কাজে এল না জাডেজার ইনিংস। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। —ছবি রয়টার্স।
মার্টিন গাপ্টিলের সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট হয়ে ফেরার মর্মান্তিক দৃশ্য। টিভি রিপ্লে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি কাঁদছেন। যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠা মুখ। মাথা নাড়তে নাড়তে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সাত নম্বর জার্সি হারিয়ে গেল ভারতীয় ড্রেসিংরুমে।
একটু আগে যে-ড্রেসিংরুমের ব্যালকনি গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় ক্রিকেট-ভক্তদের সঙ্গে পেন্ডুলামের মতো দুলেছে আশা-আশঙ্কার স্রোতে। রবীন্দ্র জাডেজা এক-একটা ছক্কা মারছেন আর রোহিত শর্মা শিশুর মতো লাফিয়ে উঠছেন। যুজবেন্দ্র চহাল উত্তেজিত ভাবে উৎসব করছেন। জাডেজার একটি শট দেখে এক বার মনে হল, বিরাট কোহালিও যেন বললেন, ‘হো জায়েগা’। পাঁচ রানে তিন উইকেট আর ২৪ রানে চার থেকে অসাধারণ এক প্রত্যাবর্তনের কাহিনি লিখে ভারত ফাইনালে পৌঁছবে, এমন একটা রোদঝলমলে আকাশ তখন ম্যাঞ্চেস্টারে উঁকি দিতে শুরু করেছে। কে জানত, দুনিয়ার সেরা ফিনিশারের সামনেই তীরে এসে তরী ডোবার চিত্রনাট্য আজ কপালে লেখা রয়েছে। জয়ের কাছাকাছি এনেও পারল না জাডেজা-ধোনি জুটি। দু’জনেই আউট হয়ে গেলেন চার বলের ব্যবধানে আর ১৮ রানে হেরে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল ভারত।
এক দিকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের যন্ত্রণা। অন্য দিকে জোরালো চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে, চোখের জলে ধোনির প্যাভিলিয়নে ফেরার দৃশ্য ভারতের জার্সি গায়ে তাঁর বিদায়ী দৃশ্যও হয়ে থাকল কিনা। পরাজয়ের ধাক্কায় শোকস্তব্ধ কোহালি সাংবাদিক বৈঠকে বলে গেলেন, ধোনি অবসরের ব্যাপারে তাঁদের কিছু জানাননি। কিন্তু যে-রকম নিঃশব্দে ক্রিকেট সংসার ফেলে দিয়ে চলে যাওয়ায় বিশ্বাসী তিনি, সত্যিই বড় কোনও ঘোষণা হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। টেস্ট থেকে যখন অবসর নিয়েছিলেন, তখনও কাউকে জানতে দেননি। ম্যাচ শেষ হতেই সতীর্থদের জানান, আমি আর টেস্ট খেলছি না।
ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে একটা সময় যদিও মনে হচ্ছিল, আবার অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাবেন ‘ফিনিশার’। ঋষভ পন্থ বা হার্দিক পাণ্ড্যরা যখন বাজে শটে উইকেট উপহার দিয়ে গেলেন, তিনি খেলতে থাকলেন নিজের খেলা। কী সেই খেলা? না, বিলম্বিত করতে থাকো ভবিতব্যকে। বছরের পর বছর ধরে এটাই তো মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। প্রতিপক্ষ জানবে, একটা লোক শুধুই হারকে বিলম্বিত করে যাচ্ছে। যাক না, কত দূরে যেতে পারে! শেষ প্রহরে গিয়ে বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করবে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ধোনি জয় ছিনিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছেন।
সেমিফাইনালে অসম্ভবকে সম্ভব করার অভিযানে ধোনি সঙ্গী হিসেবে পেলেন জাডেজাকে। যাঁকে প্রথম একাদশের যোগ্য বলেই মনে করছিল না দল। আর সঞ্জয় মঞ্জরেকরের মতো প্রাক্তন আখ্যা দিয়েছিলেন ‘টুকরোটাকরা প্লেয়ার’। মানে একটু ব্যাটিং করেন, একটু বোলিং করেন, একটু ফিল্ডিংও করেন গোছের ক্রিকেটার। জাডেজা এমন এক ইনিংস খেললেন, যা তিরাশি বিশ্বকাপে কপিল দেবের টানব্রিজ ওয়েলসে খেলা ১৭৫ নট আউটের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছিল। সে-দিন জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষাৎ পরাজয়ের অন্ধকার থেকে কপিল অবিশ্বাস্য এক ইনিংস খেলে টেনে তুলেছিলেন দলকে। আজ জাডেজা যখন নামলেন, ভারত ৯২-৬। জিততে গেলে করতে হবে ২৪০। ধোনি ছাড়া কেউ নেই। সকলে ধরেই নিয়েছে, ম্যাচ শেষ। কপিলের মতোই অলৌকিক কিছু ঘটাতে হবে।
সেই পরিস্থিতি থেকে বিশ্বকাপের নতুন রেকর্ড গড়ে ধোনি আর জাডেজা যোগ করলেন ১১৬ রান। আর সেই জুটিতে শাসক ধোনি নন, জাডেজা। পাল্টা আক্রমণ করে নিউজ়িল্যান্ড বোলারদের উড়িয়ে দিচ্ছিলেন তিনি। বাঁ-হাতি স্পিনার মিচেল স্যান্টনার একটা সময় ছয় ওভারে সাত রান দিয়েছিলেন। হার্দিকেরা তাঁর বিরুদ্ধে সিঙ্গলসও নিতে পারছিলেন না। জাডেজা তাঁকেও মেরে দিলেন।
৪৮তম ওভারে জাডেজা যখন ট্রেন্ট বোল্টের শিকার হয়ে ফিরছেন, ভারতের স্কোর ২০৮। যে-পিচে রান করতে গিয়ে দু’দলের সব তারকা ব্যাটসম্যানেরও ঘাম ছুটে যাচ্ছিল, সেখানেই তিনি করলেন ৫৯ বলে ৭৭। কোহালি বলে গেলেন, তাঁর দেখা জাডেজার সেরা ইনিংস। নিউজ়িল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন আরও এক ধাপ এগিয়ে বললেন, ‘‘দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা এক পিচে ব্যাট করেছি আর জাডেজা অন্য পিচে।’’ হাফসেঞ্চুরি করে তাঁর বিখ্যাত তরোয়াল খেলাও দেখিয়ে দিয়েছেন জাড্ডু। তার পরে দু’হাত তুলে প্রশ্ন করার ভঙ্গিও করলেন। শেষের এই ভঙ্গিটা নিশ্চয়ই মঞ্জরেকরের জন্য যে, কী রে কী বলবি এ বার? আমি কি‘টুকরোটাকরা প্লেয়ারই’?
কিন্তু কে জানত, তরোয়াল খেলার পরেও শেষ দৃশ্যে লেখা আছে, জাডেজার টিমই রক্তাক্ত হবে! তিনি ফিরে যাওয়ার পরেও একটা ক্ষীণ আশা ছিল। ক্রিজে যে তখনও ‘ফিনিশার’ আছেন। ঊনপঞ্চাশতম ওভারের প্রথম বলে নিউজ়িল্যান্ডের সব চেয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন বোলার লকি ফার্গুসনকে আপারকাটে ছক্কা মেরে সেই প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে তুললেন ধোনি। গ্যালারিতে ভারতীয় দর্শকদের গর্জনে তখন কান পাতাই দায়। ২৪ রান দরকার ১১ বলে। কত বার করে দেখিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটের সেরা ‘ফিনিশার’।
কিন্তু ম্যাঞ্চেস্টার শুধু মুম্বইয়ের মতোই হয়ে থাকল, মুম্বই আর হল না। ২০১১-র ২ এপ্রিল ওয়াংখেড়েতে ছক্কা মেরে জেতানোর মাহিন্দ্রক্ষণ ফিরল না ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। জাডেজা আউট হয়ে যাওয়ায় স্ট্রাইক রাখার জন্য মরিয়া দু’রানের জন্য দৌড়লেন। গাপ্টিলের সরাসরি থ্রো উইকেটই শুধু ভাঙল না, ভেঙে দিল কোটি কোটি হৃদয়।
বিদায়: সেমিফাইনালে নিউজ়িল্যান্ডের কাছে হারের পরে স্টেডিয়ামে হতাশ খুদে সমর্থক। বুধবার। রয়টার্স
ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কোহালিকে দেখে মনে হচ্ছিল, যেন পৃথিবী ভেঙে পড়ছে মাথার উপরে। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যাওয়ার শক্তিটুকুও যেন নেই ভারতের সব চেয়ে ফিট ক্রিকেটারের। গেলেন অনেক পরে। ফিরে আসার সময় বিষণ্ণ চোখ গিয়ে পড়ল গ্যালারির দিকে। অনেকে তখনও তেরঙ্গা গায়ে জড়িয়ে শোকস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তাঁদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন। সেই হাত নাড়ার মধ্যে কোনও অভিবাদন গ্রহণ করার স্পর্শ নেই, বরং আছে প্রত্যাশা পূরণ করতে না-পারার অপরাধবোধ।
এক-এক সময় মনে হচ্ছে, রাউন্ড রবিন পর্বে এক নম্বর হিসেবে শেষ করেও ৪০ মিনিটের বাজে ক্রিকেটে স্বপ্নভঙ্গ হল কোহালিদের। শুরুতে ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরিদের সামনে দাঁড়াতেই পারলেন না রোহিত শর্মা, কেএল রাহুল এবং কোহালি নিজে। পাঁচ রানে তিন উইকেট দেখে ক্লাইভ লয়েডও কমেন্ট্রি বক্সে বসে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যেন। সেই লয়েড, যিনি জানেন, ফেভারিট হয়েও কাপ হারানোর যন্ত্রণা কী জিনিস। তিরাশি বিশ্বকাপে কপিলের দৈত্যেরা যে ১৮৩ রান নিয়েও তাঁর মহাতারকাখচিত টিমকে হারিয়ে দিয়েছিল।
কপিলের দলের হাতে ছিল ১৮৩। নিউজ়িল্যান্ডের হাতে ২৩৯। সে-দিনের মতো আজও কেউ ভাবতে পারেনি, কোহালিরা এই রানটা তুলতে পারবেন না।
ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা, এই তত্ত্ব আবার বলা হবে। পাশাপাশি, ভুললে চলবে না, বিশ্বকাপের টিম নিয়ে নানান প্রশ্নের জায়গা খোলা রাখার খেসারতও দিতে হল দলকে। ধোনির ইনিংস নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে ফের। এক পক্ষের মত, জাডেজার সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনিই শেষ পর্যন্ত লড়াই চালাচ্ছিলেন। আবার আর এক দলের বক্তব্য, ৫০ করলেও ৭২ বল নিয়েছেন। প্রচুর ডট বল (যে-বলে রান হয় না) খেলেছেন। তাতে রানরেটের চাপ বেড়ে গিয়েছিল।
তবু সেমিফাইনালের ‘ম্যাচ কা মুজরিম’ হিসেবে কোনও ভাবেই ধোনিকে বাছা যাবে না। সেই তিরস্কার প্রাপ্য ঋষভ পন্থ, হার্দিকের মতো স্টাইল ভাই তরুণ প্রতিভাদের। যাঁরা সেট হয়ে যাওয়ার পরেও উইকেট ছুড়ে দিয়ে এলেন। এবং মিডল অর্ডার নিয়ে ছিদ্র রেখে দেওয়া। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, সচিন তেন্ডুলকরের দেশ চার নম্বর হিসেবে বিজয় শঙ্করের বাইরে যোগ্য কাউকে পেল না, এটা নিউজ়িল্যান্ডের কাছে ভারতের হারের চেয়েও বড় বিস্ময়। দীনেশ কার্তিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটিয়েছেন ধোনিরও আগে, সেই ২০০৪-এ। আর বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেললেন ২০১৯-এ এসে। এত দিন ধরে জায়গা না-পেয়েও তিনি কী ভাবে এ বারের দলে ঢুকে পড়লেন? ধোনির ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী দলে মিডল অর্ডারে ছিলেন সুরেশ রায়না। যিনি ম্যাচ জেতানো ব্যাটসম্যান হওয়ার পাশাপাশি কয়েক ওভার বোলিং করে দিতে পারতেন। সেই ভূমিকায় এই দলে বাছা হয়েছে কেদার যাদবকে? কোনও তুলনা হতে পারে?
গোটা নিউজ়িল্যান্ডের জনসংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষেরও কম। শুধু মুম্বইয়েই তার দু’গুণ লোক থাকে। তবু উইলিয়ামসনদের দেশ রাশিয়া ফুটবল বিশ্বকাপে প্রায় যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছিল। রাগবিতে এক নম্বর। ক্রিকেট বিশ্বকাপে পরপর দু’বারের ফাইনালিস্ট। কোহালিরা পরপর দু’বার সেমিফাইনালে পরাভূত দল।
উইলিয়ামসনেরা আন্ডারডগ হিসেবে এসেছিলেন। দিনের শেষে তাঁদের স্ত্রী, পরিবারকে নিয়ে মাঠের মধ্যে ফাইনালে ওঠার উৎসব করলেন। কোহালিরা হট ফেভারিট হিসেবে এসেছিলেন। পরাজয়ের বজ্রপাতে হতাশ মুখে বেরিয়ে গেলেন। পরের বিশ্বকাপ? আসছে বছর নয়, আবার চার বছর পরে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy