নায়ক: সেই একই ভঙ্গি, যা বদলায়নি সময়ের সঙ্গে। নিজের ছোটবেলার আর ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তান ম্যাচের ছবি সোমবার টুইট করে কোহালি লিখলেন, ‘সেই নব্বইয়ের দশক থেকে চলে আসছে’।
১৯৮৩ এর ২৫ জুন লর্ডসে যখন ক্লাইভ লয়েডের দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ফাইনাল খেলতে নামছে আন্ডারডগ ভারত, কপিল দেব তাঁর দলকে বলেন, ‘‘লড়কে লোগ, চলো ম্যাচ আমরা সবাই উপভোগ করি।’’ ৩৬ বছর পর ফের ইংল্যান্ডেই বিশ্বকাপ অভিযানে নেমেছে ভারত। কপিলের মতোই উত্তরাঞ্চলীয় ভারত অধিনায়ক ৮৩ বিশ্বকাপ জয়ের সেই মন্ত্রকে দলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছেন।
ম্যাঞ্চেস্টারে পাকিস্তানকে হারানোর পরে বিরাট কোহালির সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলেন ওয়াসিম আক্রম। আইসিসির ওয়েবসাইটের জন্য। পাক কিংবদন্তি জিজ্ঞেস করেন কোহালিকে, ‘‘দারুণ খেলছ তোমরা। বিশ্বকাপে এই দুরন্ত ছন্দের রহস্য কি?’’ ভারত অধিনায়ক আক্রমকে বলেন, ‘‘আমরা ঠিক করেছি প্রত্যেকটা ম্যাচ উপভোগ করব। খোলোমেলা ভাবে নিজেদের মনের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করব মাঠের মধ্যে। আটকে আটকে খেলব না।’’
মনে করা হচ্ছে, কোহালিরা সার্জেনের মতো যেমন নিখুঁত অপারেশন চালাচ্ছেন, তাতে ওয়ান ডে ক্রিকেটের ভাষাই বদলে যাচ্ছে। রবিবার ভুবনেশ্বর কুমার আহত হওয়ার পরে পড়ে থাকা ওভার শেষ করতে এসে বিজয় শঙ্কর যে ভাবে উইকেট তুলে নিয়েছেন, তা দেখে বিস্মিত পণ্ডিতরা। তাঁদের পর্যবেক্ষণ, ‘‘ভারত যে দলটা নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপে, তাদের প্রত্যেকে তেল দেওয়া মেশিনের মতো তৈরি। অগ্নিপরীক্ষার জন্য সদা প্রস্তুত। শঙ্করের উইকেট নেওয়া সেটাই প্রমাণ করে।’’ কেউ কেউ বিস্ফারিত চোখে আরও যোগ করছেন, ‘‘শিখর ধওয়ন চোট পেয়ে বাইরে বসে আছে। কিন্তু ওর অভাব কিছু বোঝাই গেল না। কে এল রাহুল নামল। আর ঠিক খেলে দিল।’’ সব দেশের বিশেষজ্ঞরাই একমত, এত পেশাদার ভারতীয় দল খুব কমই দেখা গিয়েছে। তেমনই প্রশংসিত হচ্ছে কোহালিদের নিয়ন্ত্রণ। কী মাঠের মধ্যে, কী মাঠের বাইরে। পাকিস্তানকে হারানোর পর দলের তরফে জানানো হল, দু’দিন এখন ক্রিকেটারদের ছুটি। অনেকেরই পরিবার এসেছে। তাদের সঙ্গে সময় কাটানো যেতেই পারে। রবিবার রাতে খোঁজ নিতে গিয়ে আবার জানা গেল, দু’দিনের ছুটি ঘোষণা হয়ে গেলেও সাউদাম্পটনে গিয়ে কেউ কেউ প্র্যাক্টিসে নেমে পড়তে চান। আবার একাংশ প্রস্তাব দেয়, ছুটি হলেও যদি মাঠে আমরা না-ও যাই, জিম আর ফিজিক্যাল ট্রেনিং বন্ধ করা যাবে না। কারও কারও মনে হচ্ছে, এটা বদলে যাওয়া ভারত। যারা পাকিস্তান ম্যাচ জিতেও বাঁধনহারা বিজয় উৎসবে মাতে না। কারণ তারা পাখির চোখের মতো দেখছে বিশ্বকাপ। রোহিত শর্মা রবিবার সাংবাদিক সম্মেলনে বারবার বলে গেলেন, ‘‘পাকিস্তানকে হারিয়ে আমরা ততটাই খুশি, ঠিক যতটা হই অন্য দলকে হারিয়ে। আমরা একটা মিশনে বেরিয়েছি। আর সেই মিশন সম্পূর্ণ করাই আমাদের লক্ষ্য।’’ বোঝাই যাচ্ছে, বহির্বিশ্ব ম্যাঞ্চেস্টারের মহারণ নিয়ে যতই আলোড়িত হোক, রোহিতদের দলের মধ্যে ভাবনাটা হচ্ছে মিশন বিশ্বকাপই আসল গন্তব্য। পাকিস্তান ম্যাচ সেই অভিযানের রাস্তায় শুধু একটা মাইলস্টোন পেরিয়ে যাওয়ার মতো। রাস্তার মাইলস্টোনে যেমন লেখা থাকে, অমুক জায়গার নাম আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে কত কিলোমিটার বাকি। রোহিতদের ভাবনাটাও সে রকম। পাকিস্তান ম্যাচ পেরোলাম, এখনও পঞ্চাশ কিলোমিটার যেতে হবে।
এমনিতে ম্যাঞ্চেস্টারে ইতিহাসের অভাব নেই। একে তো দুই ম্যাঞ্চেস্টার ফুটবল ক্লাবের শহর। ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ক্রিকেট মাঠ থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ জর্জ বেস্ট, ববি চার্লটনদের ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড। যাকে বলা হয় ‘থিয়েটার অব ড্রিমস’। রবিবার ক্রিকেটের মহারণকে ঘিরে ম্যান ইউ-এর সামনের ফুটবল রাস্তাগুলোও ক্রিকেট উন্মাদনায় ভর্তি ছিল। জিম লেকারের এক টেস্টে রেকর্ড ১৯ উইকেট এখানেই। শেন ওয়ার্নের সেই গ্যাটিংকে আউট করা ‘বল অব দ্য সেঞ্চুরি’। কিন্তু ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টির ঘরের মাঠে রবিবার সমস্ত রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে। একটি তথ্য অনুযায়ী, ল্যাঙ্কাশায়ার কাউন্টি ক্লাব এই ম্যাচ থেকে রেকর্ড দুই মিলিয়ন পাউন্ড রোজগার করেছে। মাঠের লাগোয়া রয়েছে পাঁচতারা হিল্টন হোটেল। সেখানকার ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে খেলা দেখা যায়। এই হোটেলের ৬৩টি বক্সের প্রত্যেকটি বিক্রি করা হয়েছে পাঁচ হাজার পাউন্ডে। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে দর্শক আসন ২৩,৫০০। টিকিট নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, অন্তত চার থেকে পাঁচ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল টিকিটের জন্য। আরেকটা তথ্য পাওয়া গেল যে, সারা বিশ্বের টিভি-দর্শক মিলিয়ে ১০০ কোটি মানুষ না কি এই ম্যাচ দেখেছেন। যা সর্বকালীন রেকর্ড। বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক নেভিল কার্ডাস এই শহরের। ম্যাঞ্চেস্টার থিয়েটারে চকোলেট বিক্রি করা দিয়ে যাঁর জীবন শুরু। ম্যাঞ্চেস্টারেরই একটি বিখ্যাত পাবে বসে কমিউনিজমের নকশা বানিয়েছিলেন মার্কস এবং এঙ্গেলস।
জুটিবন্ধনের শহরে রোহিত, রাহুল, বিরাট, কুলদীপ, চহালরা দেখিয়ে দিয়ে গেলেন ক্রিকেটের জুটি কী করে বাঁধতে হয়। পাকিস্তানকে হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাকি দলগুলোর জন্যও যেন বার্তা পাঠিয়ে দিলেন কোহালিরা—আমরা বিশ্বকাপের মহাশক্তি। হারাতে গেলে মহাপ্রলয় ঘটাতে হবে। ইতিমধ্যেই চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে, তা হলে কারা বেশি অপ্রতিরোধ্য? ইংল্যান্ড না ভারত? কয়েক দিন আগেও যে অইন মর্গ্যানের দলকে নিরঙ্কুশ ফেভারিট মনে করা হচ্ছিল, সেটা রবিবারের পাক-দুরমুশের পরে উধাও। নাসের হোসেনকে গতকাল ম্যাচের শেষে বলতে শোনা গেল, ‘‘খুব ভাল বোলিং করতে পারলে হয়তো রোহিত, বিরাটদের টপ গিয়ারে ওঠা আটকানো যেতে পারে। কিন্তু ভারতের বোলিংটাও এত ভাল যে, তার পরেও জেতা সম্ভব কি না কেউ জানে না।’’ বোঝাই যাচ্ছে, নাসেররা ৩০ জুনের ম্যাচ নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। যে দিন কোহালির ভারত মুখোমুখি মর্গ্যানের ইংল্যান্ডের। ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা মনে রেখেও বলাবলি শুরু হয়ে গিয়েছে, এটাই ফাইনালের আগে ফাইনাল। রোহিতদের রথ ইংল্যান্ড থামাতে পারে কি না, সেটাই এখন কফির পেয়ালায় তুফান তুলেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy