অগ্নিগর্ভ: অধিনায়ক কার্তিককে নিয়ে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ রাসেলের।
শোনা যায় শাহরুখ খান খুব আবেগ নিয়ে দলের স্লোগান তৈরি করেন। তাতে আর কিছু থাকুক না থাকুর, লড়াইয়ের মন্ত্র থাকবেই।
আইপিএল শুরুর লগ্নে যেমন তিনি নিজে ঠিক করে দিয়েছিলেন, টিমের স্লোগান হবে ‘করব, লড়ব, জিতব রে’। এ বারও শাহরুখ কেকেআরের স্লোগান তৈরির সময় লড়াইয়ের ডাক দিয়েছিলেন। ‘আখরি দম তক, আখরি রান তক’— এর মধ্যেও ‘চক দে ইন্ডিয়া’র কবির খানের মতো লড়াই করার ডাক।
আর বরাবরের মতো মুম্বইয়ে নিজের বাড়িতে বসেই বলিউডের বাদশাকে দেখতে হল, লড়াই ছাড়া আত্মসমর্পণ করে এল তাঁর দল। একে তো মুম্বইয়ে হতশ্রী রেকর্ড নাইটদের। আইপিএলের দ্বাদশ বছরের ইতিহাসে মাত্র এক বারই জিততে পেরেছে তাঁর দল। আর সে বারই অধরা জয়ের উত্তেজনায় মাঠে নেমে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে পাঁচ বছরের জন্য ওয়াংখেড়ে থেকে নির্বাসিত হন তিনি। সেই শাস্তি শেষ হয়ে গেলেও শেষ হয়নি মুম্বইয়ে তাঁর দলের দুর্দশা।
এক দিক দিয়ে দেখতে গেলে কেকেআর মালিক এমনিতে জয়-হার নিয়ে খেলোয়াড়ি মনোভাবকে কখনও নষ্ট হতে দেন না। প্রতিপক্ষকে অভিনন্দন জানাতে ভোলেন না, ম্যাচের সেরা তাঁর দলকে হারিয়ে দিয়ে গেলেও তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। তা বলে ভাবার কোনও কারণ নেই যে, গ্রুপ পর্ব থেকে এমন লজ্জার বিদায় তাঁকে খুব প্রসন্ন করেছে। অতীতে ম্যাচ হারলে এমনকি, অধিনায়ককে সরাসরি কড়া বার্তা পাঠাতেও ভোলেননি তিনি। তাই মুম্বইয়ে ম্যাচের পরে মালিকের সঙ্গে দীনেশ কার্তিকদের সাক্ষাৎ এ বারও খুব মধুর হওয়ার সম্ভাবনা কম। একটা নমুনা চোখের সামনেই রয়েছে। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে হারের পরে একটি টুইটও করেননি তিনি।
এই মুহূর্তে শাহরুখের অবশ্য নিজের রাগ বা যন্ত্রণাকেও ছাপিয়ে যাচ্ছে দল নিয়ে উদ্বেগ। নাইট রাইডার্স কোনও কালেই খুব সুখের সংসার ছিল না। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন অধিনায়ক, কোচ জন বুকাননের সঙ্গে বনিবনা হয়নি। অধিনায়ক এবং মালিকের মধ্যেও মতপার্থক্যের কাহিনি গোপন থাকেনি। তিন বছর ট্রফিহীন থাকার পরে নিলামে সৌরভকে উপেক্ষা করে গৌতম গম্ভীরকে অধিনায়ক করে আনা হয়। কিন্তু দু’বার আইপিএল জেতানো গম্ভীরকেও ছেঁটে ফেলতে দ্বিধা করেনি কেকেআর। কিন্তু এ বারের মতো নাইট সংসার টুকরো-টুকরো হওয়ার লক্ষণ এত প্রকট ভাবে কখনও দেখা যায়নি। নমুনা? মাঠেই অধিনায়ক কার্তিকের সঙ্গে লেগে যাচ্ছে সুনীল নারাইনের। প্রকাশ্য সাংবাদিক বৈঠকে এসে আন্দ্রে রাসেল ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন অধিনায়কের বিরুদ্ধে। টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে আর কোনও সন্দেহই থাকছে না যে, দলের মধ্যে সমর্থন হারিয়েছেন অধিনায়ক কার্তিক।
সব চেয়ে বেশি করে তাঁর খটাখটি লেগেছে দলের ক্যারিবিয়ান গ্রুপের সঙ্গে। অথচ এই গ্রুপেই সেরা দুই ম্যাচউইনার আছেন। রাসেল এবং নারাইন। বছরের পর বছর ধরে নারাইন হচ্ছেন নাইটদের এক নম্বর অস্ত্র। এখন সেই স্থান নিয়েছেন রাসেল। এ বারের আইপিএলে ১৪ ম্যাচে ৫১০ রান করেছেন তিনি। মেরেছেন ৫২টি ছয়। কেকেআরের প্রধান দুই বিদেশির সঙ্গে যে অধিনায়কের একেবারেই বনিবনা হচ্ছে না, সেই ছবি বার বার ধরা পড়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের খবর, কার্তিকের ব্যক্তিগত কোচ অভিষেক নায়ারকে যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতেও প্রসন্ন হতে পারেনি দলের একাংশ। কেকেআর অ্যাকাডেমির দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে নায়ারের হাতে। সঙ্গে নাইটদের ‘মেন্টর’ বানানো হয়েছে তাঁকে। কেকেআর শিবিরের এক শীর্ষ কর্তারও ঘনিষ্ঠ তিনি। অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রে রাসেল বা নারাইনের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে কার্তিক এবং তাঁর ব্যক্তিগত কোচ এবং নাইট মেন্টরের সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পেয়েছে। প্রতিযোগিতা থেকে অকাল বিদায়ের পরে প্রশ্ন উঠছে, সেই সিদ্ধান্তগুলি খুব দলের পক্ষে গিয়েছে কি?
যেমন, রাসেলকে যে উপরের দিকে ব্যাট করতে নামানোর দরকার ছিল, তা বোঝার জন্য তো ফেলুদা হওয়ার দরকার নেই। তা হলে শেষ দিন পর্যন্ত এ নিয়ে গোঁয়ার্তুমি কেন করে যাওয়া হল? রবিন উথাপ্পা ফর্মে নেই দেখেও তাঁকে মুম্বইয়ে রবিবার এসপার-ওসপার ম্যাচে কেন আগে পাঠানো হল? উপরের দিকে নেমে রাসেল দুর্দান্ত খেলার পরেও মনোভাব বদল হয়নি কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্টের। শুভমন গিল দারুণ প্রতিভা জেনেও শুরুর দিকে তাঁকে নীচে খেলানো হয়েছে। বারবার কথা উঠলেও বলা হয়েছে, শুভমন নীচেই ঠিক আছে। অথচ, ওপেনে সুযোগ দিতেই তিন ম্যাচে দু’টো অর্ধশতরান করলেন তিনি। মুম্বইয়ের কাছে হারের পরে ব্যাটিং কোচ সাইমন ক্যাটিচ এসেও স্বীকার করে যান, দলের মধ্যে অশান্তি ছিল। সেটা মাঠেও বেরিয়ে পড়েছে। কোচ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন মানেই তো পরিষ্কার, কতটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। রাসেল খুল্লমখুল্লা তাঁর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে যাওয়ার পরের দিন অধিনায়ক কার্তিকও পাল্টা বলে যান, ‘‘আমি জানি, পিছন থেকে কারা ছুরি মারতে চাইছে। সব জানি।’’ প্রতিযোগিতা চলাকালীন নিজেদের মধ্যে এমন কামড়াকামড়ি, খেয়োখেয়ির বিবৃতি নজিরবিহীন।
রবিবার মুম্বইয়ে ম্যাচ শেষে টুইটারে ভিডিয়ো পোস্ট করে রাসেল বলেন, ‘‘সমর্থকদের উদ্দেশে বলছি। তোমরা আমাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছ। আইপিএল জুড়ে তোমরা যে ভাবে সমর্থন করেছ, তা অসাধারণ। কিন্তু আমরা তোমাদের আশা পূরণ করতে পারিনি। জানি তোমরা হতাশ। আমিও সমান হতাশ।’’ রাসেল যদি নাইট ভক্তদের নায়ক হন, তা হলে খলনায়ক নিঃসন্দেহে রবিন উথাপ্পা। তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ উপচে পড়ছে টুইটারে। নাইট সমর্থকেরা প্রশ্নও করেন, ‘‘উথাপ্পা কাদের হয়ে খেলল? হায়দরাবাদ ও মুম্বইয়ের হয়ে?’’ কেউ লেখেন, ‘‘ম্যাচ সেরার পুরস্কারটি উথাপ্পার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতেন হার্দিক।’’
ইতিমধ্যেই হাওয়া উঠে গিয়েছে, উথাপ্পা হঠাও, কেকেআর বাঁচাও। কার্তিককে নিয়েও খুব ইতিবাচক স্লোগান চোখে পড়ছে না। তাঁর ব্যাটিং ফর্ম তো বটেই, অধিনায়ক হিসেবে যোগ্যতা নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। যদিও কেকেআরের এক শীর্ষ কর্তার আশীর্বাদ তাঁর মাথার উপরে রয়েছে বলে তাঁকে ছেঁটে ফেলা হবে কি না, জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। আবার রাসেলও কি কার্তিকের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে খেলতে চাইবেন? পীযূষ চাওলা বা উথাপ্পার মতো পিছিয়ে পড়া ক্রিকেটারদের উপর ভরসা করে কী ভাবে ট্রফি জেতা সম্ভব? পেস বোলিং বিভাগ প্রায় শূন্য। হ্যারি গার্নি, প্রসিদ্ধ কৃষ্ণদের নিয়ে স্বল্প বাজেটে বাজিমাত করার পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পড়েছে। নাইটদের বিখ্যাত স্পিন বিভাগও ধার হারিয়েছে। ইডেনের উইকেটের চরিত্র বদলে যাওয়া আর একটা কারণ।
কিন্তু সবার আগে নাইট ড্রেসিংরুমে ফেরাতে হবে শান্তির বাতাবরণ। সংসারে আগুনও জ্বলবে, আবার ট্রফিও জিতব— এমন অবাস্তব স্ক্রিপ্ট বলিউডের ফিল্মেও চালানো মুস্কিল। প্রধান চরিত্র কোনও কবির খান হলেও সম্ভব নয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy