছে, বিরল দৃশ্য। ফরাসিরা বুঝিয়ে দিলেন, অলিম্পিক্সের ক’টা দিন বিরল বলে কিছু নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই অলিম্পিক্সে ফ্রান্সের সেরা শক্তি হতে যাচ্ছে তাঁদের জনতা।
অস্ট্রেলিয়ার হকি খেলোয়াড় ম্যাট ডসনের কথা শুনলাম। আঙুল ‘অ্যাম্পুট’ করে বাদ দিয়ে অলিম্পিক্সে খেলতে চলে এসেছেন। দু’সপ্তাহ আগে হকি স্টিকের জোরাল আঘাত লাগে আঙুলে। কেটে বাদ দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। ৩০ বছরের ডসন দ্বিধা করেননি। একলব্যের দ্রোণাচার্যকে আঙুল কেটে দিয়ে দেওয়ার মতো অলিম্পিক্সকে আঙুল দিয়ে দিলেন! কী সব কাহিনি!
এর মধ্যেই আবার ‘ইন্ডিয়া হাউজ়’-এর উদ্বোধন হল প্যারিসে। এই প্রথম অলিম্পিক্সে ভারতের এমন উৎসবের তাঁবু তৈরি হল। অন্যান্য কয়েকটি দেশের আগে থেকেই ছিল। অম্বানীদের রিলায়্যান্স সংস্থার উদ্যোগ। পদক জিতলে এখানে এসেই ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীরা উৎসব করবেন। এ দিন শানের গান দিয়ে শুরু হল। নিশ্চিত থাকা যায়, মনু ভাকের রবিবার পদক জিতলে এখানে ভারতীয় তেরঙ্গা উড়বে, ‘চক দে ইন্ডিয়া’ বাজবে। রবিবার ‘ইন্ডিয়া হাউজ়’-এ বিশেষ অতিথি আসছেন। তাঁর নাম? রাহুল দ্রাবিড়।
দেখেশুনে মনে হচ্ছে, ফরাসিরা যেমন ঠিক করে নিয়েছে তাঁদের দেশ নামলেই গর্জনে ভরিয়ে তুলবে, তেমনই ভারতও মনস্থির করে ফেলেছে। প্যারিসে ভারত উদয় ঘটাতে হবে। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, আসল উৎসব তখনই সম্ভব যদি পদক তালিকায় উন্নতি ঘটানো যায়। না হলে দ্রাবিড়-দর্শনই হবে আর ভারত থেকে যাবে ক্রিকেটের দেশ হিসেবে। অলিম্পিক-বলয় তৈরি করা স্বপ্নই থেকে যাবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy