Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

মাসলম্যান ‘বোল্ড’ নিজের দলের গুগলিতে

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মাঠের  বিরতলম দৃশ্য। আন্দ্রে ‘বাহুবলী’ রাসেল অন্য কারও ব্যাট হাতে নিয়ে সম্ভ্রমের চোখে উল্টেপাল্টে দেখছেন! রবিবারের হায়দরাবাদে সেই ছবিই তো টিভির পর্দায় ভেসে উঠল।

বিপন্ন: দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আন্দ্রে রাসেল নাইটদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছেন। আইপিএল

বিপন্ন: দুর্দান্ত ফর্মে থাকা আন্দ্রে রাসেল নাইটদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হচ্ছেন। আইপিএল

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৪৭
Share: Save:

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মাঠের বিরতলম দৃশ্য। আন্দ্রে ‘বাহুবলী’ রাসেল অন্য কারও ব্যাট হাতে নিয়ে সম্ভ্রমের চোখে উল্টেপাল্টে দেখছেন!
রবিবারের হায়দরাবাদে সেই ছবিই তো টিভির পর্দায় ভেসে উঠল।

ম্যাচ শেষে দেখা গেল রাসেল প্রতিপক্ষ ওপেনারের ব্যাটটা হাতে নিয়ে টিপে টিপে পরখ করছেন। ঠিক যে ভাবে প্রত্যেক ম্যাচের শেষে এত দিন প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারেরা এসে তাঁর মাসল টিপে টিপে দেখছিলেন।
কে সেই প্রতিপক্ষ ক্রিকেটার? না, জনি বেয়ারস্টো। আইপিএলে এই ম্যাচের কেউ যদি পূর্বাভাস করত, বেয়ারস্টো বল উড়িয়ে গ্যালারিতে ফেলে জেতাবেন আর পরাভূত রাসেল বিষণ্ণ দর্শকের মতো হাততালি দেবেন, তাকে নির্ঘাত উন্মাদ আখ্যা দিয়ে দেওয়া হত।

আরও পড়ুন: দল নির্বাচন না মানসিকতা, ঠিক কোন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে প্রায় ছিটকে যাওয়া নাইটদের

ইয়র্কশায়ার ব্যাটিং বলতে এত দিন ছিল লেন হাটন, হারবার্ট সাটক্লিফ, জেফ বয়কট, জো রুট। সনাতনী ক্রিকেট। ব্যাকরণ মেনে চলা ক্রিকেট। এমনই গোঁড়া আর রক্ষণশীল যে, কাউন্টিতেও বাইরের ক্রিকেটার কদাচিত খেলাত তারা। সচিন তেন্ডুলকরের মতো বিস্ময় বালকের ক্ষেত্রে শুধু ব্যতিক্রম করতে রাজি হয়েছিল তারা। কে জানত, বরাবর ক্রিকেটের গ্রামার-বুক মেনে চলা ইয়র্কশায়ার এক দিন এমন বিধ্বংসী টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যানও উৎপন্ন করে দেখাবে! আর তাঁর ব্যাট হাত নিয়ে ঠোঁট ওল্টাতে হবে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সেরা পাওয়ারহিটারকে!

বেয়ারস্টো আর ডেভিড ওয়ার্নারের দাপটে হায়দরাবাদের একপেশে জয়ের ময়নাতদন্ত করতে বসে তবু মনে হচ্ছে, এর মধ্যে ক্রিকেটের মহান অনিশ্চয়তার উপাদান কম। আত্মঘাতী বিষক্রিয়া বেশি। ইডেনে খেলা হলে ডিজে দিব্যি বাজিয়ে দিতে পারতেন ‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’।

না হলে ইডেনে বিরাট কোহালিদের বিরুদ্ধে ম্যাচের পরে রাসেল নিজে অমন ঝাঁঝালো গলায় ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে গেলেন! ঘরভর্তি সাংবাদিকদের সামনে বলে গেলেন, তিনি চার নম্বরে নামতে চেয়েছিলেন। দল পরিচালকেরা শুনতে চায়নি। ইডেনে কোহালিয়ানার সেই রাতে আর একটি ছক্কা মারতে পারলেই তো রাসেল জিতিয়ে দেন নাইটদের। সেই সুযোগ তাঁকে দেয়নি তাঁর দলই।
ইডেনে সেই রাতে ভুল করেছিল নাইট রাইডার্স। এ দিন কেলেঙ্কারি ঘটাল হায়দরাবাদের মাঠে। বিস্মিত চোখে ক্রিকেট দুনিয়া দেখল, রাসেলকে পিছোতে পিছোতে নামানো হল ১৬তম ওভারে। তাঁর আগে ব্যাট করে গেলেন দুই ওপেনার ক্রিস লিন এবং সুনীল নারাইন, শুভমন গিল, নীতিশ রানা, দীনেশ কার্তিক, এমনকি, রিঙ্কু সিংহ!

তাঁকে যে আগে নামানো উচিত, তা বোঝার জন্য তো ফেলুদা, ব্যোমকেশ হওয়ার দরকার লাগে না। সাধারণ ক্রিকেট জ্ঞানই তো বলে দেবে, দলের ফর্মে থাকা, বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানকে যত বেশি সম্ভব বল খেলতে দেব। সেখানে কেকেআর রাসেলকে ফেলে রাখল শেষ সাড়ে তিন ওভার বোলারদের সঙ্গে ব্যাট করার জন্য। নবম ওভারে কার্তিক যখন আউট হলেন, তখন থেকে সকলে ভাবছিলেন এ বার রাসেলকে নামানো হবে। কোথায় কী!

দেখেশুনে মনে হচ্ছে, নাইট ম্যানেজমেন্টের মাথায় শুধু এই হিসাবই ঘুরছে যে, কত ওভার বা কত বল বাকি থাকতে রাসেলকে নামানো উচিত। মেরেকেটে ৪০-৪৫ বলই তাঁকে দেওয়া হবে। সেটা করতে গিয়ে রাসেলের হাতে জেতানোর রান তোলার মতো যথেষ্ট বলই পড়ে থাকছে না। একে তো এসেই তাঁকে চালাতে হচ্ছে। ক্রিজে থিতু হওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত নেই। দ্বিতীয়ত, মাত্রাতিরিক্ত ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে কারণ টিমের পাল্‌স রেট এত নেমে যাচ্ছে তখন যে, সব বলেই ছক্কা মারতে হবে তাঁকে। একটা মিসটাইম মানেই তো শেষ। এ দিন যেমন হল।
টি-টোয়েন্টি ম্যাচে একটা দল হাতে পায় ১২০ বল। মনে হচ্ছে, নাইট রাইডার্স তাদের সেরা ক্রিকেটারকে বলে দিয়েছে, ভাই, তোমার জন্য ২০ বলই বরাদ্দ। তার বেশি পাবে না। তার মধ্যে যা করার করো। যেন বার্সেলোনা বলে দিচ্ছে লিয়োনেল মেসিকে, তুমি তো ৬ মিনিটেই তিন গোল করতে পারো। তাই ৯০ মিনিটের ফুটবল ম্যাচে তোমাকে চাই শুধু শেষ ৬ মিনিট!

চলতি আইপিএলে সব দলের কাছে সব চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম আন্দ্রে রাসেল। সকলের টিম মিটিংয়ে বেশি সময় ব্যয় হচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য যে, রাসেল-রথ কী করে থামানো যায়? রবিবারের পরে সকলে উত্তর পেয়ে গিয়েছে— নিজেরা না ভেবে তারা রাসেলের টিমের উপরেই ছেড়ে দিক। কেকেআর-ই তো প্রতিপক্ষের কাজটা সহজ করে দিয়েছে। তাদের সেরা ম্যাচউইনারকে প্যাড-গ্লাভস পরিয়ে ডাগআউটে বসিয়ে রেখে।

শাহরুখ খানের দলে এই মুহূর্তে যাঁরা প্রধান মস্তিষ্ক, কখনও তাঁদের দুর্ধর্ষ মগজের জন্য খুব সুনাম ছিল না। যেমন কোচ জাক কালিস। ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হতে পারেন। দুর্দান্ত সব ক্রিকেট কীর্তি। কিন্তু কখনও দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁকে পাকাপাকি ভাবে জাতীয় দলের অধিনায়ক হওয়ার উপযুক্ত মনে করেনি। অধিনায়ক দীনেশ কার্তিকও দুর্দান্ত ক্রিকেট মস্তিষ্কের জন্য কখনও শিরোনামে আসেননি। মাঠের মধ্যে বা ডাগআউটে তাঁর শরীরী ভাষাও ভীষণ ভাবে ন্যাতানো।

টি-টোয়েন্টি মানেই অভিনবত্ব। যেমন দেখালেন রশিদ খান। বাঁ-হাতি পীযূষ চাওলাকে পাঁচ বলে পাঁচটিই করলেন গুগলি। পীযূষ কূলকিনারাই পেলেন না। আর রাসেল নন-স্ট্রাইক এন্ডে আটকে রইলেন। এক বাঁধা গঁতে বাজিমাত করতে চাইছে কার্তিকের কেকেআর। সেই সুনীল নারাইনকে দিয়ে ব্যাটিং ওপেন করিয়েই চলেছে। বরুণ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে এক ওভারে ২৫ রান বা কে গৌতমের এক ওভারে ২২ নেওয়ার মতো তাৎক্ষণিক উত্তেজনা তৈরি করা ছাড়া সত্যিই কি পিঞ্চহিটারের কাজ করতে পারছেন নারাইন? পারলে তাঁর ব্যাটিং গড় ১৮.৮৫ হত না।
বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর থেকেই ধার হারিয়েছেন স্পিনার নারাইনও। দু’বছর আগেও তাঁর ইকনমি রেট (ওভার প্রতি রান দেওয়ার হিসাব) থাকত সাড়ে ছয়ের নীচে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আন্দাজে দারুণ কৃপণ বোলিং। এখন তাঁর ইকনমি রেট প্রায় আটের কাছে। বাকি স্পিনাররাও রক্তাল্পতায় ভুগছেন। প্রায় প্রত্যেক ম্যাচে স্লগ ওভার বোলিং ভুগিয়েছে। একমাত্র দিল্লি ক্যাপিটালসের বিরুদ্ধে প্রসিদ্ধ কৃষ্ণের সুপার ওভারে ১১ রান দেওয়া বাদ দিলে স্লগ ওভার বোলিংয়ের অবস্থা শোচনীয়। রোগী শুয়ে কাতরাচ্ছে। রোগ নির্ণয় করতে বিলেত ফেরত ডাক্তার হওয়ারও দরকার নেই। ইঞ্জেকশন দেওয়ার কেউ নেই। সব রোগ সারিয়ে দিতে পারত যে ‘রাসেল অ্যান্টিবায়োটিক’, তাকেও ফেলে রাখব বাক্সবন্দি করে! সুস্থ শরীর আইসিসিইউ-তে যাওয়া আটকাবে, কার সাধ্যি!

অন্য বিষয়গুলি:

IPL 2019 KKR Kolkata Knight Riders Andre Russell
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy