ম্যাচ ঘুরে গেল দ্যুতির গোলের পর।-উত্পল সরকার
চেন্নাইয়ান এফসি-১ (অগাস্টো)
আটলেটিকো দে কলকাতা-২ (দ্যুতি, হিউম)
অভিষেক বচ্চন মাঠে ঢোকার সঙ্গেই ভিআইপি গ্যালারিতে গোটা দশেক নীল-সাদা পতাকা বেরিয়ে পড়ল। ম্যাচের সময় টিমের অন্য কর্তাদের সঙ্গে অমিতাভ-পুত্রও নাড়ছিলেন সেই পতাকা।
চেন্নাইয়ানের ‘বান্টি’-ই এ বারের আইএসএলের একমাত্র সেলিব্রিটি মালিক, যিনি টিমের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সারা দেশ। তাঁর টিম লিগ টেবলের লাস্ট বয় হওয়া সত্ত্বেও। ইলানো বা অগাস্টোরা একটা ভাল মুভ করলেই আকাশে উঠছিল তাঁর বুড়ো আঙুল— থামস আপ! ফুটবলের সঙ্গে প্রো কবাডি টিমের মালিকও তিনি। নিখাদ স্পোর্টসম্যান। টিম হেরে যাওয়ার পরেও জুনিয়র বচ্চনের মুখ থেকে তাই বেরিয়েছে, ‘‘খেলার মাঠে হার-জিত তো থাকবেই। তবে আমার টিম আক্রমণাত্মক ফুটবলই খেলেছে।’’ তবু আটলেটিকো কলকাতার আগুনে সমর্থকদের বিদ্রুপের হাত থেকে রেহাই পেলেন কোথায় তিনি!
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যুক্তরাস্ট্র থেকে ফিরে এতটাই ‘ক্লান্ত’ যে শহরে থেকেও মাঠে আসেননি। সিএবি ঘুরে চলে গিয়েছেন বেহালার বাড়িতে। বাবা বাড়িতে বসে টিভি দেখলেও মা-কে সঙ্গে নিয়ে যুবভারতীতে হাজির সানা। ‘‘এই ম্যাচটা না জিতলে আমাদের সেমিফাইনালে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে,’’ বিরতিতে বলছিল খুদে আটলেটিকো-ভক্ত। সানার মুখেও অন্যদের মতো শেষ চারের অঙ্ক। দ্যুতির বিরতির ঠিক আগের মূহূর্তে ১-১ করা বা হিউমের ২-১-এর পর সোফা ছেড়ে সৌরভ-কন্যার লাফিয়ে ওঠাটা তাঁর বিখ্যাত বাবার উচ্ছ্বাসকেই মনে করাচ্ছিল।
চূড়ান্ত চার হার্ডলের প্রথমটা পেরনোর লড়াই। থমথমে ভিআইপি গ্যালারিতে কী হয়-কী হয় ভাব শুরু থেকেই। চিত্র পরিচালক সুজিত সরকার থেকে রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেওয়া লক্ষণ শেঠ—সবার মুখেই যেন খেলছিল আলো-আঁধারি। সবারই প্রশ্ন, এই ম্যাচটা না জিতলে তো সামনে আরও ‘ভয়াবহ’ টিম—গোয়া, পুণে, মুম্বই। সোফায় পাশাপাশি বসে সঞ্জীব গোয়েন্কা-সহ কলকাতার তিন মালিক। সবাই কর্পোরেট জগতের সফল মানুষ। তাতেও মাঠে কী টেনশন! তীব্র চাপের ম্যাচ জেতার পর সেই মুখগুলোই মাঠ থেকে বেরোচ্ছিল চূড়ান্ত স্বস্তি নিয়ে। ঠিক হাবাসের মতোই।
ফ্রান্সের পাশে কলকাতা-শঙ্কর নাথ দাস
কলকাতার স্প্যানিশ কোচের কাছে বুধবারের ম্যাচটা ছিল টিমের অন্দরে ঝড় থামানোর অস্ত্র। সমালোচকদের জবাব দেওয়ার ম্যাচ। পঁয়ত্রিশ হাজারের গ্যালারিতে গোটা দশেক পোস্টার উড়ছিল আইএসএল-ওয়ানের চ্যাম্পিয়ন কোচকে সমর্থন জানিয়ে। ‘প্যারিসের আক্রান্ত মানুষের পাশে আছি’ লেখা পোস্টারের সঙ্গেই দেখা যাচ্ছিল, ‘হাবাস, আমরা তোমার সঙ্গে আছি।’ বা ‘হাবাস, পারলে তুমিই পারবে।’
ইংরেজিতে লেখা পোস্টারগুলো নিশ্চয়ই চোখে পড়েছিল উগ্বিগ্ন মুখ নিয়ে মাঠে আসা এটিকে কোচের। এক গোলে পিছিয়ে থেকে পাল্টা দু’গোল। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসের ছবি আবার হাজির। সেমিফাইনালে ওঠার পথে এক পা বাড়িয়ে এবং লিগ টেবলে দু’নম্বরে দলকে ওঠানোর পর হাবাসকে দেখা গেল কিছুটা অভিমানী হয়ে টানেলের দিকে যেতে। ঠিক পরের মুহূর্তেই ঘুরে দাঁড়ালেন। তার পর যে ভঙ্গিমায় জড়িয়ে ধরলেন আর ঝাঁকালেন হিউম, দ্যুতি, অর্ণবদের তার খুব কাছাকাছি তুলনা হতে পারে বনবিতানে ঘোরা প্রেমিক-প্রেমিকার আবেগের বহিঃপ্রকাশের।
সল্টলেকের বহুচর্চিত আতঙ্কের ঘাস। টিমের এক নম্বর তারকা পস্টিগা গ্যালারিতে। নতুন আসা লেকিচকে নামানো ঝুঁকি। প্রতিদ্বন্দ্বী মাতেরাজ্জির টিমের আগুনে মেজাজ। সব কিছুই যখন বিপক্ষে, তখন ফের হাবাস-ম্যাজিক দেখাল, কেন তিনি চ্যাম্পিয়ন কোচ। আর যুবভারতী দেখল, এটিকে প্রাক্তনী ফিকরুর মোক্ষম সময়ে গোলের সহজ সুযোগ নষ্টের পর চেন্নাইয়ানের কোচের ধমক খাওয়া। আর ফিকরুর সেই সমারসল্ট দিচ্ছেন এটিকের দ্যুতি।
হাফটাইমে ইস্টবেঙ্গলের ডু ডং বলছিলেন, ‘‘আমার ভবিষ্যৎবাণী কলকাতা আজ ২-১ জিতবে।’’ সেটা হুবহু মিলে যাওয়ায় ম্যাচ শেষে কোরীয় ফুটবলারের মন্তব্য, ‘‘হাবাস লোকটা ম্যাজিক জানেন। দেখবেন এ বারও না টিমটা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়।’’
প্রথম এগারোয় দু’-একটা পরিবর্তন। দ্যুতির গতি আর হিউমের ছটফটানি কাজে লাগিয়ে বাজিমাত করে গেলেন হাবাস। কলকাতার দু’টো গোলের পিছনেই দ্যুতির অবদান। অথচ এটিকে রক্ষণের ঠকঠকানি আর অগাস্টিন-সহ গোটা তিনেক ফুটবলারের ভূপতিত হয়ে যাওয়ার সুফল প্রথমে তুলেছিল চেন্নাই-ই। ০-১ হওয়ার পর মনে হয়েছিল হাবাসের টিমের কপাল পুড়ল। কিন্তু সেই বিখ্যাত সাদা-জামা পড়া লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন রিজার্ভ বেঞ্চের মাথায়। বিশ্বকাপজয়ী মাতেরাজ্জি যখন বারবার রেফারির সিদ্ধান্ত নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করছেন, তখন হাবাস দৌড়চ্ছেন চতুর্থ রেফারির দিকে। উল্টো দিকে বুনো ওল থাকলে এ দিকে বাঘা তেঁতুল থাকতে হয়, সেটা হাবাসের চেয়ে কে-ই বা বেশি জানেন। কোচের এই মনোভাবটাই ছড়িয়ে পড়ছিল পুরো টিমে। যার সুফল তুলল কলকাতা।
কিন্তু এর পর কী হবে! গত বারের চ্যাম্পিয়নরা কি পারবে সেমিফাইনাল উঠতে? হাবাস বলে দিয়েছেন, ২১-২২ পয়েন্ট হলেই ‘মিশন ফোর’-এর লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে। কলকাতার পয়েন্ট এখন ১৭। মানে বাকি তিন ম্যাচ থেকে চার-পাঁচ জোগাড় করতে পারলেই আপাতত কেল্লাফতে।
গাড়িতে হোটেলে ফেরার সময় তৃপ্ত হাবাসের চারপাশে অসংখ্য সমর্থক। এটিকের এমন কিছু মেজো-সেজো কর্তাকেও দেখা গেল সেই ভিড়ে যাঁদের অনেকে চব্বিশ ঘণ্টা আগেও মুণ্ডপাত করেছিলেন ‘একরোখা’ স্প্যানিশ কোচের।
হাবাস সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে। সফল পারফর্মাররা যে রকম করেন আর কী— থামস আপ!
আটলেটিকো: অমরিন্দর, রিনো, অর্ণব (ডেঞ্জিল), তিরি, অগাস্টিন, বোরহা, গাভিলান, আরাতা (জুয়েল), দ্যুতি, ভালদো, হিউম (লেকিচ)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy