প্রত্যাবর্তন: ফের ব্যাট হাতে মাঠে ধোনি। জিতেই শুরু করলেন। ছবি: পিটিআই।
কোভিড আক্রান্ত এক ক্রিকেটার ছুটে আসছেন প্রথম বলটা করতে। এর চেয়ে গায়ে কাঁটা দেওয়া শুরু আর কোনও আইপিএলে কখনও হয়েছে? তিনি দীপক চাহার— ম্যাচের মধ্যে এক বার পায়ের ফাঁক দিয়ে বল গলিয়েছেন। কিন্তু এমন দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়ার দিনে ওই মিসফিল্ডটুকুর জন্য তাঁকে ক্ষমা না করে উপায় কী!
স্কোরবোর্ড দেখাবে, চাহারের বোলিং হিসাব ৪-০-৩২-২। কুড়ি ওভারের ক্রিকেট অনুযায়ী, বেশ ভালই। যেটা দেখাবে না, তা হচ্ছে, কোভিডের ছোবল থেকে বেরিয়ে এসে আইপিএলের প্রথম দিনেই বীরদর্পে মাঠে নেমে পড়া ক্রিকেটার তিনি। টুর্নামেন্টের প্রথম বলটাই বেরিয়ে এল যাঁর হাত থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থাকুক না থাকুক, উদ্বোধনী ওভারটাই তো কোটি, কোটি ক্রিকেট জনতাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল!
সেই সঙ্গে আইপিএলের সেই চিরন্তন রুদ্ধশ্বাস লড়াই। শেষ না হওয়া পর্যন্ত হবে না শেষ। যেন চার ঘণ্টার কোনও সাসপেন্স থ্রিলার। প্রায় চোদ্দো মাস পরে মাঠে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। সেই শান্ত, ধীরস্থির ক্যাপ্টেন কুল। চমকে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিলেন রান তাড়া করার সময়। বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ‘ফিনিশার’ নিজে না এসে একের পর এক পাঠাতে থাকলেন অন্যদের। প্রথমে রবীন্দ্র জাডেজা, তার পরে স্যাম কারেন। বিশেষ করে ৬ বলে ১৮ করে কারেন ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়ে গেলেন। আর ডাগআউটে বসা ধোনিকে দেখে মনে হচ্ছিল, মাস্টার বিদায়বেলায় তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন ছাত্রদের।
অবশেষে ব্যাট হাতে দেখা গেল তাঁকে। সাত নম্বরে নেমে দু’বল খেলে শূন্য নট আউট। যশপ্রীত বুমরার বলে কট বিহাইন্ড প্রায় হয়েই গিয়েছিলেন। মুম্বইয়ের সকলে নিশ্চিত তিনি আউট। আম্পায়ার আউট দিয়েছেন। ধোনি ডিআরএস চাইলেন এবং নট আউট। চোদ্দো মাস ক্রিকেটের বাইরে তো কী, এখনও ডিআরএস মানে ধোনি রিভিউ সিস্টেম। কিছু কিছু জিনিস পাল্টায় না। অতিমারি, মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার যতই জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠুক, পাল্টায় না।
রোহিত শর্মা, কুইন্টন ডি’কক এমন ভাবে শুরু করেছিলেন যে, ছ’মাস ক্রিকেট লকডাউনে ছিলেন, কে বলবে! মনে হচ্ছিল, ড্রয়িংরুমেই বাইশ গজ আছে আর সেখানে বিশ্বের সেরা সব বোলারদের খেলছিলেন। যখন রোলস রয়েসের মতো ছুটছে মুম্বইয়ের ওপেনিং জুটি, ক্যাপ্টেন কুলের প্রবেশ। আচমকা বল তুলে দিলেন পীযূষ চাওলার হাতে। ভারত অধিনায়ক থাকার সময়ে এই পীযূষকে সমর্থন করে যাওয়ার জন্য বহু বার নির্বাচকদের সঙ্গে এসপার-ওসপার হয়েছে ধোনির। কিন্তু তাঁর আস্থা টলেনি এখনও। ছ’কোটির উপর দাম দিয়ে মূলস্রোত থেকে হারিয়ে যাওয়া লেগস্পিনার পীযূষকে চেন্নাইয়ে আনিয়েছেন ধোনি। আর কেকেআরের প্রাক্তন স্পিনারই এ দিন রোহিতকে আউট করে গুরুদক্ষিণা দিলেন।
আইপিএল বরাবরই এমন ব্রাত্য সৈনিকদের ফুঁসে ওঠার মঞ্চ। চাওলার মতোই যেমন মুম্বই ইনিংসকে টানলেন হারিয়ে যাওয়া আর এক ঘরোয়া ব্যাটসম্যান সৌরভ তিওয়ারি। মুম্বইয়ের হয়ে সর্বোচ্চ রান (৩১ বলে ৪২) করে গেলেন তিনিই। তেমনই ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার নিয়ে গেলেন আর এক বাতিল ঘোড়া— অম্বাতি রায়ডু। বিশ্বকাপের দলে শেষ মুহূর্তে নির্বাচকেরা তাঁকে বাদ দিয়ে বিজয় শঙ্করকে নিয়েছিলেন। নির্বাচক-প্রধান বিবৃতি দিয়েছিলেন, ‘‘বিজয় শঙ্কর থ্রি ডাইমেনশনাল ক্রিকেটার।’’ যার প্রতিক্রিয়ায় রায়ডুর সেই অমর উক্তি। ‘‘থ্রি ডি চশমা কিনেছি বিশ্বকাপ দেখব বলে।’’ দর্শকশূন্য স্টেডিয়াম যতই হোক, টিভির সামনে বসা অসংখ্য ক্রিকেট পিপাসু তো দেখে নিতে পারল, তিনি— অম্বাতি রায়ডু অন্যায় কিছু বলেননি। ৪৮ বলে তিনটি ছক্কা-সহ ৭১ তো আজ আবার সেই প্রশ্নটা তুলে দিল— রায়ডুর জায়গায় বিজয় শঙ্কর?
কারও কারও কি মনে পড়ে যাচ্ছিল আইপিএলের উদ্বোধনী বছরের উদ্বোধনী ম্যাচ? ব্রেন্ডন ম্যাকালামের ঝড় দিয়ে সে দিন শুভমহরৎ ঘটেছিল আইপিএল নামক চকমকি পাথরের। মাঠে সৌরভ, দ্রাবিড়, ম্যাকালামরা। আর গ্যালারিতে বলিউড বাদশা শাহরুখ খান। মাঠের আর পরদার নায়কদের নানা রং মিশে অভাবনীয় এক রামধনু তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু তখন যে ছিল না কোভিড-১৯ নামে কোনও ভয়ঙ্কর শত্রু। রোহিত শর্মাকে দেখে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি পিছিয়ে গিয়ে দূরত্ববিধি মেনে টস করতেন না। যশপ্রীত বুমরাদের কেউ বলে দেয়নি, থুতু বা লালা ব্যবহার নিষিদ্ধ। কে জানে, কখন নিজের অজান্তে তোমার হাতে উঠে এসেছে অদৃশ্য শত্রুর মারণ-স্পর্শ! খোলামেলা জীবনে পরানো ছিল না ভয়ের বেড়ি।
শনিবার রাতে মোগল স্থাপত্যের মতো মোহময়ী আবু ধাবির ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ত্রয়োদশ আইপিএলের প্রথম ম্যাচ টিভিতে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ধোনিদের জয়টা শুধু চেন্নাই সুপার কিংসের জয় নয়। গোটা আইপিএলের জয়। ফ্যাফ ডুপ্লেসি নামেই হলুদ জার্সিতে উইনিং শট নিলেন। আসলে উইনিং শট ক্রিকেটের। বা বাউন্ডারি লাইনে দাঁড়িয়ে ফ্যাফের দু’টো ক্যাচ। যেন ক্রিকেট নয়, ট্র্যাপিজের খেলা। দীপক চাহারকে তেমনই সকলে মনে রাখবে দু’টো উইকেট দিয়ে নয়, কোভিড-আক্রান্ত হয়েও টুর্নামেন্টকে সাহস দেওয়ার জন্য। এই দিনটায় অন্তত ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যানের চেয়ে জীবনের লড়াইকে গুরুত্ব দিলেন না ম্যান অফ দ্য ম্যাচের নির্বাচকেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy