তিনি নিজে তিরাশি বিশ্বকাপে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কপিলের দৈত্যদের এক জন। পঁচাশিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের প্রধান কারিগর এবং চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স। এ বারের কাপ অভিযানে বিরাট কোহালি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনিদের চাণক্য। ১৯৮৩-র ২৫ জুনের সেই ছবি কি ফিরবে ২০১৯-এর ১৪ জুলাই? কাপ অভিযান নিয়ে আনন্দবাজারের সঙ্গে দীর্ঘ, একান্ত আলাপচারিতায় ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। আজ শেষ পর্ব...
প্রশ্ন: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ফাইনালে ভারত যখন পাকিস্তানের কাছে ফাইনালে হারছে, আপনি কমেন্ট্রি বক্সে। এর পর কিছু দিনের মধ্যে যখন ফিরলেন হেড কোচ হিসেবে, দ্রুত একটা বদল আনলেন। অশ্বিনদের সরিয়ে কুলদীপ, চহালের মতো রিস্ট স্পিনার নিয়ে এলেন। ভাবনাটা কী ছিল এবং তার সঙ্গে জানতে চাইব, এই বিশ্বকাপে রিস্ট স্পিনাররা কতটা বড় ভূমিকা নিতে পারে?
রবি শাস্ত্রী: শুধু আমাদের জন্য নয়, বিশ্বকাপে সব দলের হয়েই রিস্ট স্পিনাররা বিরাট ভূমিকা নিতে চলেছে। মাঝের ওভারে উইকেট তুলতেই হবে। আমাদের দুই স্পিনার জুটি হিসেবে দারুণ। দু’জনের মধ্যে সুন্দর বোঝাপড়া রয়েছে। গত চোদ্দো-পনেরো মাস ধরে চহাল আর কুলদীপ দুর্দান্ত বল করেছে। আমার তো মনে হয়, এই বিশ্বকাপে ওরা ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। যখন আমরা রিস্ট স্পিনারদের নিয়ে এসেছিলাম, ভাবনাটা ছিল নতুন একটা জুটি তৈরি করার। এমন একটা জুটি, যারা বোলিং আক্রমণে প্রচুর বৈচিত্র যোগ করতে পারবে। যে কোনও রকম পরিবেশে উইকেট তুলতে পারবে। চহাল আর কুলদীপ এই চাহিদাগুলো দারুণ ভাবে পূর্ণ করতে পারছে।
প্র: কুলদীপ যাদব একটা দুঃস্বপ্নের আইপিএল কাটিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে আসছেন। অনেকে ভয় পাচ্ছেন, সেই প্রভাব না ইংল্যান্ডে পড়ে। আপনি কুলদীপকে কী বলবেন?
শাস্ত্রী: আমি আইপিএলে ওর বোলিংয়ের কোনও নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বকাপে পড়ার সম্ভাবনাই দেখছি না। বরং মনে হচ্ছে, আইপিএল কুলদীপকে জাগিয়ে তুলল। নিজের সঙ্গে বসে ও ভাবার সময় পেল যে, কোথায় ভুল হচ্ছে। কোন জিনিসটা অন্য রকম ভাবে করা উচিত। যেটা সাফল্যের মধ্যে থাকলে সাধারণত অনেকে করে না। এই ঝটকাটা ওকে নতুন ভাবে ভাবতে সাহায্য করবে, মনটাকে আরও সোজাসাপ্টা, পরিষ্কার করে দেবে। তা ছাড়া বিশ্বকাপ হবে পঞ্চাশ ওভারের। এটা আইপিএলের মতো কুড়ি ওভারের খেলা নয়। ওখানে মাত্র চার ওভার হাতে পায় একটা বোলার, এখানে দশ ওভার পাবে। দু’টো ফর্ম্যাট আলাদা, ভঙ্গিও আলাদা। পঞ্চাশ ওভারের বোলিং কুড়ি ওভারে করতে গেলে ব্যাটসম্যানেরা উড়িয়ে দিতে পারে। কুলদীপের বয়স কম, দুর্দান্ত প্রতিভা, গত এক বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দারুণ ভাবে সফল। আমি একেবারেই ঘাবড়ানোর কারণ দেখছি না।
প্র: মাঝে আপনি বলেছিলেন, বিরাট কোহালিকে তিনেও নামানো হতে পারে আবার চারেও খেলানো হতে পারে। বিশ্বকাপে কি এই ভাবনা চালু থাকতে পারে?
শাস্ত্রী: ব্যাপারটা হচ্ছে, ইংল্যান্ডের পরিবেশের জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হবে। অন্যান্য দেশে খেলা আর ইংল্যান্ডে খেলার মধ্যে তফাত আছে। এখানে রাতারাতি পরিবেশ পাল্টে যেতে পারে। ব্যাটিং স্ট্র্যাটেজিও সেই অনুযায়ী পাল্টে যেতে পারে। আমার তাই মত হচ্ছে, ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে নমনীয়তা দেখানো দরকার। পরিবেশ অনুযায়ী, ব্যাটিং অর্ডার সেট করতে হবে ইংল্যান্ডে। কিন্তু যদি বিরাটের কথা ওঠে, চোখ বুজে বলে দিচ্ছি, তিন নম্বরটাই ওর জায়গা। এমন কয়েকটা দিন আসতে পারে যখন মাথার উপরে আকাশের অবস্থা অন্য রকম। যেটা ইংল্যান্ডে দুম করে হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো আমাদের মনে হতে পারে, বিরাটকে আরও একটু ধরে রেখে পাঠাই। তখন অন্য কাউকে তিনে পাঠিয়ে বিরাটকে চার নম্বরের জন্য ধরে রাখার কথাটা ভেবে দেখাই যেতে পারে। সেই তারতম্যটা একান্তই পরিবেশ-নির্ভর এবং ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে। যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন বিরাটের নম্বর কত, তা হলে এক কথায় বলব, তিন নম্বর। বিরাট ওখানেই নামবে, যদি না পরিবেশ বাধ্য করে আমাদের অন্য রকম সিদ্ধান্ত নিতে।
প্র: সবাই বলতে শুরু করেছে, এই বিশ্বকাপে সমস্ত ব্যাটিং রেকর্ড ভেঙে যাবে। এতটাই ব্যাটসম্যান সহায়ক বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে ইংল্যান্ডে। আপনার কী মনে হচ্ছে?
শাস্ত্রী: গত কয়েকটা আইসিসি ইভেন্ট যদি খেয়াল করেন, প্রত্যেকটাতেই ভাল ব্যাটিং উইকেট হয়েছে। সকলেই এখন হাই স্কোরিং ম্যাচ চায়, যাতে দর্শকেরা খেলা দেখতে আসে। মনোরঞ্জন পায়, বিনোদন থাকে। তাই ইংল্যান্ডে এই বিশ্বকাপেও বেশির ভাগ জায়গায় ব্যাটিং-বন্ধু বাইশ গজ দেখতে পেলে আমি অবাক হব না। আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডে যদি আবহাওয়া ঠিক থাকে, দুর্ধর্ষ একটা বিশ্বকাপ হতে চলেছে।
প্র: অধিনায়ক বিরাট কোহালি। তাঁকে নিয়ে চর্চা যেন থামে না। বিশ্বকাপে প্রথম বার নেতৃত্ব দিতে চলেছেন বিরাট। হেড কোচের কী প্রত্যাশা তাঁর অধিনায়কের থেকে?
শাস্ত্রী: অধিনায়ক হিসেবে বিরাট অনেক পরিণত হয়ে উঠেছে। প্রত্যেক দিন আরও উন্নতি করছে। আমি মনে করি, অধিনায়ক বিরাটের পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এখনও চলছে। এটাও মনে রাখতে হবে যে, তিনটে ফর্ম্যাটে অধিনায়কত্ব করা সহজ কাজ নয়। তিনটে ফর্ম্যাটে তিন ধরনের মানসিকতা চাই। ওয়ান ডে-তে খুব দ্রুত ভাবতে হয়। টি-টোয়েন্টিতে ভাবনাটা আরও এক্সপ্রেস গতিতে করতে হবে, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকতে হবে। পরে কী হতে চলেছে, সেটা আগে ভেবে নিতে হবে। টেস্ট আবার ক্যাপ্টেনের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়। সকলেই পথ চলতে চলতে, নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে গিয়ে শেখে। বিরাটও শিখছে। কোনও সন্দেহ নেই যে, ও দ্রুত উন্নতি করছে। এখন অনেক অভিজ্ঞ আর পরিণত হয়েছে। প্রত্যেক দিন আরও পরিণত হচ্ছে।
প্র: আর স্টাম্পের পিছনে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে পাওয়া। সেটা কতটা সাহায্য করবে দলকে?
শাস্ত্রী: আমাদের বিশ্বকাপ অভিযানে ধোনির ভূমিকা বিশাল হতে যাচ্ছে। ধোনি এমন একটা নাম, যাকে বিশ্ব ক্রিকেটে প্রত্যেক প্রতিপক্ষ সমীহ করে, সম্মানে মাথা ঝোঁকায়। এখনও ওয়ান ডে ক্রিকেটে সম্ভবত বিশ্বের সেরা উইকেটকিপার ও। বিদ্যুতের গতিতে স্টাম্প করছে, উইকেটের কাছে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ ধরছে। আইপিএলের সময়েও ও দেখিয়েছে, উইকেটকিপিং আর ব্যাটিং দু’টোতেই এখনও শাসন করতে পারে। আমি এ সব কিছুরও আগে একটা কথা বলব। ধোনি যে কত বড় চ্যাম্পিয়ন, বার বার প্রমাণ করেছে। বছরের পর বছর ধরে কী সব ম্যাচ জিতিয়েছে ভারতকে! কী দুর্দান্ত এক ক্রীড়াবিদ! কী দুর্ধর্ষ ম্যাচউইনার! এখনও কী অসম্ভব ফিট! ওর বিশাল অভিজ্ঞতাটাই তো দলের জন্য অমূল্য সম্পদ। আর সব কিছুর উপরে রয়েছে একটা তথ্য— ধোনি আমাদের দেশকে দু’টো বিশ্বকাপ উপহার দেওয়া এক চ্যাম্পিয়ন!
প্র: রোহিত শর্মা, শিখর ধওয়ন, বিরাট কোহালি, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। ব্যাটিংয়ের মহাশক্তি ভারত। বিশ্বকাপ জেতানোর মতো ব্যাটিং লাইন আপ?
শাস্ত্রী: আমাদের ভাল শুরু করতে হবে। যদি সেটা করে ফেলা যায়, তা হলে ওদের সকলের থেকে আকর্ষণীয় ব্যাটিং দেখার আশা করতেই পারেন ক্রিকেট ভক্তরা। আমাদের ব্যাটিংয়ে এ বার বৈচিত্র আছে, গভীরতা আছে। হার্দিক ফিরে এসেছে। ভুবি (ভুবনেশ্বর) এসে গিয়েছে। তার মানে ছয়-সাত-আট নম্বরেও ভাল ব্যাট করার লোক আমাদের হাতে রয়েছে। তবে আবার বলছি, প্রত্যেক বারের মতো এ বারও বিশ্বকাপে শুরুটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে।
প্র: ঋষভ পন্থকে হেড কোচ কী বলবেন? এক দিকে তাঁকে আপনি তৈরি করছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে। আবার বিশ্বকাপের বাস মিস হওয়ার ঝটকা। কী উপদেশ দেবেন আপনি?
শাস্ত্রী: বিশ্বকাপের দল নির্বাচনের পরে আমার সঙ্গে ঋষভের দেখা হয়নি। তবে যখন দেখা হবে এটাই বলব যে, তোমার সুযোগ নিশ্চয়ই আসবে। নিজের কাজ করে যাও, পরিশ্রম করে যাও। এই বিশ্বকাপের জন্যও বলব, নিজেকে ফিট রেখে যাও। কারণ, কেউ জানে না কার কখন চোট লাগে, কখন কী হয়ে যায়! যদি সত্যিই সে রকম পরিস্থিতি তৈরি হয় আর তুমি ডাক পাও, তা হলে সেই সুযোগকে দু’হাতে লুফে নেওয়ার জন্য যেন তুমি তৈরি থাকো।
প্র: ভারতীয় ক্রিকেটে বিদেশি কোচেদের হুজুগ কমিয়ে ভারতীয়রা এখন পথ দেখাচ্ছেন। হেড কোচ আপনি, বোলিং কোচ বি অরুণের অধীনে ভারতীয় বোলিং বিশ্বের বন্দনা আদায় করে নিয়েছে। বিশ্বকাপেও কি স্বপ্ন দেখাচ্ছে বোলিং?
শাস্ত্রী: অবশ্যই। আমি সব চেয়ে খুশি এটা দেখে যে, আমাদের সেরা বোলাররা সকলে ফিট। এই যে আপনি বলছেন, ভারতীয় বোলিং বিশ্বের বন্দনা জিতে নিয়েছে, সেটাও কিন্তু ঘটেছে চোট-আঘাতের ধাক্কার মধ্যে। গত ইংল্যান্ড সফরে অনেকটা সময় আমরা বুমরাকে পাইনি। ভুবনেশ্বরকে পুরো মরসুম পাইনি। শামি সব সময় ফিট ছিল না। কিন্তু এ বারে ইংল্যান্ডে পুরোপুরি ফিট বোলিং টিমকে পাচ্ছি। এটা আমাদের দলের জন্য খুবই ভাল লক্ষণ।
প্র: শেষ প্রশ্ন। ২৫ জুন, ১৯৮৩-র লর্ডসে বিশ্বকাপ জিতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভারতীয় দলের সদস্য। ১৯৮৫-র ১০ মার্চ, মেলবোর্নে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সদস্য এবং টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়ন অফ চ্যাম্পিয়ন্স। এ বারের তিনি হেড কোচ। তৃতীয় বার কাপ ঘরে আনতে গেলে কী করতে হবে? সব চেয়ে জরুরি সেই উপদেশ কি যা আপনি ছেলেদের মনে করিয়ে দিতে চাইবেন?
শাস্ত্রী: বলব, বর্তমানে বাস করো। একটা-একটা করে ম্যাচ হিসেবে লড়াইটাকে নাও কিন্তু শুরু থেকেই সর্বস্ব দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। শিকারির মতো মনোনিবেশ করো আর এক ঝলকের জন্যও শিকারের উপর থেকে চোখের পলক ফেলবে না। প্রত্যেকটা ম্যাচ নতুন ম্যাচ হবে, প্রত্যেক প্রতিপক্ষ আলাদা। প্রত্যেক প্রতিপক্ষকে সম্মান দেখাও তবে মাঠে সব ম্যাচেই তীব্রতাটা যেন একই রকম থাকে। বিশ্বকাপে এ বারের ফর্ম্যাটটা এমনই যে, কোনও হাল্কা ম্যাচ নেই। ওই যে বললাম, শিকারির মনোনিবেশ চাই। চোখের পলক ফেলা যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy