ইগর স্তিমাচ (বাঁ দিকে) এবং সুনীল ছেত্রী। ছবি: এক্স।
কাজটা খুব একটা কঠিন ছিল না।
বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে যখন ভারতের গ্রুপে কুয়েত, কাতার এবং আফগানিস্তানের নাম দেখেছিলেন, তখন ফুটবলপ্রেমীরা বেশ খুশিই হয়েছিলেন। তৃতীয় রাউন্ডে ওঠার যে দীর্ঘলালিত স্বপ্ন তা অবশেষে হয়তো সত্যি হতে পারে। কাতারের কাছে হারলেও কুয়েতের বিরুদ্ধে অ্যাওয়ে ম্যাচে জেতার পর হাসি আরও চওড়া হয়েছিল। তবে গত পাঁচ দিনের ব্যবধানে সেই হাসি মিলিয়ে গিয়েছে। কপালের ভাঁজ আরও চওড়া হয়েছে। এবং বেশির ভাগই ধরে নিয়েছেন, এ বারও আর হল না।
মঙ্গলবার আফগানিস্তানের কাছে ভারতের লজ্জার হারের পর ঠিক কাকে দোষ দেওয়া যায়? ভারতীয় ফুটবলে শুধু সুনীল ছেত্রীর ছত্রছায়াকে? দলের অন্দরে কোনও স্ট্রাইকার না থাকাকে? আইএসএলের বিদেশি-নির্ভর দলগঠনকে? না কি ‘স্বপ্ন দেখানো’ কোচ ইগর স্তিমাচকে? প্রশ্ন বহু রয়েছে। কিন্তু উত্তর নেই।
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই সুনীলকে নিয়ে এখনও স্বপ্ন দেখে ভারত। তিনিই গোল করবেন, দলকে জেতাবেন, এই স্বপ্ন ফুটবলপ্রেমীরা দেখেন। সমস্যা হল, সুনীলের জায়গা যে ভবিষ্যতে অন্য কাউকে নিতে হবে এই ভাবনাটা দলের কারও মধ্যেই নেই। তাই জন্যই এখনও পরবর্তী সুনীল খোঁজার প্রক্রিয়া চলছে। কোনও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নেই। এবং তুলে আনারও কোনও প্রচেষ্টা নেই। সুনীলের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েই বাকিরা টিকে রয়েছেন। তাই মনবীর সিংহ, লালিয়ানজুয়ালা ছাংতে, লিস্টন কোলাসোরা প্রতিশ্রুতিমান হলেও, কেউ সুনীলের বিকল্প নন।
এই কথাটা আগে বার বার বলেছেন স্তিমাচ। অতি সম্প্রতিও তিনি অনুযোগ করেছেন, আইএসএলের ক্লাবগুলি স্ট্রাইকারের ক্ষেত্রে বিদেশি বিকল্প খোঁজে। দেশীয়দের উপর ভরসা রাখতে পারে না। তিনি অসত্য বলেননি। এই মুহূর্তে জাতীয় দলের সবচেয়ে বেশি ফুটবলার খেলেন যে ক্লাবে, সেই মোহনবাগানে গোল করার দায়িত্ব রয়েছে তিন বিদেশির উপরে। তাদের মধ্যে দু’জন অস্ট্রেলীয়, এক জন আলবেনিয়ার। মনবীর এবং লিস্টন দু’জনেই সেই ক্লাবে খেলেন। লিস্টন ডার্বিতে গোল করলেও মনবীর শেষ কবে গোল করেছেন তা অনেকেরই মনে নেই।
স্তিমাচ যে সত্যিই বলেছেন তা বোঝা যায় আইএসএলের বাকি দলগুলোর দিকে তাকালেই। একমাত্র বেঙ্গালুরুতে ভারতীয় স্ট্রাইকার হিসাবে সুনীল খেলেন। সেই ক্লাবেরই শিবশক্তি নারায়ণকে এক সময় পরবর্তী সুনীলের তকমা দেওয়া হয়েছিল। এ বারের আইএসএলে তাঁর পারফরম্যান্স বলার মতো নয়। ১২ ম্যাচে মাত্র ২ গোল। বাকি ক্লাবগুলোর দিকে তাকালে কোনও ভারতীয়ই প্রধান স্ট্রাইকার হিসাবে খেলেন না। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে খেলা কোমল থাটাল, রহিম আলি, রোহিত দানুরা কোথায় গেলেন কেউ জানেন না। নিজেদের ক্লাবের হয়েই যাঁরা নিয়মিত সুযোগ পান না, তাঁরা দেশের হয়ে খেলবেন কী হিসাবে?
তার ফল কী, সেটা মঙ্গলবারের আফগানিস্তান ম্যাচের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে। এই ভারতীয় দল এখন আর ‘ওপেন প্লে’ থেকে গোল করতে পারে না। আফগানিস্তান ম্যাচে তিন মিনিটের মধ্যে একটা সুযোগ পেয়েছিলেন সুনীল। বক্সে ভেসে এসেছিল বল। সামনে গোলরক্ষক ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। সেই সময় আফগান বক্সে তিন সতীর্থও ছিলেন। সুনীলের শট গিয়ে লাগল পোস্টে। ফিরতি বল গেল মনবীরের কাছে। তাঁর সামনেও শুধু ছিলেন গোলকিপার। মনবীর বল গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিলেন। অবশ্য ইদানীং তাঁর খেলা নির্ভর করে ‘মুড’-এর উপরে। কোন দিক কী মেজাজে আছেন, কেমন খেলবেন কেউ জানেন না। জনশ্রুতি রয়েছে, কোচ দেখে নিজের খেলা খেলেন মনবীর।
সেই সুযোগ নষ্টের পর আর কিছু পায়নি ভারত। ফিরে আসে সেই অসহ্যকর ফুটবলে। না ছিল মিডফিল্ডে নিয়ন্ত্রণ, না ছিল কোনও আক্রমণাত্মক মুভ। লেফট ব্যাক শুভাশিস বসু বার বার বল পেলেই মাঝ পিচে পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে। সেই বল কোনও আফগান ধরে আবার হুড়হুড় করে আক্রমণে উঠে আসছিলেন। আসলে ভারতের বাঁ দিকটা যত দিন যাচ্ছে দুর্বল হয়ে উঠছে। শুভাশিস খারাপ খেললে, লিস্টনও কম যান না। আফগানদের বিরুদ্ধে বার বার বাঁ দিক থেকে কাট করে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন। কয়েক মিটার দূরে সতীর্থ দাঁড়িয়ে থাকলেও পাস দেওয়ার বালাই নেই। শারীরিক ভাবে লিস্টন যতটা দুর্বল, ততটাই শক্তিশালী আফগানেরা। লিস্টনের সেই দক্ষতাও নেই যে ড্রিবল করে বেরিয়ে যাবেন। ফলে শারীরিক সক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বল ক্লিয়ার করে দিচ্ছিলেন আফগানেরা। ব্যর্থ হচ্ছেন দেখেও লিস্টনের মধ্যে কোনও বদল দেখা গেল না। ইদানীং আইএসএলেও লিস্টনের কাট করে ভেতরে ঢোকার প্রবণতা ধরা পড়ে গিয়েছে। সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
যদি ভারতের উইং খারাপ হয়, তা হলে আক্রমণ ভাগ আরও হতশ্রী। মঙ্গলবার স্তিমাচ সামনের দিকে লিস্টন, সুনীল এবং মনবীরকে রেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়াই চোখে পড়েনি। সাধারণত নাওরেম মহেশ এবং ছাংতের সঙ্গে সুনীলের বোঝাপড়া ভাল। দুই পছন্দের সতীর্থকে না পাওয়ায় গোলের সামনে কানা হয়ে গেলেন সুনীলও। স্তিমাচের ভুল কোচিং দর্শনের একটা উদাহরণ। তাঁর কাছে আক্রমণের তিন খেলোয়াড় ছিলই। তবু তিনি কাজে লাগালেন না। মাঠে যাঁদের রাখলেন এবং যাঁদের বসিয়ে রাখলেন, দুটোতেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। গোটা ম্যাচেই এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন যার উত্তর পেতে মাথা চুলকোতে হল।
সুনীল মাঠে থাকাকালীন তবু একটু চাপে ছিলেন আফগানেরা। সুনীলকে সামলাতে তিন জনকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। দুম করে ৬৮ মিনিটে তাঁকে উঠিয়ে নিলেন স্তিমাচ। ব্যস! যেটুকু চাপ ছিল, তা-ও কেটে গেল। স্বমূর্তিতে ফিরে আফগানেরা শুধু সমতাই ফেরালেন না, ম্যাচও জিতে নিলেন। সুনীলের বদলে যাঁরা খারাপ খেলছিলেন, তাঁদের মাঠে রেখে দেওয়া হল দীর্ঘ ক্ষণ। তবে প্রাক্তন কোচ কৃষ্ণেন্দু রায় মনে করেন, সুনীলের বসে যাওয়ার সঙ্গে গোল খাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বলেছেন, “সুনীল হয়তো পারছিল না বলে ওকে কোচ উঠিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ডিফেন্ডারেরা কী করছিল? ওদের তো সতর্ক থাকার কথা। যখন দলের এক জন সেরা ফুটবলার উঠে যাচ্ছে, তখন বিপক্ষ দল যে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাতে পারে এই অনুমানটা তো থাকা উচিত।”
ক্রোয়েশিয়া-জাত কোচ স্তিমাচের একটা স্বভাব ইদানীং বেশ স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দল খারাপ খেললেই তিনি খালি জাতীয় শিবির, আইএসএলের নিম্নমানের ফুটবলের উদাহরণ দিচ্ছেন। অথচ বিভিন্ন মাঠে ঘুরে, বিভিন্ন লিগের ম্যাচ দেখে ফুটবলার তুলে আনা যে জাতীয় দলের কোচের একটা কাজের মধ্যে পড়ে, এটা তিনি এখনও বোঝেননি। তিনি যান তথাকথিত বড় দলগুলির ম্যাচ দেখতে, যেখানে প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত ফুটবলার। এই কারণেই আই লিগের অনেক প্রতিভাবান ফুটবলার তাঁর নজর এড়িয়ে যায়।
ভারতের প্রাক্তন ফুটবলার মেহতাব হোসেনও তেমনই মনে করছেন। বলেছেন, “আইএসএল থেকে ফুটবলার নেওয়া হচ্ছে ঠিক আছে। তা হলে আই লিগটা রাখা হয়েছে কেন? তুলে দিলেই হয়। ওখান থেকে যদি ফুটবলারই সুযোগ না পায় তা হলে লিগটা রেখে লাভ কী? আজ মহমেডান খেলছে বলে অনেকে আই লিগ দেখছে। পরের বার মহমেডান আইএসএলে চলে গেলে আরও উৎসাহ হারাবে। তখন কি হবে? মহমেডান থেকেও কি জাতীয় দলে খেলার মতো কোনও ফুটবলার নেই?”
জাতীয় দলের জন্য বিদেশি কোচ নিয়ে আসার প্রথাটাই বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে কৃষ্ণেন্দু। তিনি বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন, “ভারতে এত কোচ নিজের পকেটের টাকা দিয়ে লাইসেন্স করাচ্ছে। তাদের যদি সুযোগই না দেওয়া হয়, নিজেদের প্রমাণ করবে কী করে? এখন যা হচ্ছে তার থেকে তো খুব খারাপ হবে না। বিদেশি কোচ আনা এখন একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু চিরিচ মিলোভানের মতো মাপের কোচ এখন কেউ নেই। অনেকেই এ দেশে আসছে স্রেফ অর্থ রোজগারের জন্য।” তবে তিনি লম্বা জাতীয় শিবিরের পক্ষে। মনে করেন, দীর্ঘ দিন একসঙ্গে খেললে ফুটবলারদের মধ্যে যে যোগাযোগটা গড়ে ওঠে, তা প্রতিফলিত হয় মাঠেও।
এমন নয় যে মঙ্গলবার আফগানিস্তান খুব ভাল খেলেছে। কিন্তু ভারতের পারফরম্যান্স এমনই ছিল যে আফগানিস্তানের পক্ষে ম্যাচটা নিয়ন্ত্রণ করতে অসুবিধা হয়নি। এই আফগানিস্তান দলটা কী রকম। কয়েকটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২০১৩ সালের সাফ কাপ ফাইনালের পর থেকে এই প্রথম আফগানিস্তানের কাছে হারল ভারত। সে দেশের কোচ অ্যাশলে ওয়েস্টউডের দাবি, দলের চার জন খেলোয়াড়ের কোনও ক্লাব নেই। ফলে ভারতের প্রত্যেক ফুটবলার আইএসএলের দৌলতে যে সারা বছর খেলার যে সুযোগ পান সেটা তাঁদের ছিল না। দীর্ঘ দিন কোনও প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেননি। কিন্তু মাঠে তাঁদের দেখে ঠিক উল্টোটাই মনে হয়েছে। ম্যাচের আগে দল করতেই হিমশিম খাচ্ছিল আফগানিস্তান। ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে ঝামেলার জেরে অধিকাংশ ফুটবলার জাতীয় দলকে বয়কট করেছেন। ফলে দুই পর্বের কোনওটিতেই তাঁদের পাওয়া যায়নি। এ দিক-ও দিক থেকে কুড়িয়ে-বাড়িয়ে, ক্লাবহীন ফুটবলারদের নিয়ে দল গড়েছিলেন ওয়েস্টউড। মাঠে তাঁরা সমানে টেক্কা দিলেন ‘কোটি’ টাকার সুনীলদের।
সব শেষে আইএসএলের প্রসঙ্গ উল্লেখ না করলেই নয়। ১০ বছর আগে এই প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার সময় ভারতীয় ফুটবলকে আমূল বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল। বিশ্ব ফুটবলে ভারত ‘রাজ’ করবে এমনটাই ভাবা হয়েছিল। সে সব তো দূর, ১০ বছর কাটলেও এখনও আর একটা সুনীল ছেত্রীকে পেল না ভারত। মেহতাব খেদের সুরে বললেন, “সুনীল নিজেই নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছে। কলকাতায় থাকার সময় অসম্ভব চাপের মধ্যে ওকে খেলতে হত। বেঙ্গালুরুতে অনেক চাপহীন হয়ে খেলে। এখনকার ফুটবলারদের মধ্যে সেই দায়বদ্ধতা কোথায়। ফেডারেশনও উচিত তৃণমূল স্তরের ফুটবল, অ্যাকাডেমিগুলোর উপরে জোর দেওয়া। তা হলে অন্তত কিছুটা উন্নতি হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy