বিধ্বংসী: সঞ্জু ওড়াচ্ছেন, ধোনি দেখছেন। মঙ্গলবার শারজায় ৩২ বলে ৭৪ করার পথে জয়ের নায়ক। আইপিএল
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সামনেই কি উদয় ঘটল তাঁর এক উত্তরসূরির? নাকি প্রতিভাবান হয়েও ভারতীয় দলের সিংহদুয়ার এখনও সেই বন্ধই থেকে যাবে সঞ্জু স্যামসনের সামনে?
৯ ছক্কা-সহ ৩২ বলে ৭৪। স্যামসন সাইক্লোনে রাজস্থান রয়্যালস ১৬ রানে চেন্নাই সুপার কিংসকে হারাল বললে কিছুই বলা হয় না। আসলে দুরমুশ করল। এত বিধ্বস্ত, এত কাঁধ ঝুলে যাওয়া অবস্থায় সাধারণত দেখা যায় না ধোনির হলুদ জার্সিধারীদের। রানের তফাতে ১৬। প্রভাবের দিক থেকে মনে হচ্ছিল, ১১৬ রানে হার।
সঞ্জু স্যামসন কিন্তু ছিলেন। না হলে ধোনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার সময় থেকে তাঁর নাম শোনা যাবে কেন? চার বছর আগেই ধোনির উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর কথা আলোচিত হয়েছিল। জাতীয় নির্বাচক কমিটির প্রধান তখন সন্দীপ পাটিল। তিরুঅনন্তপুরমের উত্তেজক প্রতিভাকে দেখে মনে ধরেছিল পাটিলের। ভেবেছিলেন, এই ছেলেটি সাদা বলের ক্রিকেটে ভবিষ্যৎ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে ভাবা যেতে পারে। স্যামসনকে ডেকে তিনি বলেওছিলেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য তৈরি হও।
সেটা ছিল ২০১৬। এটা ২০২০। ‘কভি আজনবি থে’-র নায়কের চোখে পড়া প্রতিভা আজও ভারতীয় ক্রিকেটে ‘আজনবি’। হাতে গোনা কয়েকটা ম্যাচ তাঁর দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়েছে দুয়োরানির সন্তানের মতো। শারজায় ভারতীয় ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তন লগ্নকে স্ট্রোকের রংমশালে সাজিয়ে তুললেন মালয়লি যুবক। তাঁর ছক্কাবৃষ্টি দেখিয়ে দিয়ে গেল, বাহুবলী না হয়েও টি-টোয়েন্টির শক্তিমান ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায়। মনে করিয়ে দিল, আইপিএল যুগেও টাইমিং সম্পদ। দুর্ধর্ষ শর্ট আর্ম পুল মারলেন। রবীন্দ্র জাডেজাকে এমন ভাবে পর-পর দু’বলে ছক্কা মারলেন যেন প্র্যাক্টিস বোলার। যে পীযূষ চাওলা মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে ছিলেন ধোনির তুরুপের তাস, তাঁকে ব্যাট দিয়ে যেন থাপ্পড় মারলেন। একস্ট্রা কভারের উপর দিয়ে উড়ে গেল ছয়। হাফ সেঞ্চুরি মাত্র ১৯ বলে। স্ট্রাইক রেট ২৩১-এর উপর। ক্রিস গেল, আন্দ্রে রাসেলের মতো পাওয়ারহিটারকেও গর্বিত করবে।
আরও পড়ুন: কেন আরও আগে ব্যাট করতে নামলেন না? ধোনি বললেন...
কে বলবে, এই ছেলেকেই দিল্লি ক্রিকেটের দুর্নীতি ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। ট্রায়ালে ভাল করেও সুযোগ জোটেনি। কোথাও একটা বঞ্চিতের কপাল যেন বরাবর সঙ্গী হয়েছে স্যামসনের। কী বয়সভিত্তিক বিভাগে, কী জাতীয় দলে! তাঁর বাবা বিশ্বনাথ স্যামসন কাজ করতেন দিল্লি পুলিশে। ছেলেকে কড়া অনুশাসনে তৈরি করেছেন ছোটবেলা থেকে। রমাকান্ত আচরেকর স্যর যেমন সচিন তেন্ডুলকরকে বকুনি দিতেন সেঞ্চুরি করেও উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার জন্য, তেমনই সঞ্জুর জন্য শাস্তি বরাদ্দ রাখতেন তাঁর বাবা। বাজে শটে আউট হলেই ক্লাবের মাঠ থেকে বাড়ি— দীর্ঘ পথ হেঁটে ফিরতে হবে। বড় আশা করেছিলেন, দিল্লি দরবারে ক্রিকেটার হিসেবে পুত্রকে প্রতিষ্ঠা করবেন। কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, প্রভাব খাটিয়ে অন্যদের ছেলেরা ঢুকে পড়ছে বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতায়। বিশ্বনাথ আর ঝুঁকি নিতে চাননি। নিজে চাকরি ছেড়ে আসতে পারেননি। কিন্তু দেরি না করে ছেলেকে পাঠিয়ে দেন তিরুঅনন্তপুরমের বাড়িতে। কেরলের ‘ব্যাকওয়াটার্স’ থেকেই শুরু হয় স্যামসনের ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই। মঙ্গলবার শারজার স্টেডিয়ামে তাঁর ছক্কা দেখে মুগ্ধ স্টিভ স্মিথও ঠোঁট ওল্টালেন। আর কোথাও যেন জিতছিল সিনিয়র স্যামসনের লড়াই।
রাজস্থান রয়্যালসের ইনিংসকে টানলেন দুই ‘এস এস’— সঞ্জু স্যামসন এবং স্টিভ স্মিথ। দু’জনের জুটি যেন আগুন আর জলের। মাথার চোট নিয়ে বিব্রত থাকা স্মিথ ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজে খেলতে পারেননি। এ দিন মাঠে ফিরে করলেন ৪৭ বলে ৬৯। এমন একটা সময়ে যখন দুই প্রধান বিদেশি বেন স্টোকস এবং জস বাটলার না থাকায় রয়্যালসকে খুব একটা দরই দেয়নি অনেকে। নিরঙ্কুশ ফেভারিট ধরা হয়েছিল ধোনির সিএসকে-কে। আবারও বোঝা গেল, ক্রিকেট কেন মহান অনিশ্চয়তার খেলা!
দ্বিতীয় উইকেটে দুই ‘এস এস’ যোগ করলেন ১২১ রান। এর সঙ্গে জফ্রা আর্চারের ৮ বলে ২৭। দক্ষিণ আফ্রিকার পেসার লুনগি এনগিডির শেষ ওভারে চারটে ছক্কা মেরে এমন মরুঝড় তুলেছিলেন আর্চার যে, মনে হচ্ছিল, যুবরাজ সিংহের ছয় ছক্কার রেকর্ড নিয়ে না টানাটানি পড়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চার ছক্কাতেই থামলেন। স্যামসন, স্মিথ, আর্চার মিলে ১৭টি ছক্কা মারলেন। তাতেই ধরাশায়ী চেন্নাই সুপার কিংস। ২১৬-৭ তাড়া করতে নেমে কখনওই মনে হয়নি, সিএসকে পারবে। নতুন তর্কের ইন্ধন দিয়ে গেল ধোনির ব্যাটিং অর্ডার। সাত নম্বরে নেমে কি ঠিক করছেন তিনি? শেষ ওভারে তিনটি ছক্কা মারলেও তখন যে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিতই হয়ে গিয়েছিল, কারও চোখ এড়াচ্ছে না।
নব্বইয়ের দশকে শারজা স্মরণীয় সব দৃশ্য উপহার দিয়েছে। ভিআইপি বক্সে কোথাও কপূর পরিবার। কোথাও শর্মিলা ঠাকুর। কোথাও লতা মঙ্গেশকর। আবার কোথাও বা ফিরোজ খান। মাঠের মধ্যেও কী সব মুহূর্ত! মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কা। মরুঝড়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সচিন তেন্ডুলকরের অমর ইনিংস! যাঁর নামকরণই হয়ে গিয়েছে ‘ডেজার্ট স্টর্ম’।
আসিফ ইকবালদের তৈরি করা মরুশহরের ক্রিকেট সাম্রাজ্যে মঙ্গলবার রাতে আর একটি স্মরণীয় ছবি ধরা থাকল। ছাব্বিশ বছর ছুঁইছুঁই সঞ্জু ছক্কাবৃষ্টি ঘটাচ্ছেন আর উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে তা দেখছেন উনচল্লিশের ধোনি। দীর্ঘ দিন আলোকিত করে রাখা কিংবদন্তি ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছেন অস্তাচলে। উদয় ঘটছে নতুন সূর্যের।
এ বার কি সঞ্জু স্যামসনকে নিয়ে আলোচনা হতে পারে? জাতীয় নির্বাচকেরা শুনতে পাচ্ছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy