আশুতোষ শর্মা। ছবি: বিসিসিআই।
মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে পঞ্জাব কিংসকে প্রায় জিতিয়ে দিয়েছিলেন আশুতোষ শর্মা। ২৮ বলে ৬১ রান করেন তিনি। ১৪ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরেও পঞ্জাবকে জয়ের আশা দেখিয়েছিলেন আশুতোষ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকতে পারলেন না তিনি। থাকলে হয়তো ম্যাচ জিতিয়েই ফিরতেন। কিন্তু তাঁর লড়াই মন জয় করে নিয়েছে বিপক্ষের অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ড্যেরও।
বৃহস্পতিবার যশপ্রীত বুমরা এবং জেরাল্ড কোয়েৎজ়ির দাপটে পঞ্জাব প্রথম ১৩ বলে ৪ উইকেট হারায়। সেখান থেকে যে তারা ১৯৩ রানের লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছবে, এমনটা কল্পনাই করা যায়নি। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে দেওয়ার পণ করেছিলেন শশাঙ্ক সিংহ এবং আশুতোষ। শশাঙ্ক ২৫ বলে ৪১ রান করে আউট হয়ে যাওয়ার পরেও আশুতোষ লড়ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলকে জেতাতে পারেননি। ম্যাচ শেষে হার্দিক বলেন, “আশুতোষ দুর্দান্ত। মাঠে নেমেই ওই ভাবে খেলতে পারা সহজ নয়। প্রায় সব বল ব্যাটের মাঝে খেলেছে ও। আশুতোষ কী করতে চায়, সে ব্যাপারে খুব স্পষ্ট ছিল। এটা আমার ভাল লেগেছে।”
আশুতোষকেও আগেও এমন ইনিংস খেলতে দেখা গিয়েছে। সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতায় খেলতে নেমে যুবরাজ সিংহের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিলেন তিনি। অরুণাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে রেলওয়েজ়ের হয়ে মাত্র ১১ বলে অর্ধশতরান করেছিলেন আশুতোষ। ১টি চার ও ৮টি ছক্কা মারেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১২ বলে ৫৩ রান করে আউট হয়েছিলেন আশুতোষ। ভারতের হয়ে ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১২ বলে অর্ধশতরান করেছিলেন যুবরাজ। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রডকে এক ওভারে ছ’টি ছক্কা মেরেছিলেন যুবরাজ। সেই নজির অবশ্য গড়তে পারেননি আশুতোষ। তবে ভারতীয়দের মধ্যে দ্রুততম অর্ধশতরানের মালিক এখন তিনিই।
২৫ বছরের আশুতোষ আগে মধ্যপ্রদেশের হয়ে খেলতেন। ২০১৯ সালে রাজস্থানের বিরুদ্ধে মাত্র একটি লিস্ট এ ম্যাচ খেলেন তিনি। সুযোগ না পাওয়ায় ২০২৩-২৪ সালে মধ্যপ্রদেশ থেকে রেলওয়েজ় আসেন তিনি। রেলওয়েজ়ের হয়ে ১০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন আশুতোষ। করেছেন ২৮৯ রান। ৩২.৫০ গড়ে রান করেছেন তিনি।
মধ্যপ্রদেশের হয়ে সুযোগ না পাওয়ার জন্য আশুতোষ আঙুল তুলেছিলেন চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতের দিকে। যিনি এখন আইপিএলে কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ। ঘরোয়া ক্রিকেটে মধ্যপ্রদেশের কোচ পণ্ডিত। আশুতোষ তাঁর নাম নেননি। কিন্তু তিনি বলেন, “আমি জিম থেকে সোজা হোটেলে নিজের ঘরে ফিরতাম। ধীরে ধীরে অবসাদে চলে যাচ্ছিলাম। কী ভুল করেছি সেটা কেউ বলছিল না। মধ্যপ্রদেশে নতুন কোচ এসেছিলেন। তাঁর পছন্দ না হলে দলে কেউ সুযোগ পেত না। প্রস্তুতি ম্যাচে আমি ৪৫ বলে ৯০ রান করেছিলাম। তার পরেও আমাকে দলে নেওয়া হয়নি।”
২০২০ থেকে ২০২২ সালের কথা বলেছেন আশুতোষ। তিনি পণ্ডিতের নাম না করলেও ২০২০ সালেই মধ্যপ্রদেশের কোচ হয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত। তাই আশুতোষের নিশানায় যে পণ্ডিতই, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, “সৈয়দ মুস্তাক আলি প্রতিযোগিতায় ছ’টি ম্যাচে আমি তিনটি অর্ধশতরান করেছিলাম। তার পরেও আমাকে মাঠে যেতে বারণ করে দেওয়া হয়। আমি অবসাদে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমার কেরিয়ার শেষ।” তার পরেই অবশ্য রেলওয়েজ়ের হয়ে খেলার প্রস্তাব পান আশুতোষ। তিনি সেখানে চলে যান। সেখানে ভাল খেলায় নিলামে তাঁকে কেনে পঞ্জাব কিংস।
আইপিএলের মিনি নিলামে পঞ্জাব কিংস ২০ লক্ষ টাকায় কিনে নেয় আশুতোষকে। সেই দলে এসে বদলে গিয়েছেন তিনি। আগের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচের পর আশুতোষ নিজেই সে কথা বলছিলেন। তিনি পঞ্জাব দলকে নিজের অর্ধশতরান উৎসর্গ করে বলেন, “আমার এই শতরান দলের মেন্টর সঞ্জয় বাঙ্গারের জন্য। গোটা দলের জন্য আমার এই অর্ধশতরান। পঞ্জাব আমার উপর বিশ্বাস রেখেছে। বাঙ্গার স্যর আমাকে বুঝিয়েছেন যে, আমি স্লগার নই। ক্রিকেটীয় শট খেলি আমি। দলের কোচ, অধিনায়ক আমার উপর বিশ্বাস রেখেছেন। এতেই আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে।”
বৃহস্পতিবার পঞ্জাবকে ম্যাচ জেতাতে না পারলেও একটি স্বপ্ন সত্যি হয়ে গিয়েছে আশুতোষের। বুমরাকে সুইপ করে ছক্কা মারেন তিনি। আশুতোষ বলেন, “আমি ওই শটটা অনুশীলন করছিলাম। বুমরা অন্যতম সেরা বোলার। তার বিরুদ্ধে এই শট খেলা আমার কাছে স্বপ্ন ছিল। সেটাই সত্যি করতে পেরেছি।”
মধ্যপ্রদেশের ছোট্ট শহর রৎলামের বাসিন্দা আশুতোষ। তাঁর ক্রিকেট শুরু ভারতীয় দলের প্রাক্তন সদস্য নমন ওঝাকে দেখে। পরে বাঙ্গারের খেলা দেখে অনুপ্রাণিত হন। ২০১১ সালে আইপিএলের প্রাক্তন ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি কোচি টাস্কার্সের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাঙ্গার। সে বার ক্রিকেট শিক্ষার্থী আশুতোষ ‘বল বয়’-এর দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সেই সুযোগে প্রথম বার বাঙ্গারকে সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয় তাঁর। বাঙ্গারের সঙ্গে ছবি তোলার সুযোগ হাতছাড়া করেননি। যে ছবি এখনও রয়েছে তাঁর মোবাইলে।
‘বল বয়’ হিসাবে নিজের আদর্শের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনের স্মৃতি এখনও টাটকা আশুতোষের। এ বার বাঙ্গারের কাছে প্রশিক্ষণ পাবেন। এটাই সব থেকে আনন্দ দিচ্ছে তাঁকে। আইপিএল শুরুর আগে আশুতোষ বলেছিলেন, ‘‘বাঙ্গার স্যরের সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি এখনও মনে রয়েছে। তখন আমার বয়স ১০ বা ১১। ব্যাটিং নিয়ে পরামর্শ চেয়েছিলাম। এত দিনে আমার স্বপ্ন পূরণ হল। এ বার পঞ্জাবের হয়ে বাঙ্গার স্যরের সামনে খেলার সুযোগ পাব।’’
ক্রিকেটের জন্য আট বছর বয়সে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল আশুতোষকে। রৎলামে প্রশিক্ষণের তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। তাই ইন্ডোরে মধ্যপ্রদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের আবাসিক অ্যাকাডেমিতে আশুতোষকে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা। সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘যখন বাড়ি ছেড়েছিলাম, তখন আমার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল না। একটা ক্রিকেট ক্যাম্পে গিয়ে আম্পায়ারিং করতাম। তাতে দুপুরের খাওয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেত। আমার পরিবারের সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। চাইলেই সব কিছু পেতাম না। ইন্ডোরে আমার সংগ্রামের কথা বাড়িতে জানাতাম না। পরিবারের চিন্তা বৃদ্ধি করতে চাইতাম না।’’
মধ্যপ্রদেশের অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছেন। সে সময় থেকেই নিজের খরচ নিজে চালানোর চেষ্টা করতেন। পরে রেলের হয়ে খেলা শুরু করেন। আশুতোষ ক্রিকেটার হিসাবে প্রথম নজর কাড়েন গত বছর সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে। অরুণাচল প্রদেশের বিরুদ্ধে ১১ বলে অর্ধশতরান করে নজর কাড়েন। ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে যুবরাজ সিংহের দ্রুততম অর্ধশতরানের রেকর্ড ভেঙে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি। ২৫ বছরের ব্যাটার বলেছেন, ‘‘ওই ইনিংসটাই আমার জীবনের সব থেকে স্মরণীয় ঘটনা এখনও পর্যন্ত। পঞ্জাবে সুযোগ পাওয়ার থেকেও বেশি আনন্দের।’’
পঞ্জাব ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি তাঁকে দলে নেওয়ার পরের ঘটনাও ভোলেননি তিনি। আশুতোষ বলেছেন, ‘‘সে দিন বন্ধুদের সঙ্গে ভোর ৫টা পর্যন্ত জেগেছিলাম। ফোনটা বেজেই যাচ্ছিল। একটা সময় বন্ধ হয়ে যায় ফোন। আত্মীয়, পাড়ার সবাই বাজি, মিষ্টি নিয়ে বাড়িতে চলে এসেছিলেন পরের দিন সকালে। আমাদের ছোট শহরটা আমার ছবিতে ভরিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সবাই উৎসবে মেতে উঠেছিলেন আমাকে নিয়ে। ওই আবহ বলে বোঝাতে পারব না। সেই সব দেখে প্রথম মনে পড়েছিল কোচের কথা। মনে হয়েছিল, কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার পেলাম।’’
পুরস্কারের ফল অবশ্যই পেয়েছেন আশুতোষ। এ বারের আইপিএলে একাধিক ম্যাচে নজর কেড়েছেন। পঞ্জাব দলের ভরসা হয়ে উঠেছেন। তবে দলকে জেতাতে পারলে আরও ভাল লাগত তাঁর। দলকে জেতানোর অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। তবে আশুতোষ জানেন, হারজিত খেলার অঙ্গ। বিশ্বাস রাখেন আগামী দিনে পঞ্জাব জিতবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy