বিরাট কোহলি। ছবি: আরসিবি।
বিরাট কোহলির বাড়িতে এক জোড়া বিশ্বকাপের পদক রয়েছে। অথচ ‘বিরাট’ হওয়ার পর আর বড়় কোনও প্রতিযোগিতা জেতা হয়নি তাঁর!
একদম জেতা হয়নি তা অবশ্য নয়। ২০১৩ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। তিন বার এশিয়া কাপজয়ী ভারতীয় দলের সদস্যও তিনি। ২০০৮ সালের অনূর্ধ্ব ১৯ এবং ২০১১ সালের এক দিনের বিশ্বকাপ ছাড়াও সাফল্য রয়েছে। তবু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলির মধ্যে কৌলীন্যে অনেক পিছিয়ে এশিয়া কাপ। ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময়ও কোহলির আসলে ‘বিরাট’ হয়ে ওঠা হয়নি। তখনও তিনি ‘বিরাট’-এর থেকে অনেক বেশি দিল্লির উত্তম নগরের চিকু। যার মধ্যে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। যাঁকে নিয়ে প্রথম থেকেই উচ্ছ্বসিত ছিলেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞেরা। তত দিনে ভারতীয় দলে জায়গা পাকা করে নেওয়া কোহলি ক্রিকেটপ্রেমীদের আশা পূর্ণ করেছেন। নিজেকে ভাল থেকে খুব ভাল, আবার খুব ভাল থেকে তারকায় পরিণত করেছেন। পরিবর্তনের এই অধ্যায় সহজ ছিল না। প্রিয় অনেক কিছু জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে হয়েছে তাঁকে। নিজেকে শুধু উন্নত থেকে উন্নততর করার তাগিদে বদলে ফেলেছেন ক্রিকেট দর্শন। নিজেকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার হিসাবে গড়ে তুলেছেন। যা যা করা দরকার সব করেছেন। নিখাদ নিষ্ঠা, আন্তরিকতায় নিজের ব্যাটিং, ফিল্ডিংয়ের পরিমার্জন, পরিবর্ধন ঘটিয়েছেন। সতীর্থদের সামনে নিজেকে উদাহরণ তৈরি করেছেন। তবুও ধরা দেয়নি সাফল্য।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয়, এমনকি আইপিএলেও নয়! সেই ২০০৮ সাল থেকে আইপিএল খেলছেন। প্রতি বার রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে চ্যাম্পিয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামেন। নিজের সেরাটা দিয়ে দলকে জেতানোর জন্য স্বেচ্ছায় নেতৃত্বের দায়িত্বও ছেড়ে দিয়েছেন। ১৭ বার আইপিএল খেলেও চ্যাম্পিয়ন হওয়া হল না! এ বারও বিদায় বেলায় তাঁর সঙ্গী শূন্য দৃষ্টি।
ধোনির জন্য যেমন চেন্নাই সুপার কিংসের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তেমনই কোহলির জন্য হয়েছে বেঙ্গালুরুর। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি তাঁকে সব দিয়েছে। যেমন দল চেয়েছেন, তেমনই দেওয়ার চেষ্টা করেছে। নির্দিষ্ট কোনও ক্রিকেটারকে নেওয়ার কথা বললে, ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি কর্তৃপক্ষ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েছেন নিলামে। কোহলি শুধু নেননি। দিয়েছেনও। নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন বেঙ্গালুরুর জন্য। ২০২৪ সালের লিগ পর্ব পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর জন্য ৭৯৭১ রান করেছেন। আটটি শতরান, ৫৫টি অর্ধশতরানের ইনিংস খেলেছেন। ২০১৬ সালে ৯৭৩ রান করে কমলা টুপি জিতেছিলেন। আইপিএলের ইতিহাসে আর কোনও ক্রিকেটার এক মরসুমে এত রান করতে পারেননি। এ বারও ৭৪১ রান করে কমলা টুপির দৌড়ে সকলের আগে রয়েছেন। একাধিক মরসুমে তিনি আইপিএলে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় প্রথম দিকে থেকেছেন। তবু ট্রফি জেতা হয়নি।
এ বারের আইপিএলে একটা সময় বেঙ্গালুরু পর পর পাঁচ ম্যাচ হেরে প্রথম দল হিসাবে ছিটকে যেতে পারত। তার পর টানা ছ’ম্যাচ জিতে প্লে-অফে পৌঁছেছেন কোহলিরা। লিগের শেষ ম্যাচে চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে শুধু জয় যথেষ্ট ছিল না। জরুরি ছিল নেট রান রেটে ধোনিদের টপকে যাওয়ারও। কোহলিরা পেরেছিলেন। পারার সেই মুহূর্তে কেঁদে ফেলেছিলেন কোহলি। চিন্নাস্বামী স্টেডিয়াম, টেলিভিশনের দর্শকেরা সেই দৃশ্য ভোলেননি এখনও।
মাঠে সব সময় আগ্রাসী মেজাজে থাকেন কোহলি। ক্রিকেটপ্রেমীরা তাঁকে সে ভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। সেই কোহলিও কাঁদেন। তিনিও তো আসলে রক্ত-মাংসের মানুষ। পেশাদার হলেও আবেগহীন নন। খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসতে পারার আবেগ লুকিয়ে রাখতে পারেননি। তাঁকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারেননি গ্যালারিতে থাকা স্ত্রী অনুষ্কা শর্মাও। হয়তো অনেক কোহলি-ভক্তও।
১৭তম আইপিএল খেলছেন কোহলি। প্রথম ১৬ বার ট্রফি জিততে পারেননি। ২০০৯, ২০১১, ২০১৬— তিন বার ফাইনালে উঠেও শিখর স্পর্শ করা হয়নি কোহলির বেঙ্গালুরুর। হয়নি কোহলিরও। এ বার অধরা ট্রফি জিততে মরিয়া ছিলেন কোহলি। নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছিলেন। তবু দল প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছিল না। সমালোচিত হচ্ছিল কোহলির ব্যাটিংও। বলা হচ্ছিল, তাঁর মন্থর ব্যাটিংয়ের জন্যই জিততে পারছে না বেঙ্গালুরু। সুনীল গাওস্করের মতো প্রাক্তন ক্রিকেটারও সোচ্চার হয়েছিলেন কোহলির স্ট্রাইক রেট নিয়ে। পাল্টা মুখ খুলেছিলেন কোহলিও। ১৪০ বা ১৫০ স্ট্রাইক রেট নাকি কোহলিকে মানায় না। আরও বেশি দিতে হবে তাঁকে। ঠিক যেমন টানা বেশ কয়েকটি ম্যাচে শতরান না পেলেই তাঁর ফর্ম নিয়ে কথা ওঠে!
প্রত্যাশার চাপ। ‘বিরাট’ এই চাপ নিয়েই বছরের পর বছর খেলে চলেছেন কোহলি। পারলে তিনিই পারবেন— ক্রিকেটপ্রেমীদের এই ধারণা, বিশ্বাস তৈরি করেছেন কোহলি নিজেই। তৈরি করেছে তাঁর ক্রিকেটীয় মান। সেই মানের মান রাখাই কোহলির কাছে এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। কোহলি চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পান না। পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতেও দু’বার ভাবেন না। অভিজ্ঞ কোহলি জানেন, তিনি কতটা ‘বিরাট’— অবসরজীবনে মাপা হবে ট্রফির সংখ্যা দিয়ে। কত রান করেছেন, ক’টা শতরান করেছেন এ সব কিছু চলে যাবে দ্বিতীয় সারিতে। ক্রিকেট জনতা মনে রাখবে না চিকুর ট্রফির সংখ্যা। হিসাবে তুলাযন্ত্রে মাপা হবে ‘বিরাট’ ট্রফির ওজন। ধোনি সর্বত্র সফল অধিনায়ক হিসাবে। রোহিতও মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে পাঁচ বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন করেছেন অধিনায়ক হিসাবে। পেশাদার খেলোয়াড়েরা জানেন এক নম্বরে পৌঁছনো কঠিন। তার থেকে অনেক বেশি কঠিন সেই জায়গা ধরে রাখা। শুধু হাজার রান করে সেই জায়গা ধরে রাখা যায় না এখন। খেলোয়াড় হিসাবেও তো জীবন পূর্ণতা পাবে না। ২০০৮ সাল থেকে ভরসা রাখা ফ্র্যাঞ্চাইজ়িকেও তো কিছু ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। কোহলির অজানা নয় কিছুই। কতটা চাপে ছিলেন, তা বোঝা গিয়েছিল লিগ পর্বের শেষ ম্যাচ জেতার পরই।
খেলার জগতে ‘চ্যাম্পিয়ন্স লাক’ বলে একটা কথা প্রচলিত। অর্থাৎ ভাগ্য না থাকলে ট্রফি জেতা যায় না। তাই বলে কোহলির একটা আইপিএল ট্রফি থাকবে না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy