অস্ত্রে শান: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের আগে প্রস্তুতি শামিদের। বুধবার। এপি
ছত্রিশ বছর আগের যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ। হঠাৎই দেখা হয়ে গেল বুধবারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে।
রবি শাস্ত্রী ভারতীয় দলের নেট প্র্যাক্টিস সেরে ড্রেসিংরুমে ফিরছিলেন। প্রাক্তন ক্যারিবিয়ান ফাস্ট বোলারকে দেখে ‘মাইকি, মাইকি’ বলে এগিয়ে এলেন। ‘মাইকি’ মানে মাইকেল হোল্ডিং তখন মাঠের মধ্যে সবে চেয়ার টেনে বসেছেন একটি চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে। উঠে এসে শাস্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন।
দেখে মনে হল, বিশ্বকাপে এই ম্যাচটার জন্য এটাই আদর্শ ছবি। তিরাশির সেই প্রেক্ষাপটই তো এই দ্বৈরথের সেরা আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। সময় সত্যিই কত কিছুই পাল্টে দিতে পারে! ছত্রিশ বছর আগের সেই তিরাশির বিশ্বকাপ ফ্ল্যাশব্যাকে গেলে উঠে আসবে অবিশ্বাস্য সব তথ্য। রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো কেউ যদি তিরাশি বিশ্বকাপের আগে ঘুমোতে গিয়ে থাকে আর ছত্রিশ বছর পরে চোখ মেলার চেষ্টার করে, অভাবনীয় সব বদল দেখে চরম বিভ্রান্তি তৈরি হবে।
সে দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল ফেভারিট, ভারত আন্ডারডগ। এখন ভারতই ফেভারিট, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আন্ডারডগ। এই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই শুরু হয়েছিল কপিল দেবের দৈত্যদের অভিযান। তখন তাঁরা মোটেও দৈত্য নন, নেহাতই বিশ্ব ক্রিকেটের দুগ্ধপোষ্য শিশু। মাঠের পাশেই রেলওয়ে ট্র্যাক। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটিংয়ে ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেনস, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ফউদ ব্যাকাস, ক্লাইভ লয়েড, জেফ দুঁজো। কত অনায়াসে তাঁরা ভারতীয় বোলারদের সেই রেলওয়ে ট্র্যাকে ফেলবেন, তা নিয়ে চর্চা ছিল তুঙ্গে।
এখন ক্রিস গেলের মতো ছক্কার রাজার উপস্থিতি সত্ত্বেও রেলওয়ে ট্র্যাক থেকে বল কুড়িয়ে আনা নিয়ে আলোচনা নেই। বরং বলাবলি হচ্ছে, বিরাট কোহালির ভারত কত বড় ব্যবধানে এই ম্যাচ জিততে পারে? সেই সময় ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারি আগুন ঝরাত। কপিলের দলের বিরুদ্ধে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে হাজির ছিলেন সেই বিখ্যাত পেস চতুর্ভুজ— রবার্টস, হোল্ডিং, মার্শাল, গার্নার। এখন ভারতের পেস বোলিং বিভাগ বেশি বারুদে ঠাসা। যশপ্রীত বুমরাকে বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলার বলা হচ্ছে। মার্শাল, রবার্টস, হোল্ডিংয়ের মতোই গতিসম্পন্ন তিনি। মহম্মদ শামি সদ্য হ্যাটট্রিক করে এসেছেন। ভুবনেশ্বর কুমারও অনেক ফিট। এ দিন ভুবিকে টানা বোলিং অনুশীলন আর ফিটনেস ট্রেনিং করিয়ে যাওয়া হল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁকে খেলানোর বিশেষ প্রলোভন রয়েছে। ক্রিকেট দুনিয়ায় ভুবি পরিচিত গেল-ঘাতক বলে। তাঁর ডান-হাতি ইনসুইং বাঁ-হাতি গেলের জন্য আউটসুইং হয়। আর কোনাকুনি বেরিয়ে যাওয়া সেই বলেই সব চেয়ে অস্বস্তিতে থাকেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বাদশা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ কার্যত বিশ্বকাপের দৌড় থেকেই হারিয়ে গিয়েছে। আর ভারত এই ম্যাচ জিতলেই শেষ চারের হাইওয়েতে নিশ্চিত। তাই যেখানে শুরু হয়েছিল, কপিল দেবের দলের অভিযান, সেখানেই কোহালিদের নিয়ে স্বপ্ন আরও রঙিন হয়ে উঠতে পারে। আর ম্যাঞ্চেস্টার এ দিনই প্রথম রোদ ঝলমলে হয়ে উঠল। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, বৃহস্পতিবারও রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। তার মানে ক্লান্তিকর, ঘ্যানঘ্যানে সেই ‘রেনচেস্টার’ নয়, ‘সানচেস্টার’। তার সঙ্গে ক্রিকেটীয় পূর্বাভাস যদি মিলিয়ে দিতে পারেন কোহালিরা, তা হলে রামধনুর রং ছড়িয়ে পড়তে পারে ভারতীয় ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে।
একাগ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচের প্রস্তুতি চলছে বিজয় শঙ্করের। বুধবার। এপি
কিন্তু ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে দাঁড়িয়ে কেউ কি পূর্বাভাস করার সাহস দেখাবে? তিরাশি বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ক্লাইভ লয়েডের দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের বিরুদ্ধে যখন এখানে খেলতে নামছে কপিলের ভারত, বাজির দর ছিল ৬৬-১। মানে ভারত জিতলে এক টাকায় ৬৬ টাকা পাওয়া যাবে। কাগজেকলমে এতটাই ফারাক ছিল দু’দলে। আর সকলকে বোকা বানিয়ে প্রথম ম্যাচেই অঘটন ঘটিয়ে দেয় ভারত। হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচে কপিলের দল জেতে ৩৪ রানে। মনে করা হয় ২৫ জুন লর্ডসে কপিলের হাতে বিশ্বকাপ ওঠার মুহূর্তটা তৈরি করে দিয়েছিল ৯ জুনের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। শাস্ত্রীও বারবার বলেন, ‘‘তিরাশির সেই ম্যাচটা জেতাই আমাদের দলের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছিল যে, আমরা যে কাউকে হারাতে পারি।’’
প্রথমে ব্যাট করে ২৬২ তুলেছিল ভারত। রান তাড়া করতে নেমে ব্যাটিং বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ একটা সময়ে হয়ে যায় ১৩০-৮। সবাই ধরে নিয়েছে ভারতের অঘটন ঘটানো নিশ্চিত। ঠিক সেই সময়েই অবিশ্বাস্য প্রত্যাঘাত শুরু করেন ক্যারিবিয়ান টেলএন্ডাররা। অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং এবং জোয়েল গার্নার মিলে শেষ দুই উইকেটে তোলেন ৯৮ রান। এর মধ্যে শেষ উইকেটে রবার্টস এবং গার্নার তোলেন ৭১ রান। শেষ দু’টি উইকেটই নিয়েছিলেন শাস্ত্রী। যে কারণে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড তাঁর জীবনের খুব উল্লেখযোগ্য এক স্টেশন। ‘‘সবাই বলে লর্ডস। আমি বলি ৯ জুনের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড না থাকলে ২৫ জুনের লর্ডস তৈরি হয় না,’’ মনে করেন তিনি। সে দিনের ক্রিকেটার এখন ভারতীয় দলের কোচ। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের সেই প্রথম ম্যাচের কথা মাথায় রেখে তিনি নিশ্চয়ই ছেলেদের জন্য কয়েকটা সতর্কবার্তা জারি করবেন। যেমন, ১) ক্রিকেট কাগজেকলমে খেলা হয় না। ফেভারিটই জিতবে, এমন কোনও কথা নেই। তা হলে তিরাশিতে আমরা দু’বার ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারতাম না। কে বলতে পারে, এ বারও ফেভারিট পতনের সেই পরম্পরা চালু থাকবে না? ২) ক্রিকেটে আন্ডারডগ বলে কিছু হয় না। সেই দিনটায় যে ভাল খেলে, তারাই জেতে। উদাহরণ? তিরাশি। ৩) এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্বর্ণযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়। ওদের ভিভ রিচার্ডস নেই, ক্লাইভ লয়েড নেই, গ্রিনিজ-হেনস নেই। রবার্টস-মার্শাল-হোল্ডিং নেই। তবু ক্রিস গেল আছে। নিজের দিনে যে কোনও বোলিংকে ধ্বংস করতে পারেন। কার্লোস ব্রাথওয়েট আছেন। এই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই গত শনিবার অবিশ্বাস্য ইনিংস খেলে নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে জিতিয়ে দিচ্ছিলেন দলকে। ৪) ম্যাচ শেষ না হওয়া পর্যন্ত জিতে গিয়েছি বলে ধরে নিও না। ছত্রিশ বছর আগে রবার্টস আর গার্নারের শেষ উইকেটের জুটি আমাদের চরম শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল।
আর সাউদাম্পটনে ভারতীয় দলের যে রকম ছিন্নভিন্ন অবস্থা হয়েছিল আফগানিস্তানের সামনেই, তার তুলনায় এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো অনেক কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মন্থর ব্যাটিং নিয়ে সরব ক্রিকেট দুনিয়া। সচরাচর যিনি সমালোচনা করেন না, সেই সচিন তেন্ডুলকর পর্যন্ত মুখ খুলেছেন।
ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা, ছত্রিশ বছর আগে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড প্রমাণ করে দিয়েছিল। কে বলতে পারে, বৃহস্পতিবার বিকেলে আবার তার সেই ইচ্ছা হবে না! আর এ বার কোহালিরা মুদ্রার উল্টো পিঠ! ফেভারিট হওয়ার ঝঞ্ঝাট তাঁদেরই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy