অভিনব। শহরে লাল-হলুদ ড্রয়িংরুম। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
টাকা নেই। তাই জোসে ব্যারেটোকে টিমে নেওয়া যাবে না। শুনে মোহনবাগান তাঁবুতে ছুটে এসেছিলেন উত্তর কলকাতার এক কট্টর সবুজ-মেরুন সমর্থক। বছর এগারো আগে। হাতে নিজের বাড়ির দলিল। ক্লাব কর্তাদের কাছে তাঁর আকুতি ছিল দলিলটা বন্ধক দিয়ে বা বিক্রি করে সবুজ তোতাকে ফিরিয়ে আনুন।
ক্লাবের জয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যুবভারতীর গ্যালারি থেকে মাঠের ভিতর ঝাঁপ দিয়েছিলেন যাদবপুরের এক যুবক। মারাও গিয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত।
পঁচাত্তরের পাঁচ গোলের লজ্জা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন বাগান সমর্থক উমাকান্ত পালোধী।
ডার্বিতে প্রিয় দল হারলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দরজা বন্ধ করে দিন কয়েক বাইরে না বেরনোর নজির তো বাংলার ঘরে ঘরে। বার্সা-রিয়ালের যুগে এখনও তা বঙ্গসন্তানদের রক্তে প্রবহমান।
কিন্তু বাড়ির ড্রয়িংরুমকে প্রিয় দলের ক্লাব টেন্ট বানিয়ে ফেলেছেন, মেঝেকে করে ফেলেছেন মাঠ, দেওয়ালকে গ্যালারি—এমন নজির সম্ভবত কলকাতা ডার্বির বিরানব্বই বছরের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। কেউ দেখেওনি।
আরও পড়ুন: তিন মহাতারকার ডার্বি
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের পাড়ার কাছে বেহালায় এ রকমই চমকপ্রদ আর নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছেন এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। কলকাতা পুরসভার ১২৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৮ বিবি সেনগুপ্ত রোডের কট্টর লাল-হলুদ সদস্য সুবীর হালদার তাঁর দোতলা বাড়ির ড্রয়িংরুমকে সব অর্থেই করে ফেলেছেন ইস্টবেঙ্গল তাঁবু ও মাঠের রেপ্লিকা!
ঘরে ঢুকে মনে হবে ময়দানের লাল-হলুদ তাঁবুতেই ঢুকে পড়েছি। ‘‘শিলিগুড়িতে ডার্বি দেখতে যাওয়া হয়তো হবে না। দু’টো টিকিট কিনেছি। তবে ট্রেনের টিকিট কনফার্ম হয়নি। যদি যাওয়া না হয় তা হলে এই ঘরে বসে টিভিতে খেলা দেখব। ভাবব ক্লাব তাঁবুতে বসে খেলা দেখছি।’’ বলতে বলতে উজ্জ্বল সুবীরের মুখ। যোগ করেন, ‘‘বরিশালের বাঙাল তো, লাল-হলুদ ছাড়া কিছু বুঝি না। মেসি ফেলে ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখি। সে দিন এক দিকে বার্সা আর অন্য দিকে আমাদের টিমের সঙ্গে মিনার্ভার খেলা ছিল। ইস্টবেঙ্গল দু’গোল দেওয়ার পর নিশ্চিত হয়ে মেসির জন্য টিভি সুইচ ঘোরালাম।’’ গর্ব করে জানিয়ে দেন, তাঁর সংগ্রহে একশোটা কাপড়ের লাল-হলুদ পতাকা, কাগজের পতাকা এক হাজার। ‘‘আই লিগ, কলকাতা লিগ বা যে-কোনও টুর্নামেন্ট—আমার দোকানের সামনের বোর্ডে সূচি পেয়ে যাবেন ক্লাবের। টিকিটও দিই মাঝে মাঝে।’’
ডার্বির জন্য তৈরি হচ্ছেন লাল-হলুদের প্লাজা। বৃহস্পতিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
বালি-সিমেন্টের সামান্য ব্যবসায়ী। ইচ্ছে থাকলেও এখনও পুরো বাড়িটা লাল-হলুদ রং করতে পারেননি। তবে যা করেছেন তাতেই তো লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়েছে। সিঁড়ির অনেকটা ক্লাবের জার্সির রঙের। আর ঘরের ভিতর? মেঝেটা মাঠের আদলে। ঘাসের রঙে পুরো সবুজ। সেন্টার লাইন, সাইড লাইন, নেট লাগানো গোল পোস্ট সব আছে। তার পাশেই ক্লাব তাঁবু। একেবারে ময়দানের তাঁবুর সামনেটায় যেমন করে ক্লাবের নাম লেখা সে রকমই লেখা তাঁর প্রিয় ক্লাবের নাম। মাঠের পাশের গ্যালারিটা এখনও দেওয়াল জুড়ে করে উঠতে পারেননি। টাকা-পয়সা হাতে এলে পরের ডার্বির আগে সেটা করার চেষ্টা করবেন বলে জানালেন সুবীর। পাড়ায় সবাই যাঁকে চেনে ‘ইস্টবেঙ্গল-রতন’ বলে। ঘরের নানা প্রান্তে ঝুলে রয়েছে লাল-হলুদের ‘সিম্বল’ ইলিশ মাছ, অবশ্য কার্ডবোর্ডের। ‘‘রবিবারের ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল জিতলে সোমবার ইলিশ হবে বাড়িতে। বাবার আমল থেকেই চলে আসছে এটা। আর আই লিগ জিতলে দু’শো লোককে মাংস-ভাত খাওয়াব ভেবে রেখেছি।’’ বলছিলেন লাল-হলুদের মতোই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়েরও অন্ধ ভক্ত সুবীর।
দুই প্রধানের কট্টর সমর্থক তো অনেক আছেন বাংলার ঘরে ঘরে। কিন্তু হঠাৎ বেহালায় নিজের বাড়িতে এত টাকা খরচ করে প্রিয় ক্লাবের তাঁবু বানানোর শখ হল কেন? ‘‘এটা বলতে পারেন একটা প্রতিবাদ। আমাদের ক্লাব এবং মোহনবাগান ক্লাবের ইতিহাস তো যথাক্রমে একশো বছর ছুঁতে চলেছে বা তারও বেশি। অথচ ক্লাব কর্তারা আজ পর্যন্ত ক্লাবের নিজস্ব মাঠ বা তাঁবু করতে পারলেন না শহরের কোথাও। ময়দানেই রয়ে গেলেন সেনাদের দয়ায়। রাজারহাটে কত জায়গা ছিল। আমি নিজের রোজগারের টাকায় সেটা করেছি বাড়িতে। হয়তো এটা সামান্য। তবে দেখিয়েছি ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।’’
আরও পড়ুন: বাগানের বিশেষ প্র্যাকটিস
এই ইস্টবেঙ্গল প্রীতিতে সমস্যা হয় না? বেহালায় তো প্রচুর বাগান সমর্থক। ‘‘হয়। ডার্বি হারলে বাড়ির বা দোকানের সামনে এসে গালাগালি করে। আগে রাগ হত। এখন হয় না। সয়ে গেছে সব,’’ বলতে থাকেন ছোট্টখাট্টো চেহারার ক্রীড়াপ্রেমী। ইস্টবেঙ্গলের পরে যাঁর প্রিয় সৌরভের ক্লাব আটলেটিকো দে কলকাতা।
সুবীরের এই ‘পাগলামি’ নিয়ে বাড়িতে তেমন সমস্যা নেই। সে জন্যই ঠিক করেছেন সামনে একটা বড় মূর্তি বসাবেন ময়দানের গোষ্ঠ পালের মূর্তির ঢঙে। গোষ্ঠবাবু তো বাগানের, আপনি কার মূর্তি বসাবেন? নামটা শুনে অবশ্য চমকে যেতে হল। সত্তর-আশির দশকের স্টপার শ্যামল ঘোষ! সুবীরের যুক্তি, ‘‘আমার দেখা আমাদের ক্লাবের সেরা সুভদ্র ফুটবলার।’’
গোষ্ঠ পালের মতো শ্যামল ঘোষ! এ-ও তো আর এক ‘পাগলামি’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy