শোভা দে-র কটাক্ষের সেই টুইট ও তার উত্তরে সহবাগ। প্রতিক্রিয়া অমিতাভেরও।
আখড়ায় মাটি মেখে মেয়েটা কুস্তি শিখছে দেখে প্রচণ্ড চটেছিলেন গ্রামের মাতব্বরেরা। সে প্রায় বছর বারো-তেরো আগের কথা। হরিয়ানার রোহতকের প্রত্যন্ত গ্রামের আখড়ায় এক দিন ঘেরাওই হয়ে গেলেন সেই মেয়ের কুস্তির কোচ ঈশ্বর দাহিয়া। বিস্তর চেঁচামেচি, চোখরাঙানি। লোকগুলো চিৎকার করে বলেছিল, ‘‘আপনি ওকে শেখাচ্ছেন কেন? ঘরকন্না, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা না করে একটা মেয়ে কুস্তি শিখবে, এ কেমন কথা! এই মোখড়া গ্রামে এর আগে আর কোনও মেয়ে তো এমন দুঃসাহস করেনি!’’
চাপ সত্ত্বেও টলেননি ঈশ্বর। গুরুর সঙ্গে সরকারি চাকুরে বাবা-মাকেও সে দিন পাশে পেয়েছিলেন একরোখা মেয়ে। এর পরেও নাকি রীতিমতো ছক কষে রোখার চেষ্টা হয়েছিল তাঁকে। গ্রামের একদল ছেলেকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁর পেছনে। যাওয়া-আসার পথে রোজ উত্ত্যক্ত করত তারা। এক দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ায় একটা ছেলেকে ঠাটিয়ে চড় মেরেছিলেন মেয়েটি। আখড়ার পথে এগোনোর আগে শাসিয়ে গিয়েছিলেন, ‘‘আর এক দিন দেখলে রাস্তার মধ্যেই তুলে আছাড় মারব।’’
ইনিই সাক্ষী মালিক। বুধবার রাতে যিনি আসলে সপাটে আছড়ে ভেঙেছেন একশো পঁচিশ কোটির দেশের যন্ত্রণার পাহা়ড়টাকে। সেই দেশ, যে রাত জেগে হাপিত্যেশ করে বসে ছিল একটা অলিম্পিক পদকের আশায়। দীপা কর্মকার ছুঁয়েও ছুঁতে পারেননি পদকের স্বপ্ন। সাক্ষীর কুস্তিতে জেতা ব্রোঞ্জ পদকটা তাই ‘সোনা’ হয়ে ঝলমল করছে। কর্নম মালেশ্বরী, মেরি কম, সাইনা নেহওয়ালের পর তিনি সবেমাত্র চতুর্থ ভারতীয় মেয়ে, যিনি অলিম্পিক পদক জিতলেন। (যখন সাক্ষী জিতলেন, বুধবার তখন ভারতীয় সময় রাত প্রায় ২টো ৫০ মিনিট। তাই বৃহস্পতিবার আনন্দবাজারের কিছু সংস্করণে সেই খবর প্রকাশ করা যায়নি)। পঞ্চম নামটা পিভি সিন্ধুর। ব্যাডমিন্টনের ফাইনালে তিনি। পদক আসছেই। অলিম্পিক্সের শেষ প্রহরে মান তো রাখলেন ভারতের মেয়েরাই!
ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কোচ কুলদীপ সিংহ বছর তেইশের প্রিয় ছাত্রীকে তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে। উৎসবের তখনই শুরু। সে ভারী সুন্দর দৃশ্য। রিওর কারিওকা কুস্তি রিংয়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে সাক্ষী দৌড়চ্ছেন পাগলের মতো। এক সময়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। মাথা ঠেকালেন ক্যানভাসে। একটু পরে তিনি যখন ভিকট্রি স্ট্যান্ডে, তখন তাঁর চোখের কোণে আনন্দাশ্রু। স্বপ্নপূরণ তো বটেই, কিন্তু ভারতের জাতীয় পতাকাটাকে একটু একটু উঠতে দেখলে বুকের ভেতরটাও তো কেমন করে ওঠে!
‘‘তু তাগড়ি হ্যায়, তুঝকো মেডেল মিলেগি’’— নিজেকে নাকি এই কথাগুলোই বারবার বলে যাচ্ছিলেন। মিক্সড জোনে এসে সাক্ষীর গলায় উপচে পড়ে আত্মবিশ্বাস। ‘‘আমি সারাদিন ভেবেছি, আমার জন্য পদক আছে। আমি পারব, এই বিশ্বাসটা ছিল। নিজেকে বুঝিয়েই গিয়েছি, আমার বারো বছরের তপস্যা মিথ্যা হতে পারে না। পদক জিতবই।’’ সাক্ষী বলেই দিচ্ছেন, কৃতিত্বটা শুধু তাঁর নয়, তামাম দেশবাসীর। তাঁর কোচ, সতীর্থ গীতা (ফোগত) দিদি, সাপোর্ট স্টাফ– সকলের।
ব্রোঞ্জের লড়াইটাও সহজ ছিল না মোটেই। প্রথম দু’রাউন্ডে জেতার পর মেয়েদের ৫৮ কেজি ফ্রিস্টাইল বিভাগের কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে গিয়েছিলেন সাক্ষী। রাশিয়ার কাছে। কিন্তু কুস্তির নিয়ম অনুযায়ী, যাঁর কাছে হেরেছেন তিনি যদি ফাইনাল খেলেন, তা হলে এসে যাবে তিন রাউন্ড প্লে-অফ খেলার সুযোগ। এর আগে পদক জয়ের সময়ে
যে সুযোগ পেয়েছিলেন সুশীল কুমার, যোগেশ্বর দত্তরাও। সেটাই পেয়ে যান সাক্ষী। প্রথম রাউন্ড বাই পাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডে মঙ্গোলিয়ার ওরোখেন পুরেভদরজকে হারিয়ে দেন ১২-৩। কিন্তু কিরঘিজস্তানের আইসুলু টাইবেকোভার সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ের শুরুতেই ০-৫ পিছিয়ে পড়েন। মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় হল না। কারণ তত ক্ষণে আর এক মহিলা কুস্তিগির বীনেশ ফোগট লিগামেন্টে চোট পেয়ে হাসপাতালের পথে।
‘ওস্তাদ’ সাক্ষী মার দিলেন শেষে। যে জেদ নিয়ে গ্রামের মুখিয়াদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যেতেন আখড়ায়, যেন সেই জেদ নিয়েই অত্যাশ্চর্য ভাবে ফিরে এলেন লড়াইয়ে। ডাবল লেগ অ্যাটাকে শক্তিশালী সাক্ষী দু’পায়ের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে উপুড় করে দিলেন টাইবেকোভাকে। হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়া প্রতিদ্বন্দ্বীর কিছু করার ছিল না। ০-৫ থেকে ৮-৫। মাত্র আট সেকেন্ডে কেল্লাফতে!
সাক্ষীর কোচ কুলদীপ বলছিলেন, ‘‘ওকে বলি, কিরঘিজস্থানের মেয়েটা তোমার উপর বডি ওয়েট চাপানোর চেষ্টা করছে। তুমি ওটা এড়িয়ে পাল্টা আক্রমণে যাও। আমাদের স্ট্র্যাটেজিই ছিল আক্রমণ। সাক্ষীর যে-হেতু ডাবল লেগ অ্যাটাক শক্তিশালী, তাই সেটাই কাজে লাগিয়ে জিতেছে।’’ সাক্ষীও বললেন, ‘‘আমার শুরু থেকেই আক্রমণটাই ওকে ধরাশায়ী করেছে। পিছিয়ে থাকা অবস্থাতেও আমি জানতাম, আমিই জিতব। ওই শেষ আট-দশটা সেকেন্ডেই মেরে বেরিয়ে গিয়েছি আমি।’’ কিন্তু টাইবেকোভা যে শেষে রেফারির সিদ্ধান্ত মানতে চাইছিলেন না? সাক্ষী বললেন, ‘‘ও সব নিয়ে ভাবিনি। আমি জানতাম, আমি জিতে গিয়েছি।’’
কার কথা মনে হচ্ছে এখন?
এত ক্ষণে সাক্ষীকে যেন উদাস লাগে। বলেন, ‘‘এটা কখনও ভাবিনি, আমার হাত দিয়েই মেয়েদের কুস্তির প্রথম পদকটা আসবে দেশে! অনেক কষ্ট করে এই জায়গায় এসেছি। ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করেছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কত বাধা, কত বাধা! যারা বাধা দিয়েছিল তাদের মুখটা এক বার দেখতে ইচ্ছে করছে।’’
পরের খবরগুলো সাক্ষী নিশ্চয়ই পেয়েছেন। হরিয়ানা সরকার তাঁকে চাকরি ছাড়াও দিচ্ছে আড়াই কোটি টাকা পুরস্কার। কেন্দ্রীয় সরকার তিরিশ লাখ। ভারতীয় অলিম্পিক্স সংস্থা দশ লাখ। রেল কুড়ি লাখ। স্পনসর জেডব্লিউ পনেরো লাখ। বাড়িতে উপচে পড়েছে মিডিয়া। প্রত্যন্ত গ্রামে চ্যানেলের ওবি ভ্যানের মিছিল।
বীরেন্দ্র সহবাগ টুইটারে লিখেছেন, ‘কন্যাসন্তানকে যদি মেরে না ফেলা হয়, তা হলে তারা কী করে দেখাতে পারে, আজ সেটাই মনে করিয়ে দিলেন সাক্ষী। কঠিন পথে আমাদের মেয়েরাই লড়ে যায়, রক্ষা করে আমাদের গৌরব।’ সেই টুইট আবার রি-টুইট করেছেন অনুষ্কা শর্মা। ‘সুলতান’ ছবিতে হরিয়ানারই এক কুস্তিগিরের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অনুষ্কা। তাঁর অভিনীত ‘আরফা’ চরিত্রটি ছবিতে আগাগোড়া সরব ও নীরব যে বার্তা দিয়ে যায়, তার সারমর্মই হল সহবাগের ওই টুইট— ‘সুযোগ দিলে, বাঁচতে দিলে, মেয়েরা পারে, একটু ভরসা রেখো।’ অনুষ্কা লিখেছেন, ‘সাক্ষী তুমি হরিয়ানার বাঘিনি, ভারতের গর্ব। তুমি দেখিয়ে দিলে, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা মোটেও কম যায় না!’ ভাবলে অবাক লাগে। এক দিন একটা গ্রামের প্রথম মহিলা কুস্তিগির ছিলেন সাক্ষী। তাঁর রাজ্যে আজও রয়েছে খাপ পঞ্চায়েতের খবরদারি। অথচ সেই রাজ্যেরই রোহতক-ভিওয়ানি এলাকা থেকে আজ উঠে আসছেন একের পর এক মহিলা কুস্তিগির।
দেশবাসীর যন্ত্রণার পাহাড় ভাঙতে গিয়ে সাক্ষী আসলে অনুশাসনের একটা জগদ্দল পাথরকেই ভেঙে দিলেন গত কাল। যন্ত্রণাই তো যন্ত্রণাকে ভাঙে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy