প্রতিদ্বন্দ্বী: প্রথম ম্যাচ জিতে আত্মবিশ্বাসী মর্গ্যানদের শিবির। রোহিতদের লক্ষ্য জয়ের ছন্দে ফেরা। ফাইল চিত্র।
কোভিড সংক্রমণকে হার মানিয়ে মাঠে ফেরা এক যোদ্ধা। যাঁর আদর্শ দুই প্রাক্তন বাঁ হাতি— সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং গৌতম গম্ভীর। আইপিএল গ্রহে নিভৃতবাস থেকে বেরিয়ে তাঁর নাইট রাইডার্সকে জেতানো ৫৬ বলে ৮০ এই প্রবল আতঙ্কের সময়ে সাহস জুগিয়ে যাবে। কোভিডকে হারিয়ে জীবনযুদ্ধে জেতার সাহস। তিনি নীতীশ রানা— প্রথম বলেই যে বাউন্ডারিটা হাঁকালেন, তা যেন ভুবনেশ্বর কুমারকে নয়, কোভিড-১৯ নামক দৈত্যকে মারা।
নীতীশের সঙ্গী সংসদে সেই ভয়াবহ জঙ্গি হানা-উত্তর শ্রীনগরে ‘অপারেশন পরাক্রম’-এর সঙ্গে যুক্ত এক কর্নেল পুত্র। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে ব্যাট-বলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে থাকাও যাঁর থেকে ক্রিকেটকে কেড়ে নিতে পারেনি। বাবা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রুপক্ষের পুঁতে রাখা মাইন নিষ্ক্রিয় করতে বেরোতেন আর মায়ের সঙ্গে ছেলে বাড়িতে বসে প্রার্থনা করত, কখন বাবা সুস্থ অবস্থায় ফিরবে! আর কবেই বা শেষ হবে এই অপারেশন। কবে তাঁরা পুণেতে ফিরতে পারবেন আর আগের মতো ক্রিকেট মাঠে ছুটে যেতে পারবেন। তিনি রাহুল ত্রিপাঠী— আমিরশাহিতে গত বার যাঁর দাপট দেখে গ্যালারি থেকে শাহরুখ খান সেই বিখ্যাত সংলাপ আউড়েছিলেন, ‘‘রাহুল, নাম তো শুনাহি হোগা!’’
এক-একটা আইপিএল আসে আর এই নামগুলো তারার মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে ক্রিকেট আকাশে। সারা বছর এদের নাম শোনাও যায় না। ভারতীয় দলের আশেপাশেও চোখে পড়ে না। কিন্তু আইপিএল মানেই যে তা-ই। অনামী, অবহেলিত রত্নদের তুলে আনার আশ্চর্য প্রদীপ! রবিবার যেমন ছিল রাহুল-নীতীশের রাত। সোমবার আছড়ে পড়ল ‘হুডা হারিকেন’। ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে থাকা এক তরুণের ছক্কার ঝড় ডাগআউটে বসে দেখছেন ‘ইউনিভার্স বস্’ ক্রিস গেল, একমাত্র আইপিএলের মঞ্চেই তো এমন শিহরণ জাগানো দৃশ্য দেখা সম্ভব। তখন কে জানত, দীপক হুডা-কে এল রাহুলদের এমন দাপুটে ব্যাটিংও পঞ্জাবকে জয়ের মসৃণ হাইওয়েতে উঠতে দেবে না। কে ভেবেছিল, পাল্টা আগ্রাসন দেখিয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সঞ্জু স্যামসন ম্যাচ টেনে নিয়ে যাবেন শেষ বল পর্যন্ত। তার পর শারজার জাভেদ মিয়াঁদাদ হওয়া আটকে যাবে তাঁর।
নাইটদের যদিও উদ্বোধনী ম্যাচ জয়ের পুষ্পবৃষ্টির মধ্যেই কাঁটায় ঘেরা রাস্তার কথা ভাবতে হচ্ছে। দ্বিতীয় ম্যাচেই যে তারা মুখোমুখি মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের! নিজের শহরের দলের বিরুদ্ধে দ্বৈরথ সব সময় শাহরুখ খানের কাছে সম্মানের, আত্মগর্বের ম্যাচ। আর তাতেই কি না ৬৭ অলআউট-সহ নানা লজ্জা সব সময় অপেক্ষা করে থেকেছে বলিউড বাদশার জন্য। আতঙ্কের সব তথ্য ভেসে ওঠে এই ম্যাচটা এলেই। মোট ২৭ বারের সাক্ষাতে নাইটরা হেরেছে ২১ বার। শেষ ১০ সাক্ষাতে হার ৯টিতে। এ বারে প্রথম ম্যাচ হেরে খেলতে নামছে মুম্বই। প্রথম ম্যাচ জিতে আসছে কলকাতা। কিন্তু তা নিয়েই বা পুলকিত হওয়ার জায়গা কোথায়! ইতিহাস মনে করিয়ে দিচ্ছে, প্রথম ম্যাচ হারা নাকি রোহিতদের জন্য শুভলক্ষণ। ২০১৩ থেকে কখনও প্রথম ম্যাচ জেতেননি তাঁরা এবং গত আট বছরে ট্রফি জিতেছেন পাঁচ বার।
সানরাইজ়ার্স হায়দরাবাদ আর মুম্বই ইন্ডিয়ান্স যে এক নয়, তা বুঝতেও ফেলুদা হওয়ার দরকার পড়ে না। ডেভিড ওয়ার্নারদের কোনও যশপ্রীত বুমরা, ট্রেন্ট বোল্ট ছিল না। যাঁরা নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের উপর ঝোড়ো গতি নিয়ে আছড়ে পড়তে পারে। এর সঙ্গে বিরাট কোহালিদের বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে রাবাডাদের দেশের নতুন পেস-প্রতিভা দীর্ঘকায়, বাঁ হাতি মার্কো জ্যানসেনের। তিন বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে কোহালি যখন জোহানেসবার্গ টেস্ট খেলতে নামছেন, নেট-বোলার ছিলেন জ্যানসেন। কয়েক বার ভারত অধিনায়ককে পরাস্ত করে তাঁর প্রশংসাও কুড়িয়েছিলেন। অনুশীলন শেষে ১৭ বছরের কিশোরের আবদারে হাসিমুখে ছবি তোলেন কোহালি। চতুর্দশ আইপিএলের উদ্বোধনী ম্যাচে বিরাটের দলের বিরুদ্ধে সেই কিশোরের অভিষেক দেখেই মুগ্ধ ক্রিকেটমহল।
কোনও সন্দেহ নেই, নাইট ব্যাটসম্যানদের অনেক কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলবে মুম্বই এক্সপ্রেস। হায়দরাবাদ বোলিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁঝ, অনেক বেশি আগুন নিয়ে উপস্থিত হবে। গত বার করোনা অতিমারির মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতেও বডিলাইন বোলিংয়ে আন্দ্রে রাসেলদের বোতলবন্দি করে ফেলেছিল মুম্বই। চেন্নাইয়ের বাইশ গজ গতির সওদাগরদের প্রিয় বিচরণ ক্ষেত্র না হলেও বুমরাদের বডিলাইন রণনীতিতে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অভিজ্ঞতা না থাকা নীতীশ-রাহুলদের পরীক্ষায় ফেলার সেরা হাতিয়ার শরীর তাক করা বোলিং। রাসেল থেকে অইন মর্গ্যান— প্রত্যেকের দুর্বলতা রয়েছে শর্ট পিচ্ড বোলিংয়ে। আর সুনীল গাওস্করের কথা মানলে, ‘‘শরীর বা মাথা তাক করা বাউন্সার কোন ব্যাটসম্যানই বা কবে পছন্দ করেছে!’’
শুভমন গিলের ভূমিকা এই কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে, যে-হেতু গত কয়েক মাস ভারতীয় দলের ওপেনার হিসেবে এই উচ্চ গতিসম্পন্ন, বাউন্স ভরা আন্তর্জাতিক মানের বোলিংয়ের গ্রহে তিনি ঘোরাফেরা করেছেন। গিলের টেকনিকের পরীক্ষা নেবে বুমরা-বোল্ট জুটি।
মুম্বইয়ের ব্যাটিংও সানরাইজ়ার্সের মতো দু’তিন জনের উপর নির্ভরশীল নয়। রোহিত তো আছেনই। কেকেআরের বিরুদ্ধে তাঁর রেকর্ড? আর ৬১ রান করলেই এক হাজার রান হয়ে যাবে নাইটদের বিরুদ্ধে। একটি দলের বিরুদ্ধে হাজার রান আইপিএলে কোনও ব্যাটসম্যানের নেই। সঙ্গে নিভৃতবাস কাটিয়ে দলের ফেরার জন্য তৈরি কুইন্টন ডি’কক। পাওয়ার প্লে-তে দারুণ সফল ব্যাটসম্যান ডি’কক। মাঝের দিকে কায়রন পোলার্ড, হার্দিক পাণ্ড্যের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি। যে কোনও বোলারকে দুঃস্বপ্ন উপহার দিতে পারে পোলার্ড-পাণ্ড্য জুটি।
ম্যাচটা আরও আকর্ষণীয় মোড়ক পাচ্ছে দু’দলের তরুণ প্রজন্মের জন্য। নাইটদের ব্যাটিংয়ে নীতীশ-রাহুলের সঙ্গে বোলিংয়ে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ, বরুণ চক্রবর্তী আছেন। মুম্বইয়ের তেমনই রয়েছেন সূর্যকুমার যাদব, ঈশান কিশান, ক্রুণাল পাণ্ড্যরা। সদ্য ভারতীয় দলের জার্সিতে যাঁরা স্বপ্নের অভিষেক ঘটিয়ে টগবগ করছেন।
আতঙ্কের ইতিহাসের মধ্যেও নাইটদের স্বস্তি দেবে অইন মর্গ্যানের নেতৃত্ব। ইংল্যান্ডের দায়িত্ব নিয়ে অতি আগ্রাসী ব্যাটিং-নীতি এনে বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন মর্গ্যান। যে বিপ্লবের জোয়ারে ২০১৯ বিশ্বকাপ জেতেন জস বাটলার, বেন স্টোকসরা। কী সেই নীতি? না, মারার বল পেলে মারব, পরিস্থিতির চাপে পড়ে খোলসে ঢুকে ঠুক-ঠুক করব না। রবিবার নীতীশ রানা, রাহুল ত্রিপাঠীদের ভয়ডরহীন ব্যাটিং দেখে পরিষ্কার, নাইট সংসারেও এই খোলামেলা, আগ্রাসী মনোভাবের সিংহদুয়ার খুলে দিতে চাইছেন ক্যাপ্টেন মর্গ্যান।
প্রথম ম্যাচটা দেখে অন্তত মনে হয়েছে, এটা নতুন অধিনায়কের অধীনে নতুন করে শুরু করতে চাওয়া নাইট রাইডার্স। যারা সুনীল নারাইনের মতো তারকাকে বসিয়ে ছন্দে থাকা শাকিব-আল-হাসানকে নামিয়ে দিতে ভয় পায় না। হরভজন সিংহের হাতে নতুন বল তুলে দিতে হাত কাঁপে না। ধোনিদের দুর্গে স্পিন-সহায়ক পিচ থাকলে শাকিব-হরভজন জুটি ভেল্কি দেখাবে না, কে বলতে পারে!
আবার মনে পড়ে যাচ্ছে, পুরনো সেই ক্রিকেট প্রবাদ। ‘অধিনায়ক, তুমি ততটাই ভাল, যতটা ভাল তোমার দল’! ক্যাপ্টেন মর্গ্যান, প্রথম ম্যাচ দারুণ জিতলেও আপনার আসল পরীক্ষা তাই চেন্নাইয়ের মাঠে মঙ্গলবার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy