Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Kanyashree Cup

Kanyashree Cup: ফুটবল মাঠের দুই কন্যাশ্রীর চোখে এখন অনেক বড় স্বপ্ন

দুলার, রঞ্জিতার কাছে তাই এখন ফুটবলই সব। মেসিভক্ত দুলার আর নেমারভক্ত রঞ্জিতা খুনসুটি করতে করতেই জানিয়ে দিল দু’চোখের স্বপ্ন— তাঁদের মতো আরও কন্যাশ্রী উঠে আসুক ফুটবল মাঠ থেকে।

কন্যাশ্রী কাপে প্রতিযোগিতার সেরা দুলার মারান্ডি ও ফাইনালের সেরা রঞ্জিতা দেবী।

কন্যাশ্রী কাপে প্রতিযোগিতার সেরা দুলার মারান্ডি ও ফাইনালের সেরা রঞ্জিতা দেবী। ছবি: আইএফএ, এসএসবি

অনির্বাণ মজুমদার
বারাসত শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০২২ ১২:৫৬
Share: Save:

স্কুলের দিদিমণি হঠাৎ এক দিন ক্লাসে এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কে কে খেলতে চাও? আগুপিছু না ভেবেই হাত তুলে দিয়েছিলেন। সে-ই ফুটবলের পায়েখড়ি। অন্য জন সুযোগ পেলেই নিজে থেকে নেমে পড়তেন মাঠে। খেলতেন ছেলেদের সঙ্গে। সেখান থেকে আজ দু’জন ফুটবলের কন্যাশ্রী। প্রথম জন এ বারের কন্যাশ্রী কাপের ফাইনালের সেরা রঞ্জিতা দেবী। দ্বিতীয় জন প্রতিযোগিতার সেরা দুলার মারান্ডি।

কন্যাশ্রী কাপে চ্যাম্পিয়ন সশস্ত্র সীমা বলের দুই স্ট্রাইকারকে যখন বারাসতের উলুডাঙ্গা ব্যারাকে পেলাম, তখন দেখে বোঝার উপায় ছিল না, কোন ঝড়ঝাপ্টা সামলে দু’জন ‘কন্যাশ্রী’-কে পেয়েছে বাংলা, তথা ভারতের ফুটবল। সাদা টি-শার্ট আর গাঢ় নীল ট্র্যাক স্যুটে হাসতে হাসতে দু’জনে বিশাল ক্যাম্পাসের খাওয়ার ঘরে ঢুকলেন। কেউ বুঝবে না, সেই হাসির পিছনে কতটা কষ্ট লুকিয়ে রয়েছে।

২৬ বছরের দুলারের যখন ১১ বছর বয়স, মা মারা যান। তত দিনে ধান ক্ষেতে কাপড় দিয়ে পাকানো বল দিয়ে ড্রিবলিং শেখা হয়ে গিয়েছে। বাবা চাষবাষ নিয়ে থাকতেন। তিনিও ২০১৫ সালে প্রয়াত হন। তার আগে ২০০৯ সালে দাদাও মারা যান। একের পর এক ধাক্কা সামলে ফুটবলকে ভালবেসে ফেলেন দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা দুলার। আর ভালবেসে ফেলেন ছোটমাসিকে। ভাইদের নিয়ে ছোট থেকে মাসিদের কাছেই মানুষ। ছোটমাসির কাছ থেকে ফুটবল খেলা নিয়ে সব থেকে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন।

কন্যাশ্রী  কাপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার নিয়ে দুলার মারান্ডি।

কন্যাশ্রী কাপের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার নিয়ে দুলার মারান্ডি। ছবি: আইএফএ

ঝাড়খণ্ডের দুমকা জেলার দুলারকে ছেলেদের সঙ্গে খেলে তৈরি হতে হয়েছে। বললেন, ‘‘আমার জেলায় ফুটবলের তেমন চল নেই। আমার অসম্ভব আগ্রহ ছিল বলেই নিয়ম করে খেলতাম। ছেলেদের সঙ্গে খেলতাম। দুমকা থেকে মেয়ে ফুটবলার বলতে সুমিত্রা মারান্ডির পরে আমিই।’’ ২০০৬ সালে দেশের সব থেকে পিছিয়ে পড়া আড়াইশো জেলার মধ্যে জায়গা পাওয়া দুমকায় ফুটবল সংস্কৃতি থাকা সম্ভবও নয়।

বাবা, মা যত দিন ছিলেন, তাঁদের সমর্থন পেয়েছেন। দুলারের কথায়, ‘‘যখন মাঠে গিয়ে দেখতাম ছেলেরা বল খেলছে, তখন আমারও মনে হত, যদি ওদের মতে আমিও খেলতে পারতাম। তখন নিজের মধ্যে যতটা সাহস ছিল, তার থেকে বেশি সাহস জুগিয়েছিল বাবা-মা। ওরাই জোর করেছিল খেলার জন্য।’’

নিজেকে আজ ভাগ্যবতী মনে করছেন দুলার। বাবাকে হারানো দুলার হঠাৎই পেয়ে গিয়েছিলেন আর এক ‘বাবা’-কে। তিনি দুমকারই এক ফাদার (পাদ্রী)। সে দিনের স্মৃতি এখনও টাটকা দুলারের মনে। বললেন, ‘‘ফাদার আমাকে দেখেই বললেন, তিনি আমার জীবন তৈরি করে দেবেন। হাজারিবাগের একটা ফুটবল কোচিং ক্যাম্পে আমাকে ভর্তি করে দিলেন। সেখানে নিধি বলে এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে বিহারের মেয়ে। আমাকে বলে, যাতে আমি পরের ধাপে পৌঁছতে পারি, তার দায়িত্ব ওর। এই ভাগ্য সবার হয় না। মা-বাবাকে হারিয়ে নিজেকে হতভাগ্য মনে করা আমি আজ জোর গলায় বলতে পারি, আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। সঠিক সময়ে সঠিক মানুষদের পাশে পেয়েছি। যে ছেলেদের সঙ্গে খেলে বড় হয়েছি, তারাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সব সময় খেলার জন্য উৎসাহ জুগিয়েছে। এখনও দুমকায় গেলে ছেলেদের সঙ্গে খেলেই অনুশীলন করি। এখনও মেয়েরা ওখানে সে ভাবে খেলে না। ওরা মনে করে, একটা পর্যায়ের পর আর এগোতে পারবে না। ওদের মনে ভয় আছে। তার মধ্যে থেকেও যারা একটু খেলতে চায়, তারা পরিবার থেকে সব সময় সাহায্য পায় না। আমার জেলায় কোনও ফুটবল কোচ নেই। যারা খেলতে চায়, তাদের সাহায্য করার কেউ নেই। সবার আগে এটা দরকার।’’

কন্যাশ্রী কাপের ফাইনালের সেরার পুরস্কার নিয়ে রঞ্জিতা দেবী।

কন্যাশ্রী কাপের ফাইনালের সেরার পুরস্কার নিয়ে রঞ্জিতা দেবী। ছবি: আইএফএ

মহিলাদের আই লিগে খেলা, দেশের হয়ে খেলা, এ সব ছাপিয়ে তাই দুলারের লক্ষ্য, ‘‘যে জেলা আমাকে এত কিছু দিয়েছে, তাকে যদি কিছু ফিরিয়ে দেওয়া যায়। টাকা আমার অনুপ্রেরণা নয়। ফুটবল খেলে প্রচুর টাকা রোজগার করতে চাই, ব্যাপারটা একেবারেই এ রকম নয়। আমি চাই, আমার জেলার মেয়েরা আমার মতো ফুটবল খেলুক। ছুটিছাটা থাকলে যখন বাড়ি যাই, তখন মেয়েদের বলি আমার সঙ্গে খেলতে। ওদেরও শেখাতে চাই।’’

ধন্যবাদ দিলেন এসএসবি-কে। বললেন, ‘‘চাকরি পাওয়ায় খুব সুবিধে হয়েছে। ভাইদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। এখন মাসিদেরও সাহায্য করতে পারছি।’’ ছোটবেলায় যে কোচিংয়ের অভাবটা বার বার বোধ হয়েছে, এখন এসএসবি-র শিলিগুড়ি এবং বারাসাত ব্যারাকে সেটাই উপচে পড়ছে। অনিন্দ্য শাসমলের কোচিংয়ে খেলতে পেরে দারুণ খুশি দুলার। আর খুশি মৃণাল সিংহকে পেয়ে। হেড কনস্টেবল মৃণালই এসএসবি দলটির যাবতীয় দেখাশোনা করেন। কোনও মতে কাপড়ের দলা পাকানো বল জোগাড় করে খেলতে শুরু করা দুলার এখন এঁদের জন্যই ‘আইস বাথ’ নিতে শিখে গিয়েছেন। আর ধন্যবাদ দিলেন আইএফএ এবং রাজ্য সরকারকে, প্রতি বছর এ রকম একটা প্রতিযোগিতা আয়োজন করার জন্য।

এসএসবি-র কোচ অনিন্দ্য শাসমল ও মৃণাল সিংহের সঙ্গে দুলার মারান্ডি, রঞ্জিতা দেবী।

এসএসবি-র কোচ অনিন্দ্য শাসমল ও মৃণাল সিংহের সঙ্গে দুলার মারান্ডি, রঞ্জিতা দেবী। ছবি: প্রতিবেদক

দুলারের পাশে স্ট্রাইকারে খেলা রঞ্জিতা মণিপুরের মেয়ে। দুলারের মতোই ২৩ বছরের রঞ্জিতাও দ্বাদশ পাশ। গত বছর কন্যাশ্রী কাপ চলাকালীন বাবা প্রয়াত হন। কোচ অনিন্দ্য ছুটি দিলেও বাবাকে শেষ দেখাটা হয়নি রঞ্জিতার। কারণ, করোনার ভ্রুকুটিতে তখন দেশের অন্য সব জায়গার মতো মণিপুরেও নানা বিধি-নিষেধ ছিল। নিজের রাজ্যে পৌঁছেও তিন দিন নিভৃতবাসে থাকতে হয়েছিল। ততক্ষণে বাবার শেষকৃত্য হয়ে গিয়েছে।

কন্যাশ্রী কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এসএসবি-র কোচ অনিন্দ্য শাসমলের সঙ্গে দুলার মারান্ডি।

কন্যাশ্রী কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এসএসবি-র কোচ অনিন্দ্য শাসমলের সঙ্গে দুলার মারান্ডি। ছবি: এসএসবি

সামনেই বাবার বাৎসরিক। এ বারও একই সমস্যা। কারণ, মহিলাদের আই লিগে খেলার কথা ভাবছে এসএসবি। সে ক্ষেত্রে জৈবদুর্গ ভেঙে বাড়ি চলে এলে আর খেলাই হবে না। আক্ষেপ থাকলেও রঞ্জিতার কাছে খেলাটাই অগ্রাধিকার পাচ্ছে। কারণ, তিনি জানেন, যাঁর অনুপ্রেরণায় ফুটবলে আসা, চাকরি, কন্যাশ্রী কাপের ফাইনালের সেরার পুরস্কার পাওয়া, জাতীয় দলে খেলার স্বপ্ন দেখা, তাঁর বাৎসরিকে না গেলে তিনি খুশিই হবেন।

দুলার, রঞ্জিতার কাছে তাই এখন ফুটবলই সব। মেসিভক্ত দুলার আর নেমারভক্ত রঞ্জিতা খুনসুটি করতে করতেই জানিয়ে দিল দু’চোখের স্বপ্ন— তাঁদের মতো আরও কন্যাশ্রী উঠে আসুক ফুটবল মাঠ থেকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE