উচ্ছ্বসিত: বুমরার আত্মবিশ্বাসে মুগ্ধ ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি ওয়ালশ। এপি
শাকিব-আল-হাসান, মুস্তাফিজ়ুর রহমানদের নিয়ে গর্বিত তাঁদের বোলিং কোচ। নিজে কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার। মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন দেখে, ভারত একের পর এক এক্সপ্রেস গতির পেসার তুলে আনছে। বিশ্বকাপের সেরা বোলারদের মধ্যে বেছে নিচ্ছেন যশপ্রীত বুমরাকে। মনে করছেন, ভারত আর অস্ট্রেলিয়াই ফাইনাল খেলবে। হোল্ডিং-মার্শাল-রবার্টস পরবর্তী যুগে ক্যারিবিয়ান পেস ব্যাটারির সেরা প্রতিনিধি কোর্টনি ওয়ালশ একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে। জানিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের বোলিং কোচ হিসেবেও আর থাকছেন না তিনি।
প্রশ্ন: বাংলাদেশ এ বারের বিশ্বকাপে সকলের হৃদয় জিতে নিয়েছে। আপনি কী বলবেন?
কোর্টনি ওয়ালশ: আমি খুশি। ছেলেরা ভাল ক্রিকেট খেলেছে। জেতার খিদে দেখিয়েছে, তীব্রতা দেখিয়েছে। আর সেই মনোভাবের প্রতিফলনই ঘটছিল আমাদের পারফরম্যান্সে। আমি সব চেয়ে খুশি ধারাবাহিকতা দেখে। হয়তো আমরা সেমিফাইনালের টিকিট অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু গোটা বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ভাবে ভাল ক্রিকেট খেলে গিয়েছে বাংলাদেশ।
প্র: শাকিব-আল-হাসানকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত ক্রিকেট দুনিয়া। আপনিও নিশ্চয়ই খুব খুশি?
ওয়ালশ: বিশ্বকাপের ইতিহাসে আমার দেখা সেরা পারফরম্যান্সগুলোর একটা করে দেখাল শাকিব। এত ধারাবাহিকতা ক’জন দেখাতে পেরেছে বিশ্বকাপে? চলতি টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ স্কোরারও ছিল শাকিব। দু’টো সেঞ্চুরি, পাঁচটা হাফ সেঞ্চুরি। কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট হবে না শাকিবের জন্য।
প্র: বিশ্বকাপের চার সেমিফাইনালিস্ট ঠিক হয়ে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইংল্যান্ড, নিউজ়িল্যান্ড। এই চার দলের মধ্যে কাকে বেশি শক্তিশালী লাগছে?
ওয়ালশ: সেমিফাইনালের চারটে টিমের মধ্যে আলাদা করে কাউকে বেছে নেওয়া কঠিন। কাগজেকলমে তিনটে দল বেশি করে সকলের নজরে রয়েছে। ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড। সে দিক দিয়ে বলতে গেলে নিউজ়িল্যান্ড সেমিফাইনালের লড়াইয়ে কিছুটা ডার্ক হর্স হিসেবে শুরু করবে। ভারতকে হারানোর পরে ইংল্যান্ড আবার চনমনে হয়ে উঠেছে। ওরা ভাল ক্রিকেট খেলছে। তবে আমার মনে হচ্ছে, ভারত আর অস্ট্রেলিয়াই ফাইনালে খেলবে।
প্র: এ রকম মনে হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট কারণ?
ওয়ালশ: ভারত আর অস্ট্রেলিয়া বেশি ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে খেলতে নামবে। এই জয়গুলো ওদের বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুললে অবাক হব না। তা ছাড়া আমার মনে হয়, এই দু’টো দলের বৈচিত্র আর গভীরতা বেশি। ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা। তাই জোর দিয়ে কিছু বলা যায় না। ইংল্যান্ড তাদের দিনে যে-কোনও দলকে হারিয়ে দিতেই পারে। নিউজ়িল্যান্ড অঘটন ঘটাতেই পারে। সেগুলোও তো ক্রিকেটের অঙ্গ। কে ভেবেছিল, তিরাশিতে আপনারা আমাদের হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতবেন? তবু তো সেটাই ঘটেছিল। তবে আমি একেবারেই কাগজেকলমে হিসাব করে পূর্বাভাস করলাম যে, ভারত আর অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল হবে। ক্রিকেট, মহান ক্রিকেট আমাকে ফের বোকা বানিয়ে দিতেই পারে।
যোদ্ধা: শাকিবের ধারাবাহিকতায় সন্তুষ্ট বোলিং কোচ। ফাইল চিত্র
প্র: আপনি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলার। ভারতীয় পেস বোলিংয়ের বিবর্তন দেখে কী মনে হচ্ছে?
ওয়ালশ: অভাবনীয়! আমরা বরাবর দেখে এসেছি, ভারত স্পিনারদের দেশ। শুধু কপিল দেব ছিলেন। কিন্তু কপিল খুব এক্সপ্রেস গতির ফাস্ট বোলার ছিলেন না। সুইং ও সিম নির্ভর অসাধারণ এক মিডিয়াম পেসার ছিলেন। এখন ভারতীয় দলের পেসাররা গতিতে বিশ্বের সকলের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। বিশ্বের যে কোনও প্রতিপক্ষকে গতি আর বাউন্সে আতঙ্কিত করে তুলছে। এটা সত্যিই অবিশ্বাস্য পরিবর্তন। ভারত এখন ম্যাচ জেতার জন্য স্পিনার নয়, ওদের পেস বোলারদের উপর নির্ভর করে। আমার মনে হয়, এই পরিবর্তনটাই ওদের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। দারুণ সব পেস বোলার রয়েছে বলে যে কোনও পরিবেশে, যে কোনও দেশে গিয়ে ওরা ভাল করতে পারছে। আমাদের সময়ে যে ভারতীয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজে খেলতে আসত, তখন দাঁড়িয়ে ভাবা সম্ভবই ছিল না যে, ভবিষ্যতে একঝাঁক ভারতীয় পেসার দেখতে পাব যারা নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল করবে! আমার মনে হয়, এ বার ভারতের কাপ জেতার আশা বাড়িয়ে দিচ্ছে ওদের বোলিংই। ভাল স্পিনার তো আছেই, বিশ্ব মানের পেস বিভাগও রয়েছে কোহালির হাতে।
প্র: যশপ্রীত বুমরাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সকলে। আপনি কী বলবেন?
ওয়ালশ: বুমরার মনোভাবটা আমার সব চেয়ে ভাল লাগে। কখনও ওকে নিজের উপর আস্থা হারাতে দেখি না। দুর্দান্ত স্কিল তো রয়েইছে কিন্তু বুমরার প্রধান অস্ত্র ওর আত্মবিশ্বাস। বোলারের জীবনে ভাল দিন যেমন আসবে, তেমনই মুখোমুখি হতে হবে খারাপ দিনের। তখন এই আত্মবিশ্বাসটাই বড় হয়ে দেখা দেবে। বুমরা নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলারদের এক জন।
প্র: বাংলাদেশের মুস্তাফিজ়ুর রহমানের অগ্রগতি দেখেও নিশ্চয়ই আপনি খুশি?
ওয়ালশ: খুবই খুশি। মুস্তাফিজ়ুর বিশেষ এক প্রতিভা। চোট-আঘাতে ভুগছিল। আমি বিশ্বকাপের আগে বলেছিলাম, ফিট মুস্তাফিজ়ুরকে আমাদের দরকার। বিশ্বকাপে এসে পুরো শক্তি লাগিয়ে বল করতে পারছিল মুস্তাফিজ়ুর। আমি ওকে প্রথম দেখেই বুঝেছিলাম, জন্মগত প্রতিভা। সেই কারণে কখনও ওর সহজাত ধরনকে পাল্টানোর চেষ্টা করিনি। মুস্তাফিজ়ুরের জীবনে আরও অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত অপেক্ষা করছে।
প্র: ভারতের সঙ্গে হারার পরে কি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন?
ওয়ালশ: না, আমি হতাশ হইনি। সব সময়ই আমি বরং এটা ভেবে খুশি হয়েছি যে, ছেলেরা ভাল ক্রিকেট খেলেছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ভারতের সঙ্গে ম্যাচটাতেও শেষ পর্যন্ত লড়াই করেছি আমরা। এই বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের এটাই শিক্ষা। জেতার কাছাকাছি এসেও আমরা জিততে পারিনি। এই অন্তিম ধাপটা পেরনো শিখতে হবে।
প্র: চলতি বিশ্বকাপে কোন ফাস্ট বোলারদের ভাল লাগল?
ওয়ালশ: মিচেল স্টার্ক দারুণ বল করছে। অস্ট্রেলিয়ার এই ধারাবাহিকতার কারণ স্টার্ক। ইংল্যান্ডের জোফ্রা আর্চার আর মার্ক উডকে আমার ভাল লেগেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেমার রোচ দেখাল, এখনও ওর মধ্যে অনেক ক্রিকেট অবশিষ্ট আছে। আর ভাল লেগেছে ভারতের বুমরা এবং বাংলাদেশের মুস্তাফিজ়ুর রহমানকে।
প্র: সকলের হৃদয় জিতে নিয়েও কেন পারল না বাংলাদেশ?
ওয়ালশ: আমরা কতগুলো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচে দারুণ লড়াই করেও হেরে গেলাম। কাছাকাছি এসেও পারলাম না শেষ ধাপটা জয় করতে। সেই কারণেই সম্ভবত সেমিফাইনাল শুরুর আগে বাংলাদেশের বিশ্বকাপ অভিযান শেষ হয়ে গেল। আশা করব, এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট।
প্র: আর আপনার নিজের দেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ? অনেক আশা জাগিয়ে এসেও কি হতাশ করল?
ওয়ালশ: আমাদের দেশের ক্রিকেট ভক্তরা এ বার স্বপ্ন দেখছিল। কারণ, টিমটা সত্যিই ভাল ছিল। ম্যাচ জেতানোর মতো অনেক ক্রিকেটার ছিল এ বারের দলে। তাই আর একটু ভাল পারফরম্যান্সই সকলে আশা করেছিল হয়তো। খেলোয়াড় এবং কর্তাদের এখন সৎ ভাবে বিশ্বকাপের ময়নাতদন্ত করতে হবে। কেন ভাল দল নিয়েও পারলাম না, সেই বিশ্লেষণটা জরুরি। তবে ইতিবাচক মনোভাব ছাড়লে চলবে না।
প্র: আপনার এখন পরিকল্পনা কী?
ওয়ালশ: বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল বিশ্বকাপ পর্যন্তই। সেটা শেষ হয়ে গেল। এর পর কয়েক দিন বিশ্রাম নেব আমি। টানা অনেক দিন ধরে ছুটছি। বিশ্রাম নিয়ে তার পরে ভাবব, আমার পরবর্তী ঠিকানা কী হবে।
প্র: তার মানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে আর থাকছেন না?
ওয়ালশ: না, চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। এ বার বাড়ি ফেরার পালা। ইংল্যান্ডে কয়েক দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরে যাব জামাইকায়। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য আমার শুভেচ্ছা রইল। দুর্দান্ত একটা সময় আমি কাটিয়ে গেলাম। দারুণ সব ছেলেকে পেয়েছি। দুর্দান্ত সব প্রতিভা দেখেছি। আমি নিশ্চিত, ভবিষ্যতে ক্রিকেট মাঠে অনেক গৌরবই অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য।
প্র: শেষ প্রশ্ন। বিশ্বকাপ মানেই সকলের মনে চলে আসে সেই ঘটনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ। শেষ বলটা করতে গিয়ে দেখলেন নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে সেলিম জাফর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। হাত ঘুরিয়ে আউট করে দিলেই আপনারা জিতে যান। কিন্তু করলেন না। এখন ফলাফল নির্ভর এই ক্রিকেট দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলে কি অনুশোচনা হয়?
ওয়ালশ: একটুও অনুশোচনা হয় না। আমি সে দিন ঠিক কাজ করেছিলাম বলে মনে করি এবং এখনও যদি একই পরিস্থিতি হয়, আমি আউটটা করব না। এই ধরনের আউট করার আগে ব্যাটসম্যানকে সতর্ক করা উচিত বলে আমি মনে করি। খেলার মাঠে আমি সব সময় জিততেই চেয়েছি। মনেপ্রাণে চেয়েছি, প্রত্যেকটা ম্যাচ আমাদের হোক, প্রত্যেকটা মুহূর্তে আমরাই শাসন করি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেই সময়ে হারার কথা ভেবে ক্রিকেট খেলত না। কিন্তু খেলোয়াড়ি মনোভাব বিসর্জন দিয়ে সেই জয় আসুক, কখনও চাইনি। ক্রিকেট জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বিশ্বকাপ না থাকার জন্য আক্ষেপ হয় ঠিকই। কিন্তু কখনও মনে হয়নি, সেলিম জাফরকে সে দিন আউটটা করে দিলাম না কেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy