Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

দর্পের দাপটে এ বার পাঁচে পাঁচ

নিউজিল্যান্ড সময় এখন রাত সাড়ে দশটা। হ্যামিল্টনের শিশুপাল বধ শেষ হয়ে গেছে ঘণ্টা দেড়েকেরও বেশি। প্রেসবক্সে তখনও কাজে নিমগ্ন থাকা সাংবাদিকদের এই সময়ের খুব পরিচিত বাঁধা দু’চার পিস দৃশ্য আছে! মাঠে কর্মীরা জল দিচ্ছে। বা যারা এতক্ষণ প্র্যাকটিস পায়নি সেই রিজার্ভ প্লেয়াররা হালকা নেট করছে। বা সিরিজ-টিরিজের নিষ্পত্তির ম্যাচ হলে জয়ী প্লেয়াররা মাঠের মধ্যে চূড়ান্ত উৎসব পালনে মত্ত।

টিম মিটিংয়ের চেয়েও এখন বেশি আস্থা টিম হাডলে। ছবি: এএফপি

টিম মিটিংয়ের চেয়েও এখন বেশি আস্থা টিম হাডলে। ছবি: এএফপি

গৌতম ভট্টাচার্য
হ্যামিল্টন শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৫ ০৪:০১
Share: Save:

নিউজিল্যান্ড সময় এখন রাত সাড়ে দশটা। হ্যামিল্টনের শিশুপাল বধ শেষ হয়ে গেছে ঘণ্টা দেড়েকেরও বেশি।

প্রেসবক্সে তখনও কাজে নিমগ্ন থাকা সাংবাদিকদের এই সময়ের খুব পরিচিত বাঁধা দু’চার পিস দৃশ্য আছে! মাঠে কর্মীরা জল দিচ্ছে। বা যারা এতক্ষণ প্র্যাকটিস পায়নি সেই রিজার্ভ প্লেয়াররা হালকা নেট করছে। বা সিরিজ-টিরিজের নিষ্পত্তির ম্যাচ হলে জয়ী প্লেয়াররা মাঠের মধ্যে চূড়ান্ত উৎসব পালনে মত্ত।

মঙ্গলবারের হ্যামিল্টনে একেবারে অন্য ছবি। আর এটাই বোধহয় বিশ্বকাপে টানা পাঁচ নম্বর ম্যাচ জিতে ওঠা দিনের প্রতীকী!

গোটা টিম ইন্ডিয়া মহানন্দে ফুটবল পিটছে। দশ ওভার বল করতে বাধ্য হওয়া সুরেশ রায়নাও সেখানে আছেন। আবার বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের অন্যতম দাবিদার হিসেবে নাম রেজিস্ট্রি করিয়ে রাখা শিখর ধবন। দেখে মনেই হচ্ছে না টিম এমন একটা ম্যাচ খেলে উঠল যেখানে বিপক্ষ মার-মার করে প্রথম ১৫ ওভারে বিনা উইকেটে ৮৯ তুলে দিয়েছিল। বরং ভাবটা এমন, পুরো ছুটির দিন গেল। এত খাটব ভেবেছিলাম, কিছুই হল না। খেলাটাই যখন ৭৯ বল আগে শেষ করে দিলাম তখন অন্য ভাবে ঘাম ঝরাই।

এটাই ধোনির ভারত! দক্ষিণ গোলার্ধের তলদেশে রূপান্তরিত ধোনির ভারত! যারা যখন যেমন, তখন তেমন। প্রথা-ঐতিহ্য এ সবের তোয়াক্কা করে না। আমাদের মনে হচ্ছে এখন এটা ঠিক তো এটাই ঠিক। আপনার কী মনে হল জানার কোনও ইচ্ছে নেই।

ধোনি নিজেই যেমন! ক্লাইভ লয়েডের টানা নয় নম্বর বিশ্বকাপ ম্যাচ জয়ের রেকর্ডটা আজ তাঁর স্পর্শ করা নিয়ে এত কথা হচ্ছে। নিউজিল্যান্ড মিডিয়াও বারবার দেখাল তিনি যে গাঙ্গুলির টানা বিশ্বকাপ ম্যাচ জেতার রেকর্ড ভাঙলেন। অথচ তুলনা কিছুটা অসঙ্গত। সৌরভের পাওয়া সুযোগের সংখ্যা এক। একটাই বিশ্বকাপে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ধোনি দিচ্ছেন দুটোয়। বরং পরিসংখ্যান-টংখ্যানের বাইরে মনে হচ্ছে তাঁর আসল অভিজ্ঞান ক্রিকেট ক্যাপ্টেন্সির একটা নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে দেওয়া। যা মাইক ব্রিয়ারলির মতোই একটা যুগান্তকারী কাজ। জেনারেশন ওয়াইয়ের জন্য আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সি। তবে বই লিখে নয়। মাঠে প্র্যাকটিক্যাল দেখিয়ে। আর টেস্ট ক্রিকেটে নয়। ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টি গ্রামার।

এটা রেন অ্যান্ড মার্টিনের ব্যাকরণ বই নয়। এমসিসি ম্যানুয়ালও নয়। ধোনিবাদ সম্পূর্ণ কপিবুক বহির্ভূত। টিম মিটিং, প্ল্যান ‘এ’, প্ল্যান ‘বি’, প্ল্যান ‘সি’ এ সবে বিশ্বাসী নয়। এই ঘরানায় ক্যাপ্টেনের আসল অস্ত্র হল শীতলতম মস্তিষ্ক— যা খেলার দ্রুততম বদলের মধ্যেও বিচারে ভুল করে না। যা টিম মিটিংয়ে বিশ্বাসী নয়। বরং মাঠের মধ্যে শেষ মুহূর্তের হাডলে অনেক বেশি আস্থাশীল। এই ঘরানার অধিনায়কত্বের মূল সুর হল পরিস্থিতির তাৎক্ষণিকতা বিচারে সিদ্ধান্ত নাও। আগুপিছু বেশি ভাবতে যেও না। মনটা বর্তমানে রাখো।

আজ যেমন উমেশ আর শামি প্রথম স্পেলে মার খাচ্ছেন দেখে দ্রুত ভারত অধিনায়ক রায়নাকে আগে নিয়ে চলে এলেন। যে বদলটা কেউ ভাবেইনি। এর পর অশ্বিন। তার পর রোহিত শর্মা। তিন পেসারের এই জমানায় কে ভেবেছিল আয়ারল্যান্ডকে তিরিশ ওভার স্পিন বল করানো হবে? ওই যে লিখলাম, পুরোটাই পরিস্থিতির তাৎক্ষণিকতা।

রবিচন্দ্রন অশ্বিন আবার ম্যান অব দ্য ম্যাচোচিত পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি যে পেলেন না তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ হল ইনিংস বিরতির সময় তাঁর মন্তব্যটা— “মাহিকে আমি চিনি। ও আগে ভাবেই না। পেসারে কাজ হচ্ছে না দেখে তখনই সিদ্ধান্ত নিল যে আমাকে দিয়ে আগে বল করাবে।”

বিরাট কোহলিও তো ধোনির মতো। এ দিন ৪২ বলে অপরাজিত ৪৪-এর শটগুলো শুধু নয়, ক্রিজের বাইরে তাঁর বারবার গার্ড নেওয়া অবাক হয়ে দেখছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। অবশ্য এখানেই শুধু কেন, ব্রিসবেনে মিচেল জনসন আর স্টার্ককেও তো তিনি দু’ইঞ্চি বাইরে দাঁড়িয়ে ফেস করেছেন। বলা হয়ে থাকে এ সব দেশের দ্রুততম সারফেসে ব্যাটসম্যানের মুভমেন্ট হবে ব্যাক অ্যান্ড অ্যাক্রস। প্রথমে তার শরীরের ওজন পিছনে যাবে। ভারতের মোটামুটি সব কোচিং ক্যাম্পে তাই শেখানো হয়। কিন্তু বিরাটের স্টান্সের পুরো প্রবণতটাই ফ্রন্টফুটের ওপর। কপিবুক বিরোধী। কিন্তু ওই যে বললাম ধোনির ছেলেরা কপিবুক বা ঐতিহ্যের পরোয়াই করছে না।

ফিল্ডিংয়েও একমাত্র সৌরভের সেই দু’হাজার একের দল এদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কিন্তু তারা হারবে কারণ যুবরাজ, কাইফ, হরভজন, দ্রাবিড়দের পাশাপাশি সেই টিমে এমন কেউ কেউ ছিলেন যাঁদের লুকোতে হত। এখানে একমাত্র শামি আর উমেশ হলেন গড়পড়তা ফিল্ডার। বাকিরা বেশির ভাগই দুর্ধর্ষ। হয় এ দিনের রাহানের মতো দুর্দান্ত ক্যাচ নিচ্ছে। বা কোহলির মতো কুড়ি গজের ডিরেক্ট হিটে একটা না একটা রান আউট প্রতি ম্যাচে করেই দিচ্ছে। বা জাডেজার মতো ডাইভ দিয়ে অবধারিত বাউন্ডারি বাঁচাচ্ছে।

হ্যামিল্টনে ধোনির ছবি তুলেছেন গৌতম ভট্টাচার্য

এ বারের বিশ্বকাপে ভারতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি রান আজই হল। পাকিস্তান ২২৪, দক্ষিণ আফ্রিকা ১৭৭। আমিরশাহি ১০২ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৮২-র পর আয়ারল্যান্ড ২৫৯। তাতে টিম এক ইঞ্চিও চাপে পড়েনি। বরং মনে হচ্ছিল ব্যাটসম্যানরা নিয়মরক্ষার একটা ব্যাপার চুকোতে নেমেছেন। তার মধ্যে আর অনিশ্চয়তা থাকবে কেন? বোলাররা তো আসল কাজ করে বসেই রয়েছে। ৫ ম্যাচে ৫০ উইকেট! এক এক সময় মনে হচ্ছে ধোনি নন, টিমের আসল রেকর্ড তো এটা!

সেই রেকর্ডের একটা চাবি নিশ্চয়ই মহম্মদ শামি। আবার সেকেন্ড স্পেলে তিনি দারুণ রিভার্স করালেন। ধবন আর কোহলির প্রত্যাবর্তন নিয়ে এত কথা হচ্ছে। কেউ কেন ভাবছে না বিশ্বকাপে নতুন শামি আবির্ভূত না হলে এই পঞ্চাশটা উইকেট কিছুতেই পড়ে না!

এত কাছাকাছি দেশ হয়েও নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ান সারফেসের মধ্যে এত তফাত যে, বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ির ফারাকের মতো। মাঠ খুব ছোট। সিসিএফসি আর তালতলা মাঠের মাঝামাঝি যদি কোনও ভূখণ্ড কল্পনা করা যায়, তাই। সাইড বাউন্ডারি স্বাভাবিক ভাবেই ছোট। আবার গ্যালারি নিচু বলে অবিরাম হাওয়া। লাইন-লেংথও অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভিন্ন।

অথচ ভারতকে দেখে মনেই হল না যে তারা নতুন কোথাও এসে পড়েছে! রোহিত শর্মা সেঞ্চুরি না পেয়ে হয়তো প্রচারে কম থাকলেন। কিন্তু ওয়ান ডে-তে যে অনায়াস ভঙ্গিতে তিনি ব্যাট করছেন, টেস্ট ক্রিকেটের লক্ষ্মণ মনে পড়ে যাচ্ছে!

এটা খুব সত্যি কথা যে, ম্যাচগুলোর পরে গিয়ে কোনও গুরুত্ব নেই। চূড়ান্ত মার্কশিট তার সঙ্গে দর্প যোগ করুন। সেটাও অপর্যাপ্ত পরিমাপে।

হ্যামিল্টনের স্কোর

আয়ারল্যান্ড

পোর্টারফিল্ড ক উমেশ বো মোহিত ৬৭

স্টার্লিং ক রাহানে বো অশ্বিন ৪২

জয়েস বো রায়না ২

নিল ও’ব্রায়েন ক উমেশ বো শামি ৭৫

ব্যালবির্নি ক শামি বো অশ্বিন ২৪

কেভিন ও’ব্রায়েন ক ধোনি বো শামি ১

উইলসন ক রাহানে বো জাডেজা ৬

টমসন রান আউট ২

মুনি ন.আ. ১২

ডকরেল ক ধোনি বো উমেশ ৬

কুসাক ক উমেশ বো শামি ১১

অতিরিক্ত ১১, মোট ৪৯ ওভারে ২৫৯।

পতন: ৮৯, ৯২, ১৪৫, ২০৬, ২০৮, ২২২, ২২৬, ২২৭, ২৩৮।

বোলিং: উমেশ ৪-০-৩৪-১, শামি ৯-০-৪১-৩, মোহিত ৬-০-৩৮-১, জাডেজা ৭-০-৪৫-১, অশ্বিন ১০-১-৩৮-২, রায়না ১০-০-৪০-১, রোহিত ৩-০-২১-০।

ভারত

রোহিত বো টমসন ৬৪

ধবন ক পোর্টারফিল্ড বো টমসন ১০০

কোহলি ন.আ. ৪৪

রাহানে ন.আ. ৩৩

অতিরিক্ত ১৯, মোট ৩৬.৫ ওভারে ২৬০-২।

পতন: ১৭৪, ১৯০।

বোলিং: মুনি ৬-০-৪৪-০, কুসাক ৮-০-৪৩-০, টমসন ৬-০-৪৫-২, ডকরেল ৫-০-৪৪-০, স্টার্লিং ৫-০-৩৬-০, কেভিন ও’ব্রায়েন ৬.৫-০-৪২-০।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy