২০১৪ ইংল্যান্ড, (ডান দিকে) ২০১৪-’১৫ অস্ট্রেলিয়া আঁধার থেকে আলোয়: ইংল্যান্ডে সঙ্গী হয়েছিল ব্যর্থতা। লড়াই না হেরে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করে দুরন্ত প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছিলেন অদম্য কোহালি। ফাইল চিত্র
আতঙ্কের সেই ২০১৪-র ইংল্যান্ড সফর। ১০ ইনিংসে ১৩৪ রান করেছিলেন বিরাট কোহালি। তখন সব দিক থেকে আক্রান্ত তিনি। সমালোচনায় দগ্ধ। তার পরেই অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে চার টেস্টে চার সেঞ্চুরি করে বুঝিয়ে দেন, হারিয়ে যেতে আসেননি তিনি। আর ফিরে তাকাতে হয়নি বিরাটকে।
চার বছর পরে সেই ইংল্যান্ড সফরে গিয়েই তিনি সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। দশ ইনিংসে ৫৯৩ রান করেন বিরাট। ২০১৪-তে যাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল সকলে, তিনিই এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। কী করে সম্ভব হল এতটা পরিবর্তন? ভারতীয় বোর্ডের নিজস্ব বিসিসিআই টিভিতে মায়াঙ্ক আগরওয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের পরিবর্তনের কাহিনি শুনিয়েছেন বিরাট। ভারত অধিনায়ক জানিয়ে দিলেন, তাঁর এই পরিবর্তনের নেপথ্যে অবদান রয়েছে সচিন তেন্ডুলকর, রবি শাস্ত্রী ও প্রাক্তন ভারতীয় কোচ ডানকান ফ্লেচারেরও।
ভারতীয় দলের ওপেনার মায়াঙ্কের প্রশ্ন, ‘‘২০১৪-তে ইংল্যান্ড সফরের পরে তোমার মনোভাব কী রকম ছিল? ২০১৮-তে ইংল্যান্ডে গিয়ে রান করলে। তখন কী মনে হয়েছিল?’’ বিরাটের জবাব, ‘‘২০১৪-তে ইংল্যান্ড সফরে আমি ইনসুইং বোলিং নিয়ে বড্ড বেশি ভাবছিলাম। মাথার মধ্যে শুধু থাকত, ইনসুইং কী ভাবে সামলাব। তাই আমার শরীর ও কাঁধ আগেই বোলারের দিকে ঘুরে যেত। উল্টে পরাস্ত হতাম আউটসুইংয়ে।’’ যোগ করেন, ‘‘ভুল শোধরানোর জন্য নিজের ভিডিয়ো ফুটেজ দেখলাম। লক্ষ্য করলাম বলের কাছে আমার পা আগের মতো যাচ্ছে না। শুধুমাত্র হাত ও চোখের ভরসায় কোনও রকমে খেলে দিচ্ছি।’’ ইংল্যান্ডে সেই সফরে জেমস অ্যান্ডারসন বার বার তাঁকে আউটসুইংয়ে আউট করেছিলেন। কোহালির কাছে তার কোনও জবাব ছিল না।
কী বলেছিলেন ওঁরা...
‘‘ফিরে এসে সচিন পাজির সঙ্গে কথা বলি। মুম্বইয়ে ওর সঙ্গে অনুশীলনও করি। আমার সমস্যার কথা জানাই। সচিন পাজি মনে করিয়ে দেয়, পেসারের বিরুদ্ধেও কিন্তু বড় পা বাড়িয়ে খেলার দরকার। তাতে কিছুটা হলেও সুইং আটকানো সম্ভব।’’ সচিন সম্পর্কে কোহালি
‘‘রবি ভাই জানতে চেয়েছিলেন, শর্ট বলের বিরুদ্ধে আমি ভয় পাই কি না। বলেছিলাম, আঘাত লাগার কোনও ভয় নেই। আউট না হলেই হল। তখনই নির্দেশ দেন, যত গতিতেই বল আসুক ক্রিজের বাইরেই যেন আমি দাঁড়াই।’’
শাস্ত্রী সম্পর্কে কোহালি
ভারতে ফিরে কোহালি চলে যান সচিন তেন্ডুলকরের কাছে। মুম্বইয়ে একসঙ্গে ট্রেনিংও করেন সচিন ও বিরাট। সতীর্থ মায়াঙ্ককে তিনি বলেছেন, ‘‘ফিরে এসে সচিন পাজির সঙ্গে কথা বলি। মুম্বইয়ে ওর সঙ্গে অনুশীলনও করি। সচিন পাজিকে সমস্যার কথা জানাই। বলি, আমি কোমরের অবস্থান ঠিক রাখার চেষ্টা করছি। সচিন পাজি মনে করিয়ে দেয়, পেসারের বিরুদ্ধেও কিন্তু বড় পা বাড়িয়ে খেলার দরকার। তাতে কিছুটা হলেও সুইং আটকানো সম্ভব।’’ বিরাট যোগ করেন, ‘‘সচিন পাজির কথা মতো পেসারদের বিরুদ্ধেও বড় পা বাড়িয়ে খেলতে শুরু করি। পরের অস্ট্রেলিয়া সফরেই তার ফল পাই।’’ ২০১৪ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে চারটি সেঞ্চুরি করেন বিরাট। টেস্ট অধিনায়ক হিসেবেও অভিষেক হয় স্টিভ স্মিথদের দেশেই।
সচিনের পাশাপাশি আরও এক জনের অবদানের কথা বলেছেন বিরাট। তিনি তৎকালীন টিম ডিরেক্টর এবং এখন ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। ইংল্যান্ডে আতঙ্কের টেস্ট সিরিজ শেষ হওয়ার পরে শাস্ত্রী নিজের ঘরে ডেকে পাঠান বিরাটকে। অধিনায়কের স্মৃতিচারণ, ‘‘আমাকে আর শিখরকে (ধওয়ন) একটি ব্যাট নিয়ে নিজের ঘরে আসতে বলেন রবি ভাই। ওঁর পরামর্শের মান অন্য রকম হবেই। ভারতীয় দলে নীচের দিকে ব্যাট করতে নেমে, সেখান থেকে যিনি নিজেকে ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তাঁর ক্রিকেটজ্ঞান অন্য রকম হতে বাধ্য। বিশ্বের সব জায়গাতেই প্রায় সেঞ্চুরি আছে রবি ভাইয়ের। আমাকে বলেছিলেন, ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে পেসারকে সামলাও। বলেছিলেন, বোলারকে আউট করার এত সুযোগ দেবে কেন? নিজেও পরিবর্তন করো।’’ জানান, শাস্ত্রীর এই পরামর্শেই তিনি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে মিচেল জনসনের মতো এক্সপ্রেস গতির বোলারকেও ক্রিজের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলেছিলেন। আর তাতেই এসেছিল সাফল্য। বিরাট আরও ফাঁস করেছেন, ২০১৮-তে ইংল্যান্ড সফরের শুরুতে হেড কোচের সেই পরামর্শ ভুলে গিয়েছিলেন। আবার তা মনে করিয়ে দেন শাস্ত্রী। তখন তিনি নেটে ফিরে আরও চল্লিশ মিনিট নিজেকে ঝালিয়ে নেন। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে শাস্ত্রীর পুরনো পরামর্শ নিয়ে আরও বলেছেন, ‘‘রবি ভাই জানতে চেয়েছিলেন, শর্ট বলের বিরুদ্ধে আমি ভয় পাই কি না। বলেছিলাম, আঘাত লাগার কোনও ভয় নেই। আউট না হলেই হল। তখনই নির্দেশ দেন, যত গতিতেই বল আসুক ক্রিজের বাইরেই যেন আমি দাঁড়াই। ওখান থেকে মোকাবিলা করতে পারব শর্ট বলের।’’
প্রাক্তন কোচ ডানকান ফ্লেচারের অবদানের কথাও উল্লেখ করেছেন অধিনায়ক। বিরাটের কথায়, ‘‘আমার স্টান্স চওড়া করার পরামর্শ দেন ফ্লেচার। বলেছিলেন, দু’পায়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়ালে শরীরের ভারসাম্য ভাল থাকে। ফ্লেচারের পরামর্শ অনুযায়ী স্টান্স বদল করার পরেই পরিবর্তন লক্ষ্য করি। কোন শট কী রকম ভাবে খেলব, তা আরও ভাল নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে।’’ অনেকে জীবনের সাফল্যের মুহূর্তকে মাইলফলক হিসেবে ধরে। বিরাট মাইলফলক ধরেন ইল্যান্ডে ব্যর্থতার সেই ২০১৪ সফরকে। কারণ ওই সফরই তাঁকে পাল্টে দিয়ে গিয়েছিল। ‘‘সেই সফরে না গেলে জানতামই না আমার এতটা পরিবর্তন প্রয়োজন,’’ বলছেন তিনি। মায়াঙ্ক প্রশ্ন করেন, ‘‘অধিনায়ক হিসেবে দলের মধ্যে কোনও এক্স-ফ্যাক্টর চাও?’’ বিরাটের উত্তর, ‘‘আমি কখনও ড্রয়ের কথা ভাবি না। একটি টেস্টে শেষ দিনে যদি ৩০০ রানও করতে হয়, জেতার চেষ্টাই করব। দিনের শুরু থেকেই ড্রয়ের চিন্তা করলে নিজের কাছেই হেরে যাব।’’ যোগ করেন, ‘‘দলের মধ্যেও সেই লড়াকু মনোভাব দেখতে চাই। প্রত্যেকে এ রকম ভাবতে থাকলে হারার কোনও জায়গাই থাকে না।’’
২০১৮ সালের পর থেকে ফিটনেসেও আমূল পরিবর্তন হয়েছে বিরাটের। আর ফোলা-ফোলা গালের সেই পুরনো চেহারা ঝরিয়ে ফেলে সিক্সপ্যাক করতে গিয়ে মায়ের কাছেও বকুনি খেয়েছেন। ফাঁস করেছেন, তাঁর মা ভাবতেন, শরীরটা একদম ভেঙে যাচ্ছে ছেলের। ‘‘আমার মা যদি কোনও বাচ্চা ছেলেকে রোগা দেখে, তা হলে ভাবে নিশ্চয়ই ওর শরীর খারাপ অথবা দুর্বল। আমিও ফিটনেস আনার ট্রেনিং শুরু করার পরে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল মায়ের মধ্যে। রোজ সকালে উঠেই জিজ্ঞেস করত, আমার শরীর ঠিক আছে কি না,’’ হাসতে হাসতে বলেন বিরাট। পুরনো সেই ফোলা গাল আর এখনকার সিক্সপ্যাক— দু’টো ছবি পাশাপাশি রাখলে কে বলবে তাঁরা একই মানুষ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy