পতন: ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ব্যাটিং-ধসের ধাক্কা কাটিয়ে ম্যাচ জেতানোর চেষ্টা করেছিলেন ধোনি। কিন্তু গাপ্টিলের দুরন্ত থ্রোয়ে ফিরে যান।টুইটার
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় মনে করছেন, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে পরে নামানোটা ঠিক হয়নি। পরিস্থিতি বিচারে তাঁর আরও আগে আসা উচিত ছিল এ দিন। ভিভিএস লক্ষ্মণও তাঁর সঙ্গে একমত।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে বিপর্যয়ের পরে তৎক্ষণাৎ শুরু হয়ে গিয়েছে ময়নাতদন্ত। কোহালিরা কি ঠিক দল আনেননি বিশ্বকাপে? কেন চার নম্বর নিয়ে এত টালবাহানা চলল শেষ পর্যন্ত? কেন দীনেশ কার্তিকের আগে ঋষভ পন্থ? যেখানে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহালি আউট হয়ে গিয়েছেন, খেলা ধরার জন্য কি কার্তিককে পাঠানো উচিত ছিল? যাঁর রক্ষণ ঋষভের চেয়ে মজবুত? কেন ধোনির আগে হার্দিক পাণ্ড্য? সৌরভ মাঠ ছেড়ে বেরোনোর সময় ধোনির ব্যাটিং নিয়ে জিজ্ঞেস করায় বলে গেলেন, ‘‘ধোনি আজ খারাপ খেলেনি কিন্তু। সেই সময় পার্টনারশিপ দরকার ছিল। জাডেজার সঙ্গে ও সেটাই করেছে। তবে ওকে দেরিতে নামানো হয়েছে। আরও আগে আসা উচিত ছিল ধোনির।’’ শোনা গেল কমেন্ট্রিতেও তিনি এবং লক্ষ্মণ একই কথা বলে এসেছেন।
বিরাট কোহালি যদিও মনে করছেন, নিউজ়িল্যান্ডের স্কোর তাড়া করতে নেমে শুরুতেই যে তাঁরা চার উইকেট হারিয়ে ফেললেন, সেখানেই ম্যাচ হেরে গিয়েছে দল। ম্যাঞ্চেস্টারে মুম্বইসুলভ উৎসবের আবহের বদলে যে শোকের ছায়া নেমে এল, তার কারণ শুরুর চল্লিশ মিনিটের ব্যাটিং। কোহালি এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এমনই ম্রিয়মান ছিলেন, যা সচরাচর তাঁকে দেখা যায় না। সেই কোহালিসুলভ আগ্রাসনটা যেন নিউজ়িল্যান্ড ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে। বললেন, ‘‘আমাদের ব্যাটিংয়ের প্রথম চল্লিশ মিনিটেই খেলার রং পাল্টে যায়। আমরা ওই সময়ে খারাপ ক্রিকেট খেলেছি।’’ এর পরে আরও যন্ত্রণাকাতর অভিব্যক্তি-সহ যোগ করলেন, ‘‘এত কষ্ট করে আমরা বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছি। ভাল খেলে এই জায়গাতে এসেছি। তার পরে হঠাৎই সব শেষ। আমাদের হৃদয় গুঁড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই পরাজয়। কিন্তু কী করা যাবে, এটাই ক্রিকেট। এটাই বিশ্বকাপের বাস্তব দিক। একটা বাজে দিন তোমার স্বপ্নভঙ্গ করে দিয়ে যেতে পারে। আমাদের মেনে নিতে হবে।’’ এক নিঃশ্বাসে এর পরে বললেন, ‘‘তবে নিউজ়িল্যান্ডকে কৃতিত্ব দিতে হবে। যে ভাবে ওরা নতুন বলে বল করেছে, সেটাই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়ে গেল।’’
২০১১-তে ধোনির ভারত যখন ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ জেতে, কোহালি সেই দলের তরুণ সদস্য ছিলেন। সচিন তেন্ডুলকরকে তাঁর কাঁধে করে মাঠ ঘোরানোর ছবি এখনও সকলের মনে আছে। ২০১৩-তে ধোনিরই নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়। সেখানেও কোহালি দলের তরুণ ব্যাটসম্যান। তার পর থেকে বিশ্ব মঞ্চে ট্রফিহীন ভারত। ২০১৫ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাতে পরাজয়। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হার। ২০১৯-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিউজ়িল্যান্ডের কাছে অঘটনের পরাজয় বরণ করে বিদায়। কে বলবে এই নিউজ়িল্যান্ডই রাউন্ড রবিন পর্বের শেষ দিকে হারতে হারতে শেষ চারে উঠেছে আর ভারত টেবলের শীর্ষে থেকে শেষ চারে খেলতে নেমেছে। কোহালি যদিও দাঁতে দাঁত চেপে বলার চেষ্টা করলেন, ‘‘আমরা শোকাহত। তবে মেনে নিতে হবে। এই হার থেকে আরও ভাল খেলোয়াড় হয়ে আমরা বেরিয়ে আসব।’’
২৪০ রান তাড়া করতে নেমে শুরুতেই চারটি বল ভূকম্পন ঘটিয়ে দিয়ে গেল ভারতীয় ব্যাটিং ইমারতে।
১.৩ ওভার: টুর্নামেন্টে ভারতের সব চেয়ে সফল ব্যাটসম্যান রোহিত শর্মা আউট। ম্যাট হেনরির ফুল লেংথ ডেলিভারিতে খোঁচা দিয়ে উইকেটকিপার টম লাথামের হাতে ক্যাচ। ভারত ৪ রানে ১ উইকেট।
২.৪ ওভার: বাঁ-হাতি ট্রেন্ট বোল্টের সেই বিষাক্ত ইনসুইঙ্গার। কোহালির পা পেয়ে গেল উইকেটে সামনে। মরিয়া ভারত অধিনায়ক রিভিউ নিলেন। তাতেও লাভ হল না। ১ রানে ফিরে গেলেন তিনি। বিরক্ত কোহালি মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে যাচ্ছেন, জোরালো ঝাঁকুনি খেয়ে গেল দল। ৫ রানে ২ উইকেট।
৩.১ ওভার: ম্যাট হেনরির অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বলে অহেতুক খোঁচা দিলেন রাহুল। উইকেটকিপারের হাতে ক্যাচ। ভারত ৫ রানে ৩ উইকেট।
৯.৬ ওভার: দীনেশ কার্তিক কিছুটা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। পয়েন্টে দুর্দান্ত ক্যাচ নিয়ে তাঁকে ফেরালেন জিমি নিশাম। ভারত ২৪-৪।
‘‘প্রথম ৪০ মিনিটে প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পাঁচ রানে তিন উইকেট হারানোর পরে ম্যাচে ফিরে আসাটা খুবই কঠিন। তবু জাডেজা আর এম এস চেষ্টা করেছিল। আমার মনে হয়, এটাই জাডেজার খেলা সেরা ইনিংস,’’ বললেন কোহালি। পরক্ষণেই যোগ করলেন, ‘‘গোটা টুর্নামেন্টে আমরা খুব ভাল খেলেছি। এই হারে আমরা খুবই হতাশ।’’
প্রথমে ২৪-৪, তার পরে ৯২-৬ হয়ে গিয়েছিল ভারত। ঋষভ আচমকা ওড়াতে গিয়ে আউট হওয়ার পরে ড্রেসিংরুমের বারান্দায় উত্তেজিত দেখাল কোহালিকে। উঠে গিয়ে তিনি কথা বলতে থাকেন হেড কোচ রবি শাস্ত্রীর সঙ্গে। দেখে মনে হচ্ছিল, ঋষভের দায়িত্বজ্ঞানহীন শট দেখে ক্ষুব্ধ অধিনায়ক। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে অবশ্য দলের কাউকে আলাদা করে খলনায়ক বানালেন না তিনি। বরং ঋষভকে নিয়ে বলে গেলেন, ‘‘ওর প্রতিভা কতটা সকলে দেখেছে। যদি কোথাও ভুল করে থাকে, সেটা থেকে শিক্ষা নেবে। আমিও ঋষভের বয়সে অনেক ভুল করেছিলাম, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। ঋষভও শিখবে।’’
চিরকাল বুক চিতিয়ে ক্রিকেট খেলতে চেয়েছেন কোহালি। কখনও অজুহাতের দরজা খোঁজেননি। এ দিন হারের পরেও তাই দায়িত্ব নিতে পিছপা হলেন না। বললেন, ‘‘আমার যে দায়িত্ব পালন করা উচিত ছিল, ওই সময় টিম আমার কাছ থেকে যে রকম পারফরম্যান্স আশা করেছিল, সেটা আমি দিতে পারিনি। স্বভাবতই খুব হতাশ লাগছে।’’
সেমিফাইনালের দু’টো ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ছবি-সহ একটা তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে যে, ধোনি যখন রান আউট হন, বৃত্তের বাইরে অতিরিক্ত ফিল্ডার ছিল নিউজ়িল্যান্ডের। হিসেব মতো বলটা ‘নো’ হওয়া উচিত ছিল। যদিও হারের পরে এই সব তথ্য খুব গুরুত্ব পাবে কি না, সন্দেহ। ‘নো’ হলেও রান আউট হতে পারতেন ধোনি।
সেমিফাইনালে ভারতের পতনের পরে কথা উঠছে, বিশ্বকাপের এই ফর্ম্যাট ঠিক আছে কি না। গ্রুপ পর্বে সেরা হয়ে একটা দল একটা বাজে দিনের জন্য বিদায় নেবে কেন? সৌরভ উদাহরণ দিলেন আইপিএলের। বললেন, ‘‘কিছু একটা ভাবা দরকার। আইপিএলের প্রক্রিয়াটা বেশ ভাল। প্রথম দু’টো দল দু’টো করে সুযোগ পায়। একটা বাজে দিন এ ভাবে শেষ করে দিতে পারে না একটা ভাল দলকে।’’ মাঠ থেকে বেরনোর সময় রীতিমতো ভক্তদের ভিড়ের মাঝে পড়তে হয় সৌরভকে। ভারতীয় সমর্থকেরা তাঁকে এমনই ঘিরে ধরেছিলেন যে, নিরাপত্তা কর্মীদের ডেকে সামাল দিতে হল। তার মধ্যেই বললেন, ‘‘কোহালিরা ভাল খেলেছে। গোটা টুর্নামেন্টে ভাল খেলে এক দিনের খারাপ ক্রিকেটে বিদায় নেওয়াটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। সত্যিই হতাশজনক।’’ চার নম্বর নিয়ে জট পাকিয়ে থাকা কতটা ক্ষতি করল? সৌরভ বললেন, ‘‘এটা ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল আগেই। যার কথাই ভাবি না কেন, তাকে এক বছর ধরে খেলিয়ে তৈরি করা উচিত ছিল বিশ্বকাপের জন্য।’’ কাপ হারানোর যন্ত্রণা কী, সৌরভ জানেন। গাড়িতে ওঠার আগে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে গেলেন, ‘‘ভেবেছিলাম লর্ডসে ফাইনাল খেলব। কী যে হয়ে গেল!’’
দিনের শেষ বিজয়ী অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন সব চেয়ে বেশি করে পাশে দাঁড়ালেন ভারতের। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কোহালির ভারত হারিয়েছিল উইলিয়ামসনের নিউজ়িল্যান্ডকে। সেই ইতিহাস বদলে দিয়ে উইলিয়ামসন বলে গেলেন, ‘‘ভারত দারুণ দল। দুর্ধর্ষ সব ক্রিকেটার রয়েছে। ক্রিকেট খেলাটা অনেক আকর্ষণীয় করে তুলেছে ভারত। ভারতীয় সমর্থকদের বলব, ধৈর্য হারাবেন না।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘জেতায় আমরা অবশ্যই খুশি। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটকে অশ্রদ্ধা করার কোনও জায়গা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy