যোদ্ধা: রক্ষণের স্তম্ভ অনীশ।
এক জন এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় ক্রিকেট দলের অলরাউন্ডার, মুম্বইয়ের অথর্ব অঙ্কলেকর। আর এক জন অনূর্ধ্ব-১৬ ভারতীয় ফুটবল দলের রক্ষণের স্তম্ভ, বাংলার অনীশ মজুমদার। আশ্চর্য মিল ভবিষ্যতের দুই তারকার কাহিনিতে।
মাত্র দশ বছর বয়সে বাবাকে হারান অথর্ব। মা বৈদেহী মুম্বইয়ের বাস কন্ডাক্টর। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি ছেলের ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছেন। আর অনীশের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে মাত্র সাত বছর বয়সেই। ব্যান্ডেলে রেলের কারশেডের কর্মী মুকুল মজুমদারের কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। বছর দু’য়েকের মধ্যে দু’টো কিডনিই প্রায় বিকল হয়ে যায়। শুরু হয় ডায়ালিসিস। বন্ধ হয়ে যায় বাড়ি থেকে বেরোনো।
প্রবল আর্থিক সঙ্কটও অণিমা মজুমদারকে দমাতে পারেনি। ছোট ছেলে অনীশকে ভর্তি করে দিয়েছিলেন ব্যান্ডেল বাণীচক্র ক্লাবে অশ্বিনী বরাটের কাছে। যাঁর কোচিংয়ে উত্থান সুরজিৎ সেনগুপ্ত, স্বরূপ দাস, তনুময় বসু, অনীত ঘোষ-সহ একাধিক তারকার। কিন্তু স্বামীর অসুস্থতার জন্য দু’-তিন মাসের বেশি ছেলেকে অনুশীলনে নিয়ে যেতে পারতেন না তিনি। বলছিলেন, ‘‘আমার পক্ষে বেশি দিন অনীশকে মাঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। দু’-তিন মাস অনুশীলন করতে পেরেছিল। একটু বড় হওয়ার পরে অনীশকে হুগলি জেলা ক্রীড়া সংস্থার ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করেছিলাম।’’
অনীশের জীবনটাই এর পরে সম্পূর্ণ বদলে যায়। অ্যাকাডেমির কোচ জাতীয় দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক তনুময় বসু বলছিলেন, ‘‘দশ বছর বয়সে মায়ের হাত ধরে আমাদের অ্যাকাডেমিতে এসেছিল অনীশ। ও ছিল সকলের চেয়ে লম্বা। এই কারণেই ওকে আমরা স্টপারে খেলাতে শুরু করলাম। আমাদের হয়ে জুনিয়র আই লিগে দুর্দান্ত খেলল।’’ যোগ করলেন, ‘‘অনীশের দাদা (মণীশ) ফুটবল খেলে। ওকেও আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন অণিমাদেবী। মায়ের জন্য এই জায়গায় ও পৌঁছতে পেরেছে।’’
চুঁচুড়া অ্যাকাডেমি থেকেই অনীশকে নিয়ে যায় বেঙ্গালুরু এফসি। গত বছর কোচিংয়ে ‘বি’ লাইসেন্স কোর্স হয়েছিল চুঁচুড়ায়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোচেরা এসেছিলেন। ছিলেন বেঙ্গালুরু এফসি-র জুনিয়র দলের এক কোচও। তিনিই তনুময়কে অনুরোধ করেন, অনীশকে বেঙ্গালুরু এফসিতে খেলার অনুমতি দেওয়া হোক। এই মরসুমে বেঙ্গালুরুর হয়ে জুনিয়র আই লিগে ভাল খেলার পরে জাতীয় দলের জন্য অনীশকে নির্বাচিত করেন সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের স্কাউট প্রাক্তন ফুটবলার সুভাষ চক্রবর্তী ও গৌতম দেবনাথ। প্রতিশ্রুতিমান ডিফেন্ডারের নেতৃত্বেই অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে ভারত।
ঘটনা হচ্ছে, বছর দু’য়েক আগে এই অনীশকেই অনূর্ধ্ব-১৪ বাংলা দলের ট্রায়ালে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল! এখনও সেই প্রসঙ্গ উঠলে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন তনুময়। বলছিলেন, ‘‘চুঁচুড়াতেই বছর দু’য়েক আগে অনূর্ধ্ব-১৪ জাতীয় ফুটবলের আসর বসেছিল। আমিই অনীশকে বাংলা দলের ট্রায়ালে পাঠিয়েছিলাম। আইএফএ-কে বিশেষ ভাবে বলেও দিয়েছিলাম, ছেলেটা দারুণ প্রতিশ্রুতিমান। আমার কথার কোনও গুরুত্বই দেয়নি ওরা। সুযোগ না পেয়ে ভেঙে পড়েছিল ছেলেটা। আমি বলেছিলাম, সুযোগ এক দিন আসবেই। সে দিন নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।’’
বেঙ্গালুরু এফসি-র হয়ে জুনিয়র আই লিগেই নিজেকে প্রমাণ করে অনীশ। এই মুহূর্তে অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপেও ভারতের হয়ে দুরন্ত ছন্দে বঙ্গ ডিফেন্ডার। বি’ গ্রুপে একমাত্র ভারতই এখনও পর্যন্ত কোনও গোল খায়নি। জাতীয় স্তরে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বাংলার ফুটবলের নতুন স্বপ্ন অনীশ। উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তনুময়ও বলছিলেন, ‘‘লড়াই অনীশের রক্তে। ওর সব চেয়ে বড় গুণ, মাথা ঠান্ডা রেখে খেলে। আশা করছি, উজ়বেকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচেও ছন্দ ধরে রাখতে পারবে।’’ আজ, রবিবার উজ়বেকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচে ড্র করলেও আগামী বছর বাহরিনে মূল পর্বে খেলা নিশ্চিত হয়ে যাবে ভারতের। কিন্তু কোচ বিবিয়ানো ফার্নান্ডেজ এবং ফুটবলারেরা জয় ছাড়া অন্য কিছুই ভাবছেন না।
অনূর্ধ্ব-১৬ ভারতীয় দলের রক্ষণের প্রধান ভরসা অনীশ। অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়শিপে ভারত জিতেছিল তার অধিনায়কত্বেই। কিন্তু মা অণিমাদেবীর মন তাতে ভরছে না। আগের ম্যাচে বাহরিনকে পাঁচ গোলে চূর্ণ করার পরেই বাড়িতে ফোন করেছিল অনীশ। কী বলেছিল ছেলে? অণিমাদেবী বললেন, ‘‘ছেলে ফোন করে বলল, আমরা পাঁচ গোলে জিতেছি মা। আমি বললাম, জিতেছিস ঠিকই, কিন্তু তুই তো আর গোল করতে পারিস না। রক্ষণে খেলিস। তোর খেলা তো আমি কিছুই বুঝতে পারি না। আমি তো জানি, সামনের দিকে যারা খেলে, তারাই শুধু খেলোয়াড়।’’ ছ’বছরের বড় দাদা মণীশ রক্ষণে খেলেন। দাদাকে দেখেই ডিফেন্ডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু অনীশের। বাড়িতেই দুই ভাইয়ের অনুশীলন চলত। অণিমাদেবী বললেন, ‘‘দুই ভাই মিলে বাড়ির অনেক জিনিস ভেঙেছে। এখনও জানলার কাচ ভাঙা।’’ হাসতে হাসতে যোগ করলেন, ‘‘এর জন্য প্রচুর মারও খেয়েছে দুই ভাই।’’ রবিবার উজ়বেকিস্তানকে হারাতে পারলে নিশ্চয়ই জিনিসপত্র ভাঙার জন্য ছেলেকে ক্ষমা করে দেবেন মা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy