ম্যানুয়েল ন্যয়ারকে ভালবাসলে জানা উচিত যে, তিনি মোটেও গোলকিপার ছিলেন না!
চার বছর বয়সে এফসি শালকে-তে তাঁর ফুটবলের হাতেখড়ির সময় কোচ সোজা বলে দিয়েছিলেন, “শোনো তুমি স্ট্রাইকার খেলবে। পোস্টের আশপাশ ছাড়া কোথাও নড়বে না।” ক্লাবের পুরনো মাঠটা রুক্ষ ছিল। ছোট্ট ন্যয়ারের ভীষণ লাগত। কিন্তু তার পরেও মাঠ নয়, চার বছরের ন্যয়ারের সবচেয়ে খারাপ লাগত গোল মিস করলে।
“আমি কাঁদতাম। মনে হত সবাই আমাকেই দোষ দেবে,” বছরখানেক আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন জার্মানি গোলকিপার। তত দিনে সুইপার-কিপার হিসেবে প্রবল নামডাক হয়ে গিয়েছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপ খেলে ফেলেছেন। গোলকিপিংয়ের সংজ্ঞাই বদলে দিয়েছেন। চতুর্দিকে প্রশংসা, তাঁকে নিয়ে বিস্ময়-ঘূর্ণি। শালকে গোলকিপার কোচ লোথার ম্যাসটুচাক মজা করে বলে দিয়েছেন, “দেখলে গোলকিপার কী, গোলকিপারের উল্টো মনে হত! একে রোগা-পাতলা, তার উপর হাইট। একদম ছোটোখাটো ছিল। ও যে এই জায়গায় পৌঁছতে পারবে, বিশ্বাসই হয়নি!”
উত্থানের রাস্তায় প্রশংসার এমন নুড়িপাথর ন্যয়ার দেখেছেন বিস্তর। শালকে থেকে বায়ার্ন মিউনিখে যাওয়ার সময় তাঁকে নিয়ে টানাটানির গল্প জার্মান ফুটবলে সর্বজনবিদিত। বায়ার্নের কার্ল হেইঞ্জ রুমেনিগে শালকের ন্যয়ার নিয়ে এতটাই চমৎকৃত হয়ে যান যে, ক্লাব ওয়েসবাইটে লিখে দিয়েছিলেন, ‘আমার মনে হয় ন্যয়ার শালকে থেকে বায়ার্নে আসতে ইচ্ছুক।’ তৎকালীন শালকে কোচ ফেলিক্স ম্যাগাথ বিপদের গন্ধ পেয়ে জার্মানির এক কাগজকে ষ্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, ন্যয়ার কোথাও যাচ্ছেন না। চুক্তি যত দিন আছে থাকবেন, শালকেতে খেলবেন। ন্যয়ার তখন আর যে স্ট্রাইকার খেলেন না, বহু দিন আগে পোস্টের সামনে ঘোরাঘুরির বদলে পোস্টের নীচে দাঁড়াতে শুরু করেছেন! শালকে জার্সিতে সাতাশটা ম্যাচে প্রথম মিনিট থেকে খেলে ফেলেছেন। এবং তার মধ্যে চোদ্দোটা ম্যাচে তাঁকে হারিয়ে বল গোলে পাঠানো যায়নি!
মানশাফট ফুটবল-মহলে লোকে তখনই বলাবলি করত, সুপার ন্যয়ার। বলত, ছেলেটার মধ্যে ক্ষমতা আছে। এ একদিন না একদিন ঠিক অলিভার কান-জেন্স লেম্যানদের যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে ছাড়বে। ম্যাগাথের চরম আশাবাদে বিষণ্ণতা মিশিয়ে জার্মানির শ্রেষ্ঠ ক্লাবে ঢুকে পড়তেও তাঁর খুব দেরি হয়নি। বাকি উপাখ্যান ফুটবল-ইতিহাসের পাতায় তোলা আছে। তাঁকে নিয়ে বায়ার্ন বনাম শালকে সমর্থকদের যুদ্ধবিগ্রহ, বায়ার্নে গোলকিপার হিসেবে তাঁর হাজার মিনিটের উপর অপরাজিত থেকে যাওয়ার রেকর্ড, বাদ যায়নি কোনও কিছু। শুধু বৈচিত্রের তাজ পরাটা বাকি ছিল, প্রয়োজন ছিল গোলকিপিংয়ের চেনা পরিধির বাইরে নিজের উত্তরণ ঘটানোর। ব্রাজিল বিশ্বকাপ তা-ও দিয়ে দেয়। অ্যালান শিয়ারাররা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। গোলকিপার সে আবার সুইপার হবে কী? ইংল্যান্ডের কাগজে এঁরা এক সময় লিখেছিলেন, জার্মানির হারাটা সময়ের অপেক্ষা মাত্র। স্রেফ গোলকিপারের ভরসায় এত হাই-লাইন ডিফেন্স নিয়ে কেউ খেলে? বিশ্বকাপের পর সমালোচনার গরগরানি স্তব্ধতায় পাল্টে তো গেলই, শিয়ারারদের লিখতে হল ম্যানুয়েল ন্যয়ার কোনও গোলকিপারের নাম নয়। সে কমপ্লিট ফুটবলার! তার ডিফেন্সিভ গুণাবলি দেখার মতো। আর তাই, জার্মানি এগারো নয়, বারো জনে খেলে।
বৃহস্পতিবার যে জার্মানিকে বারো নয়, অন্তত চোদ্দো জনে খেলতে হবে। ন্যয়ারকে দুই নয়, তিন জন প্লেয়ারের অভাব ঢাকতে হবে!
ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালি ম্যাচের আগেও ন্যয়ার চারশো আশি মিনিট অপরাজিত থেকে গিয়েছিল। যে কোনও গোলকিপারের কাছে যা চরম সুখস্বপ্ন। কিন্তু ইতালি ম্যাচ ন্যয়ারের কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়েও নিয়ে গিয়েছে। ম্যাটস হুমেলস নেই। স্যামি খেদিরা নেই। মারিও গোমেজ নেই। ফুটবল-বিশেষজ্ঞরা একজোটে বলাবলি করছেন, ফ্রান্স এত কমজোর জার্মানি আর কখনও পাবে না! মনে রেখো, ১৯৫৮-র পর বড় টুর্নামেন্টে তুমি হারাতে পারোনি জার্মানিকে। এ বারই সুযোগ।
লোথার ম্যাথেউজকে ধরা যাক। জার্মান ফুটবলের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় চরিত্র। ইউরোয় নিয়মিত কলাম লিখছেন। দেখা গেল তিনি লিখেছেন যে, ‘মনেপ্রাণে চাইছি জার্মানি-পর্তুগাল ফাইনাল হোক। কিন্তু যুক্তি তা মানতে রাজি হচ্ছে না। ফ্রান্সের দুর্দান্ত আক্রমণ আর মাঝমাঠের সঙ্গে লড়বে কে?’ হুমেলস সেরা ডিফেন্ডার ছিলেন টিমটার। পোগবা-গ্রিজম্যান-পায়েত-কোমানদের বিরুদ্ধে একটা বোয়াতেং-হেক্টরের উপর কতটা আর ভরসা করা যায়? ইংল্যান্ড ফুটবলের প্রখ্যাত প্রাক্তন মাইকেল আওয়েনও ম্যাথেউজের সঙ্গে সহমত পোষণকারী।
জার্মান ফুটবলাররা পরিষ্কার বোঝাতে চাইছেন, মিডিয়া বলছে বলে কোনও চাপের গন্ধমাদন তাঁরা ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াতে রাজি নন। বিশ্বকে বার্তাটা দিতেও চাইছেন। জার্মান শিবির থেকে এমন প্রচারও করা হচ্ছে যে, সোয়াইনস্টাইগার ফিট। অধিনায়ক নিয়ে আর কোনও দুশ্চিন্তা নেই। ন্যয়ার থেকে মুলার, ক্রমাগত বলে চলেছেন, অলিভার জিরুঁ বা আঁতোয়া গ্রিজম্যানদের জার্মানি ভয় পায় না। তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখার বশীকরণ বিদ্যে জার্মানির জানা আছে। ম্যাটস হুমেলসের এ দিন সাক্ষাৎকার নিয়েছে এক জার্মান কাগজ। তিনি বলে রেখেছেন, “চিন্তা করবেন না, আমাকে ছাড়াই জার্মানি হারাবে ফ্রান্সকে!”
হুমেলসরা বলছেন, কিন্তু শুনছে কে? ফরাসি মিডিয়ামহলে জল্পনা চলছে, গোমেজের বদলে গটজে খেলবেন? কিন্তু তিনি তো জার্মানি কোচ জোয়াকিম লো-র ‘গুডবুকে’ নেই। তা হলে লুকাস পোডোলস্কি? কিন্তু তিনি যে আবার ‘কোল্ড স্টোরেজে’ চলে গিয়েছেন! ’৮২ বিশ্বকাপের সেই বিখ্যাত ফ্রান্স বনাম জার্মানি যুদ্ধও নেপথ্যে চলে আসছে। সেভিয়ার যে কাপ সেমিফাইনালে অতিরিক্ত সময়ে চার গোল হয়েছিল, ম্যাচের নিষ্পত্তি গড়িয়েছিল মহানাটকীয় টাইব্রেকারে, জিতেছিল জার্মানি। গত রাতেও ম্যাচটা টিভি চ্যানেলে বারবার দেখিয়েছে। মিশেল প্লাতিনিদের যে ম্যাচ এখনও রক্তক্ষরণ ঘটায়। প্লাতিনি চৌত্রিশ বছর পরেও বলে ফেলেন, “কোনও আর্টিকেল লিখে যন্ত্রণাটা বোঝানো যাবে না।”
প্লাতিনিদের প্রজন্ম চায়, সেভিয়ার প্রতিশোধ বৃহস্পতিবারের মার্সেই নিক। প্লাতিনিরা স্বপ্ন দেখেন, পোগবাদের নীল সাগর ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক রোগা-পাতলা জার্মান কিশোরের হাত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy