টনটনে ব্যাঘ্র-গর্জন। উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের সমর্থকরা। ছবি: এএফপি।
সালটা ১৯৯৯। বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রথমবার পা রেখেই সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন ১১ জন বাঙালি। পাকিস্তানকে হারিয়ে জানান দিয়েছিলেন, ‘আমরাও এসে গিয়েছি’। বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম ‘দাদা’দের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে যে লড়তে পারে বাঙালিরাও, সেই প্রথম প্রমাণ দিয়েছিল পদ্মাপারের দেশটা।
ঠিক সেবারই বিশ্বকাপ-অভিষেক হয়েছিল আরও এক বাঙালির। ‘বাপি বাড়ি যা’ শটে যিনি বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কাকে মাঠের বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। বিশ্ব ক্রিকেটে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের উত্থান এ বঙ্গের একটা প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিল। বেহালার বীরেন রায় রোডের ছেলেটা যদি পারে, তা হলে বাকিরা পারবে না কেন?
কাট টু ২০১৯।
টনটনের মাঠে দু’ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে আরও কিছু করে দেখানোর স্বপ্ন দেখাচ্ছে বঙ্গ একাদশ। ঠিক এমন একটা সময়ে আর এক বাংলা বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছে প্রেসবক্সে বসে। সেই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু আসল যুদ্ধক্ষেত্রে নেই একজনও। পশ্চিমের বাঙালি শুধুই দর্শক।
আরও পড়ুন: শাকিবই কি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার? দেখে নিন রেকর্ড
আরও পড়ুন: ২০ বছর আগে শাকিবের এই মাঠেই দাদগিরি করেছিলেন আর এক বঙ্গসন্তান
সৌরভ তো বহু আগে ব্যাট-প্যাড তুলে রেখেছেন। তাঁর স্বপ্নের ব্যাটনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কেউ এ মুহূর্তে নেই। বিরাট কোহালির এই নীল জার্সির দলে ঢুকতে পারত, একটুর জন্য হল না, না, এমন নামও নেই। মহারাজের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই যেন স্তিমিত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ক্রিকেট-আভা। ঘরের পাশের আরশি নগরের একদল বাঙালি এ বার সগর্বে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বিশ্বকাপের আসরে। ওরা পারছে। আমরা পারছি না কেন? এই কথাটাই যেন বুদবুদ হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে এপার বাঙালির বুকের মধ্যে।
বিশ্বকাপে চলছে বাংলাদেশের স্বপ্নের দৌড়।
সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায়? কবি জয় গোস্বামী বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জেদ, তারুণ্য, তেজ, সাহস, সবটাই অবাক করে। এ পার বাংলায় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সেটা দেখা যায় না। এখনও দেখি সন্তানের কিটব্যাগ মা-বাবারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তবুও রঞ্জি ট্রফি জিততে পারছে না বাংলা। বাংলার ক্রিকেটের এই হতশ্রী দশা দেখলে বিষণ্ণই লাগে।’’
বঙ্গ ক্রিকেটের এই টিমটিমে অবস্থা কেন? ঋদ্ধিমান সাহা আশা জাগিয়েও হঠাৎই মূলস্রোত থেকে দূরে সরে গেলেন। বাংলা থেকে বিরাট কোহালির সংসারে রয়েছেন একমাত্র মহম্মদ শামি। কিন্তু, তিনি তো বাংলার নন। এই রাজ্য থেকে বিশ্বকাপের দলে টিকিট পাচ্ছেন না কেন কোনও ক্রিকেটার? জয় বলছেন, ‘‘নির্বাচকদেরও আমার এ ক্ষেত্রে কিছুটা দায়ী বলে মনে হয়। বাংলার ক্রিকেটারদের সুযোগ কি তাঁরা তুলনায় কম দিচ্ছেন?’’ এমন বঞ্চনার অভিযোগ বাংলার ক্রিকেটে ইতিহাসে বার বার উঠেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সত্যিই কি জাতীয় নির্বাচকরা যোগ্য বাঙালি ক্রিকেটারদের উপেক্ষা করছেন? বাংলার রঞ্জি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এই মুহূর্তে ভারতের জার্সি পরে খেলার মতো ছেলে বাংলায় নেই। এটাই দুঃখজনক।’’ স্বাধীন ভারতে, তাঁর হাত ধরেই প্রথম এবং শেষ বার রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল বাংলা।
সৌরভের হাত থেকে ব্যাটন নেবেন কে?
এ দেশের ক্রিকেটে তো বাঙালি বরাবরই পিছিয়ে। ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবলেও’, বাঙালি খেলোয়াড়ের সংখ্যা হু হু করে কমছে জাতীয় দলে। খেলার মাঠে সার্বিক ভাবে বাংলার দাপট কমে যাওয়ার আক্ষেপ শোনা গেল ফুটবলপ্রেমী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র গলায়। তাঁর কথায়, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেট দলে একজনও বাঙালি নেই, এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। নতুন ক্রিকেটার তুলে আনার বিষয়ে সিএবি-র ভূমিকা আদৌ কতটা রয়েছে, তা কিন্তু ভেবে দেখা দরকার। তবে শুধু ক্রিকেটে নয়, ফুটবলে বা অন্যান্য খেলাতেও বাঙালির অবস্থা একই রকম। দু’ দিন আগে বাবলুদার (সুব্রত ভট্টাচার্য) সঙ্গে কথা হচ্ছিল। ভারতীয় ফুটবল দলে কোচ হয়ে এসেছেন ইগর স্টিমাচ। তাঁর দলে মাত্র দু’ জন বাঙালি ফুটবলারকে রেখেছেন। একসময়ে এটা ভাবাই যেত না। অতীতে জাতীয় ফুটবল দলে আশি শতাংশই বাঙালি ফুটবলার ছিলেন। কিন্তু এখন আর তেমন ফুটবলারও উঠে আসছেন না। বিষয়টা ভাববার মতো।’’
খেলার দুনিয়ায় বাংলার এই ‘নেই নেই’ ছবি কেন? সমস্যার গভীরে ঢোকার চেষ্টা করছেন বাবুল, ‘‘আমার মনে হয়, এ পার বাংলার ছেলেমেয়েরা এখন অনেক বেশি আরামের বা নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। খেলার দুনিয়ায় কেরিয়ার গড়া যাবে কি না, তা নিয়ে হয়তো অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।’’
ঋদ্ধিমান সাহা এখন অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছেন।
গত বেশ কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, হারুক বা জিতুক, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা মাঠে অন্য এক খিদে অনুভব করেন। অসম্ভবকে সম্ভব করার এক প্রবল তাগিদ বার বার ফুটে বেরোতে দেখা যাচ্ছে শাকিব, মাশরাফি, তামিম, মুশফিকুরদের। সেই মানসিক তেজ কি এ পার বাংলার খেলোয়াড়দের মধ্যে কম? জয় বলছেন, ‘‘গোটা বাংলাদেশ ক্রিকেট মাঠে যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তাতে বোঝা যায় তারা এই খেলাকেই জাতীয়তাবাদের অন্যতম হাতিয়ার করে নিয়েছে। আমাদের দেশের বাঙালি তরুণদের বেশির ভাগের মধ্যেই সেই মানসিক জোর বা তেজ দেখি না।’’ বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক লক্ষ্মী আবার তা মানতে চান না। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ একটা দেশ। পশ্চিমবঙ্গ একটা রাজ্য। এ ভাবে তো তুলনা হয় না। সব দেশের স্পোর্টসম্যানদেরই মানসিক জোর থাকে।’’
গোটা বিষয়টাকে অন্য দিক থেকে দেখছেন সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী। তিনি বলছেন, ‘‘আমাদের বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের চেহারা বিভিন্ন। প্রাকৃতিক বৈচিত্রের কারণে কর্মক্ষমতার বিভিন্নতা দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশ তেমনটা নয়। সেখানকার তরুণদের ভিন্ন চেহারার ও তুলনামূলক ভাবে বেশি কর্মক্ষম প্রতিযোগীদের সঙ্গে লড়তে হয় না। তা ছাড়া ইদানীং এখানকার বাঙালিরা বড় বেশি ছিদ্রাণ্বেষী হয়ে উঠেছেন বলেই মনে হয়। ফেসবুক, টুইটারে গঠনমূলক আলোচনার চেয়ে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটিতে ব্যস্ত থাকে। খেলা দেখা নিয়েও তুলনামূলক আগ্রহ কমছে।’’
বাংলাদেশে আবার উল্টো ছবি। ক্রিকেট পরিকাঠামো এখন আগের থেকে অনেক ভাল। গোটা দেশে ক্রিকেট নিয়ে মানুষের আগ্রহ বেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া বড় মঞ্চে বাকিদের দেখিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করাই শুধু নয়, জানপ্রাণ দিয়ে লড়ে চলেছেন শাকিব-মুস্তাফিজুররা। বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘বিশ্বকাপের মঞ্চে কিছু করে দেখানোর তাগিদ আমাদের সব সময়েই বেশি। তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বিশ্বকাপে।’’ ২০০৭ বিশ্বকাপে হাবিবুল বাশারের দলের কাছে হেরেই ছিটকে গিয়েছিল ভারত।
তবে ২২ গজের যুদ্ধে পশ্চিম বাংলার এই ম্লান ছবিটা কি আর বদলাবে না? সম্বরণ, লক্ষ্মীরা কিন্তু আশাবাদী। বাংলার প্রাক্তন উইকেট কিপার বলছেন, ‘‘ছবিটা নিশ্চয় বদলাবে। তার জন্য পরিশ্রম করতে হবে।’’ লক্ষ্মী বলছেন, ‘‘এ বারের বিশ্বকাপে হয়তো একজনও নেই। পরের বারের বিশ্বকাপে জাতীয় দলে বাঙালি ক্রিকেটার থাকতেই পারে।’’
আশা তো করতেই হয়। কিন্তু আশার সঙ্গে বাস্তব ছবির মিল কতটা? উত্তর দিতে গিয়ে যে কেউই হোঁচট খাবেন। তবু সম্বরণদের মতে, কোথাও তো একটা শুরু করতে হয়! কখনও কখনও নতুন করে, নতুন উদ্যমে শুরু করতে হয়। কখনও কখনও প্রতিবেশীর সাফল্যও তো নতুন করে উদ্বুদ্ধ করে, নতুন করে আশা জাগায়— ওরা যদি বিশ্বজয়ের মঞ্চে লড়ে যেতে পারে, আমরা পারব না কেন!
সহ প্রতিবেদক: ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়, স্বরলিপি ভট্টাচার্য ও মনীষা মুখোপাধ্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy