ইডেনে খেলা শেষে মাঠে নামলেন শাহরুখ খান। ছবি: আইপিএল।
আইপিএল। বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট প্রতিযোগিতা। কোটি কোটি টাকার খেলা। নানা আয়োজন। দর্শককে আকৃষ্ট করার চেষ্টায় খামতি নেই। সেই চেষ্টায় ক্রিকেট নেই! থেকেও নেই।
আইপিএলের দর্শক গ্যালারিতে ঠিক ভাবে বসার আগেই ছক্কা দেখতে চায়। কোনও ব্যাটার ভাল ক্রিকেটীয় শট নিলেও ইডেন চুপ করে থাকে! আবার ব্যাটের কোণা ছুঁয়ে বল মাঠের বাইরে গেলে গর্জে ওঠে! আইপিএলের দর্শকের চোখ ক্রিকেটারদের থেকে বেশি খোঁজে শাহরুখ খানের মেয়েকে। সুহানার পোশাক বেশি আকর্ষণীয় লোকেশ রাহুলের ব্যাটিংয়ের থেকে। দর্শকদের দায় আছে। আরও বেশি আছে ক্রিকেট প্রশাসকদের। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের। ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি মালিকদের।
ক্রিকেটের আকর্ষণ বৃদ্ধিতেই সিংহভাগ আন্তরিকতা। মান যেন এমনই বাড়বে। আইপিএলে ব্যবহৃত স্টাম্পগুলি তো চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোকসজ্জা। কত রং! কত রকমের আলো! বেগনি, সোনালি, লাল, নীল। আলো জ্বলে ওঠার জন্য ব্যাটারের আউট হওয়ার দরকার নেই। যখন-তখন জ্বলে উঠছে আলো। বিভিন্ন আলোর অর্থ আলাদা। উইকেট ভাঙলে লাল, ‘নো’ বল হলে সাদা, চার হলে বেগনি, ছয় হলে বেগনির সঙ্গে সোনালি।
আমোদের শেষ নেই। চিয়ারলিডার আছেন। গান বদলায়, নাচ বদলায় না। এক গান দু’বার বাজে না। হিন্দি সিনেমার জনপ্রিয় গানের দাপটের মধ্যেও লোকাল ফ্লেভারের ব্যবস্থা আছে। ‘বড় লোকের বিটি লো’ বেজে ওঠে স্টেডিয়ামের সাউন্ড সিস্টেমে। চিয়ারলিডারেরা সামনে ঝুঁকে, পা প্রায় মাথায় তুলে, কোমর বেঁকিয়ে নাচেন। সব গানে এক মুদ্রা! সঙ্গে মাঝেমাঝে ধোঁয়ার ফোয়ারা।
আইপিএলের দর্শকদের অনেকে ক্রিকেটারকে চেনেন না! দু’-একটা নাম ‘মুখস্থ’ করে আসেন। কলকাতা নাইট রাইডার্স আর লখনউ সুপার জায়ান্টসের খেলায় তাঁরা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি বা বিরাট কোহলিকে খোঁজেন! আইপিএল দেখতে যাওয়া এখন বেশ ‘ইন’। সামাজিক স্টেটাস নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি। আত্মীয়-পরিজন, প্রতিবেশী, বন্ধুদের কাছে দরবৃদ্ধির মাধ্যম! খেলা দেখার থেকে নিজস্বী তোলায় আগ্রহ বেশি। স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকেই পটাপট পোস্ট হয়ে যায় অন্য গ্যালারিতে।
বড়লোকের ব্যাটা-বিটিদের আমোদের জন্যই আয়োজন। ব্যাপারটা আসলে গ্যালারি শো। শাহরুখ বারান্দায় আসেন। হাত নাড়েন। চুমু ছুড়ে দেন। গ্যালারি গর্জন করে। কেকেআরের বিশিষ্ট অতিথিরা বিরামহীন ভাবে চুল ঠিক করতে থাকেন। টেলিভিশনের ক্যামেরা তো আর বলে ধরবে না! রিটেক নেই। ক্রিকেটও নেই!
গ্যালারিতে সাচ্চা ক্রিকেটপ্রেমী, ক্রিকেটবোদ্ধারাও থাকেন। তবে তাঁরা সংখ্যালঘু। বাকিদের আমোদের ঠেলায় তাঁদের ক্রিকেট মাথায় ওঠে। কেউ কেউ আবার গোটা ম্যাচ চিয়ারলিডারদের ঠিক সামনে ফেন্সিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এও এক আমোদ। বেশি ক্ষণ চার-ছয় না হলে বা উইকেট না পড়লে খুব বিরক্ত হন তাঁরা।
কিছু দর্শক দলের খেলা দেখার থেকেও নির্দিষ্ট কোনও ক্রিকেটারের খেলা দেখতে যান। সেই ক্রিকেটার ব্যাট বা বল করার সুযোগ না পেলে রেগে যান। তাঁদের রাগ ভাঙানোর জন্য থাকেন ডিজে। তাঁর কথায় দর্শক কখনও দাঁড়ান, কখনও বসেন, কখনও মোবাইলের ব্যাটারি পোড়ান, কখনও চিৎকার করেন, আবার কখনও সিটি বাজান। ডিজে নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী। অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার মানুষকে নিজের অনুগামী তৈরি করে ফেলেন। এমন ডিজে নির্বাচনে দাঁড়াতেই পারেন।
আইপিএল আসলে এক আমোদ। ক্রিকেটের মোড়কে বিনোদন। প্রতি বলে চার, ছয় বা উইকেট চাই। চিয়ারলিডারদের নাচ চাই। ডিজের উস্কানি চাই। আলো ঝলমলে স্টাম্প চাই। রানের থেকে বেশি নিজস্বী চাই। শাহরুখের উড়ন্ত চুমু চাই। নাম জেনে আসা ক্রিকেটারকে মাঠে চাই। হাজার হাজার টাকার টিকিটের দাম ওঠা চাই।
ক্রিকেট থেকেও ক্রিকেট নেই আইপিএলে। শীতের সার্কাসের মতো অনেকটা। আমোদে ভরপুর। অধিকাংশ দর্শকের, কর্তাদের, বোর্ডের। হয়তো বা ক্রিকেটারদেরও।
এই আমোদ দেখিয়েই এগোচ্ছে ক্রিকেট। অলিম্পিক্সেও হবে। বোঝা গেল, নতুন খেলাগুলির লড়াইয়ে ব্রেকডান্সকে কী ভাবে হারাল ক্রিকেট! সত্যিই, স্কোরবোর্ড ‘গাধা’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy