ওস্তাদের মার: শেষ ওভারে আফগানিস্তানকে গুঁড়িয়ে উল্লাস মহম্মদ শামির। শনিবার সাউদাম্পটনে। রয়টার্স
টাইটানিকের যাত্রা শুরু হওয়া অভিশপ্ত শহর। সেখানেই বিশ্বকাপের টাইটানিক ডুবি হতে যাচ্ছিল। হিমশৈলের মতোই আফগানিস্তানে ধাক্কা খেয়ে তলিয়ে যেতে পারতেন বিরাট কোহালিরা।
সেখান থেকে বোলারদের হাত ধরে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ম্যাচ জিতে নিল ভারত। যে ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ অভিযানই মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হতে পারত, তা শেষ হল রুদ্ধশ্বাস ওভার দিয়ে আর মহম্মদ শামির হ্যাটট্রিকে। সারা মাঠে ছড়িয়ে পড়ল তেরঙ্গার উচ্ছ্বাস। ১১ রানে জিতে অপরাজিতই থেকে গেল কোহালির ভারত। কারও কারও মনে হচ্ছে, কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে ম্যাচ জেতাটা তিরাশি বিশ্বকাপের মতোই শুভলক্ষণ হতে পারে।
সে বার আন্ডারডগ জ়িম্বাবোয়ের কাছে হারের মুখে পড়েছিল কপিল দেবের ভারত। অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে রক্ষা করেন স্বয়ং অধিনায়ক। অমর হয়ে রয়েছে কপিলের সেই ১৭৫ নট আউটের ইনিংস। এ দিন ব্যাট হাতে কপিলের মতো একা কুম্ভ হয়ে উঠতে পারেননি কেউ। কিন্তু কোনও এক জনকে বাছতে গেলে সেই অধিনায়ককেই বাছতে হবে। কঠিন পিচে ৬৩ বলে ৬৭ করে কোহালিই টানছিলেন দলকে। তিনি ব্যাট করার সময় পিচকে এক রকম মনে হচ্ছিল, বাকিরা ব্যাট করার সময় অন্য রকম। কোহালির ওই ইনিংস না থাকলে আফগান স্পিনারদের সামনে ধড়ফড় করতে থাকা ভারত আট উইকেটে ২২৪ রানের স্কোরেও পৌঁছয় না।
আরও পড়ুন: জিতলেও আফগানরা বিরাটদের যে ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল
কিন্তু ভারতের জয়ের দুই নায়ক হিসেবে কোহালির সঙ্গে দুই পেসারকেও বাছতে হবে। যশপ্রীত বুমরা এবং মহম্মদ শামি। স্পিনারদের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পিচে গতিতে টেক্কা দেওয়া সহজ কাজ ছিল না। বুম বুম বুমরা এক ওভারে জোড়া শিকার তুলে নিয়ে মাঝ পর্বে আফগানিস্তানকে ঝটকা দিলেন। না হলে সেই সময়ে যথেষ্ট পরিণতি বোধ আর মানসিক জোর দেখিয়ে রান তাড়া করছিল তারা। স্কোর একশো পেরিয়ে গিয়েছিল অনায়াসেই। উনত্রিশতম ওভারে রহমত শাহ (৬৩ বলে ৩৬) এবং হাশমাতুল্লা শাহিদিকে (৪৫ বলে ২১) তুলে নিয়ে ভারতকে ম্যাচে ফেরান বুমরাই। শেষ কাজটা সারলেন শামি। যিনি বিশ্বকাপে প্রথম মাঠে নামার সুযোগ পেয়েই অগ্নিপরীক্ষার মুখে পড়েছিলেন।
ভুবনেশ্বর কুমারের চোট বলে দলে আসা শামি যখন শেষ ওভার করতে যাচ্ছেন, আফগানিস্তানের জয়ের জন্য দরকার ১৬ রান। এমনিতে সহজ লক্ষ্য নয়। কিন্তু ক্রিজে তখনও মহম্মদ নবি। যথেষ্ট ভাল ব্যাট করতে পারেন। সব চেয়ে বড় কথা, আইপিএল-সহ বিশ্বের বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে খেলে পোক্ত হয়ে গিয়েছেন তাঁরা। শেষ ওভারের এই স্নায়ুর চাপ নেওয়াটা একেবারেই সিলেবাসের বাইরে নয়। শামির প্রথম বলেই চার মেরে দিলেন নবি। পাঁচ বলে চাই ১২। দ্বিতীয় বল মিডউইকেটে চালালেন।
এক রান নিতে হবে দেখে নিলেন না। তৃতীয় বল ফের লং অনের উপর দিয়ে মারতে গিয়ে বাউন্ডারিতে ক্যাচ। হার্দিক পাণ্ড্য যেটা তালুবন্দি করলেন, সেটা নবির উইকেট নয়। আফগানিস্তানের প্রাণ। ৫৫ বলে ৫২ করে ফিরে যাচ্ছেন নবি, গোটা মাঠ উঠে দাঁড়াল।
পর-পর দু’বলে এ বার আফগান ইনিংস খতম করে দিলেন শামি। হ্যাটট্রিক করলেন এমন এক দেশের বিরুদ্ধে, যাদের সঙ্গে টেস্টে বাদ পড়তে হয়েছিল ফিটনেস পরীক্ষায় পাশ না করার জন্য। সেই সময়ে স্ত্রী হাসিন জাহানও ভয়ঙ্কর সব অভিযোগ তুলেছিলেন। হ্যাটট্রিকের পরে তাঁর উচ্ছ্বাসের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল, কতটা দুর্গম পথ পেরিয়ে ফের ক্রিকেট মানচিত্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। স্ত্রীর অভিযোগে বিদ্ধ তিনি সেই সময়ে ভেবেছিলেন, ক্রিকেটই হয়তো থেমে যাবে। হ্যাটট্রিক দূরের কথা, হাতে বল নিয়ে দৌড়তে পারবেন, সেটাই অলীক স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। সেখান থেকে সাউদাম্পটনে টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হ্যাটট্রিক করা নায়ক হিসেবে ইন্টারভিউ দেওয়া। চেতন শর্মার পরে একমাত্র ভারতীয় হিসেবে বিশ্বকাপের হ্যাটট্রিক করার নজির। ক্রিকেট সত্যিই মহান অনিশ্চয়তার খেলা!
১০ এপ্রিল, ১৯১২-তে যখন জনতার বাঁধনহারা উচ্ছ্বাস আর পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সাউদাম্পটনের বন্দর ছাড়ছিল টাইটানিক, কে জানত অতলান্তিকের বুকে চিরঘুমে শায়িত থাকার জন্য বেরোচ্ছে! ২২ জুন, ২০১৯। তেরঙ্গায় ঢেকে যাওয়া সাউদাম্পটন মাঠে যখন টস করতে নামছেন বিরাট কোহালি, কে ভেবেছিল, ‘টাইটানিক পার্ট টু’ দেখতে হতে পারে? তখন বরং আলোচনাটাই চলছিল অন্য রকম। ইংল্যান্ড এই আফগানিস্তানের বিরুদ্ধেই চারশোর কাছাকাছি তুলেছে, কোহালিরা কত তুলবেন? ঋষভ পন্থকে এ দিনই কেন খেলানো হল না? ঋষভ খেললে নিশ্চয়ই চারশো তোলার অভিযানটা জমত।
ক্রিকেট খুব শীঘ্রই প্রত্যাঘাত করল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ভারতীয়দের। বুঝিয়ে দিল, কেন তাকে মহান অনিশ্চয়তার খেলা বলা হয়। সেই সঙ্গে সাউদাম্পটনও যেন মনে করিয়ে দিল, টাইটানিককে ‘আনসিঙ্কেবল’ বলা হত। কখনও ডুববে না। প্রথম যাত্রাতেই তলিয়ে গিয়েছিল। তেমনই কোহালির দল যেন ভুলে না যায়, যতই তাঁদের ‘আনবিটেবল’ বলা হোক, অপরাজেয় ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। মহাসমুদ্রে কোথায় হিমশৈল লুকিয়ে রয়েছে, কে বলতে পারে!
আফগানিস্তান ইতিমধ্যেই ক্রিকেটের সেরা রূপকথা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে বারুদের গন্ধ আর বোমাবর্ষণের আতঙ্কের মধ্যে রশিদ খানদের হাত ধরে ক্রিকেটই সেখানে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সেতু। এগারো জন আফগানের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চে উদয় এমনিতেই অনুপ্রাণিত করার মতো এক উজ্জ্বল উদাহরণ। যুদ্ধের সাইরেনের আওয়াজ সরিয়ে কাবুলিওয়ালার দেশে নতুন রোম্যান্স ব্যাট-বলের শব্দ। কিন্তু পুরনো সেই আগমনী রূপকথায় থেমে থাকতে চাননি আফগানরা। বিশ্বকাপের মঞ্চে সর্বকালের সেরা অঘটন ঘটিয়ে দিচ্ছিলেন। আর এমন একটা দলের সঙ্গে যাদের দখলে রয়েছে সর্বকালের সেরা অঘটনের নজির। তিরাশির বিশ্বকাপ ফাইনালে লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর সেই অভাবনীয় দিনকেও টেক্কা দিচ্ছিলেন রশিদ খানরা। স্পিনের দেশ ভারতকে তাঁরা আটকে ফেলেছিলেন স্পিনের চক্রব্যূহে। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান সেই ফাঁদে বন্দি হয়ে হাসফাঁস করছিলেন। ৫২ বলে ২৮ করা ধোনিকে গ্যালারির বিদ্রুপও শুনতে হল শেষের দিকে। তখন তিনি আঠার মতো আটকে গিয়েছেন ক্রিজে। বড় শট দূরে থাক, খুচরো রান নিতেও পারছেন না! শুধু মন্থর পিচের দোহাই দিলে চলবে না কারণ কোহালি বা পরে এমনকি, আফগানিস্তানের নবিও দেখিয়ে দিয়ে গেলেন, এই পিচে দ্রুত রানও তোলা সম্ভব। সমস্যা ছিল বাইশ গজে না নিজেদের মানসিকতায়, খুঁজতে হবে।
সাউদাম্পটনে ক্রিকেটের টাইটানিক ডুবি বেঁচেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ধোনি কি ফুরিয়ে আসছেন? অথবা, ঋষভ পন্থের মতো আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যানকে বাইরে রেখে বিজয় শঙ্কর, কেদার যাদবকে খেলানো কি ঠিক হচ্ছে? ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা কি বড্ড বেশি রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যাট করছে? আজ হিমশৈলে ধাক্কা খেয়েও জাহাজডুবি বাঁচানো গিয়েছে ঠিকই কিন্তু ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দল কি ম্যাচে ফেরার এমন সুযোগ দেবে?
জিতলেও নানা অস্বস্তিকর প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেল সাউদাম্পটন।
স্কোরকার্ড
ভারত ২২৪-৮ (৫০)
আফগানিস্তান ২১৩ (৪৯.৫)
ভারত
রাহুল ক জ়াজ়াই বো নবি ৩০•৫৩
রোহিত বো মুজিব ১•১০
কোহালি ক রহমত বো নবি ৬৭•৬৩
শঙ্কর এলবিডব্লিউ বো রহমত ২৯•৪১
ধোনি স্টাঃ ইক্রম বো রশিদ ২৮•৫২
কেদার ক পরিবর্ত বো নইব ৫২•৬৮
হার্দিক ক ইক্রম বো আফতাব ৭•৯
শামি বো নইব ১•২
কুলদীপ ন. আ. ১•১
বুমরা ন. আ. ১•১
অতিরিক্ত ৭
মোট ২২৪-৮ (৫০)
পতন: ১-৭ (রোহিত, ৪.২), ২-৬৪ (রাহুল, ১৪.২), ৩-১২২ (শঙ্কর, ২৬.১), ৪-১৩৫ (কোহালি, ৩০.৩), ৫-১৯২ (ধোনি, ৪৪.৩), ৬-২১৭ (হার্দিক, ৪৮.৪), ৭-২২২ (শামি, ৪৯.৩), ৮-২২৩ (কেদার, ৪৯.৫)।
বোলিং: মুজিব উর রহমান ১০-০-২৬-১, আফতাব আলম ৭-১-৫৪-১, গুলবাদিন নইব ৯-০-৫১-২, মহম্মদ নবি ৯-০-৩৩-২, রশিদ খান ১০-০-৩৮-১, রহমত শাহ ৫-০-২২-১।
স্কোর অসম্পূর্ণ।
আফগানিস্তান
জ়াজ়াই বো শামি ১০•২৪
নইব ক শঙ্কর বো হার্দিক ২৭•৪২
রহমত ক চহাল বো বুমরা ৩৬•৬৩
শাহিদি ক ও বো বুমরা ২১•৪৫
অসগর বো চহাল ৮•১৯
নবি ক হার্দিক বো শামি ৫২•৫৫
নাজিবুল্লাহ ক চহাল বো হার্দিক ২১•২৩
রশিদ স্টাঃ ধোনি বো চহাল ১৪•১৬
ইক্রম ন. আ. ৭•১০
আফতাব বো শামি ০•১
মুজিব বো শামি ০•১
অতিরিক্ত ১৭ মোট ২১৩ (৪৯.৫)
পতন: ১-২০ (জ়াজ়াই, ৬.৩), ২-৬৪ (নইব, ১৬.৫), ৩-১০৬ (রহমত, ২৮.৪), ৪-১০৬ (শাহিদি, ২৮.৬), ৫-১৩০ (অসগর, ৩৪.৬), ৬-১৬৬ (নাজিবুল্লাহ, ৪১.৩), ৭-১৯০ (রশিদ, ৪৫.৪), ৮-২১৩ (নবি, ৪৯.৩), ৯-২১৩ (আফতাব, ৪৯.৪), ১০-২১৩ (মুজিব, ৪৯.৫)।
বোলিং: মহম্মদ শামি ৯.৫-১-৪০-৪, যশপ্রীত বুমরা ১০-১-৩৯-২, যুজবেন্দ্র চহাল ১০-০-৩৬-২, হার্দিক পাণ্ড্য ১০-১-৫১-২, কুলদীপ যাদব ১০-০-৩৯-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy