আশাবাদী: শনিবার এসসি-ইস্টবেঙ্গ ফুটবলারদের উচ্ছ্বাসের এই দৃশ্যই দেখতে চান জাদুকর। ফাইল চিত্র।
ভয়ঙ্কর করোনা অতিমারির আতঙ্কের মধ্যে বাঙালির চিরকালীন আবেগের এই দ্বৈরথ যেন এক ঝলক মুক্ত বাতাস। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমরা যে এখনও বেঁচে রয়েছি, ডার্বির সময় আরও ভালভাবে উপলব্ধি করতে পারি। সেই চেনা উত্তেজনা ও উন্মাদনায় মন চঞ্চল হয়ে ওঠে।
আগামী শনিবার গোয়ায় আইএসএলের ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হচ্ছে এটিকে-মোহনবাগানের। এই ম্যাচ কলকাতায় হলে বেশি আনন্দ হত। তবে গোয়ায় ডার্বি হচ্ছে বলে উত্তেজনা বিন্দুমাত্র কমছে না। দুই প্রধানের এই লড়াই-ই তো বাঙালিকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।
আমার বাড়িতে অবশ্য প্রত্যেক দিনই ডার্বির আবহ! কাঠ বাঙাল বলতে যা বোঝায়, আমি একেবারেই তাই। পূর্ববঙ্গের টাঙ্গাইলে আমার জন্ম। তখন অবশ্য ময়মনসিংহ ছিল। আমার স্ত্রী উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত ঘোষ পরিবারের মেয়ে। কট্টর মোহনবাগান সমর্থক। ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল গোল দেওয়ার পরে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলে বা ‘জয় ইস্টবেঙ্গল’ বললেই ওর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। এই শনিবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। বড় ম্যাচে আমরা জিতলে তো কথাই নেই, ওর মেজাজ সপ্তমে। আমি চুপ করে থাকি। তাতেও নিস্তার নেই। যত রাগ আমার উপরেই উগরে দেবে।
শনিবারের ডার্বিতেও তার পুনরাবৃত্তি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। আমি যদিও ভয় পাই না। কারণ, আমি খাঁটি বাঙাল। লড়াই আমাদের রক্তে। সব কিছু ছেড়ে আমরা এখানে এসে আবার মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়িয়েছি। লড়াই করে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি। আমার প্রিয় দলের সময়টা হয়তো এখন ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু হাল ছাড়লে হবে না। বিশ্বাস করি, আবার আমরা ঘুরে দাঁড়াব। কেউ আটকাতে পারবে না লাল-হলুদকে। এই প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যাচ্ছে জাপানি কবি কোবায়াসি ইস্সার কথা। রাস্তায় যেতে যেতে কবি এক দিন দেখেছিলেন দু’টি ব্যাঙ নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। একটি ব্যাঙ বড় ও শক্তিশালী। অপরটি ছোট এবং দুর্বল। কিন্তু দু’জনেই প্রাণপণ লড়াই করছে। দুর্বল ব্যাঙটিকে উদ্দেশ্য করে কবি লিখেছিলেন, ছোট ব্যাঙ লড়ে যাও... কোবায়াসি তোমার সঙ্গে আছে। এই ডার্বিতে এসসি ইস্টবেঙ্গলকে কেউ কেউ দুর্বল ভাবছেন। লাল-হলুদের ফুটবলারদের আমি বলছি, তোমরা হারবে না। পি সি সরকার জুনিয়রের জাদু তোমাদের সঙ্গেই থাকবে।
ইস্টবেঙ্গলের আমি শুধু সমর্থক নই, এই ক্লাব আমার হৃদয়ের মণিকোঠায়। এর জন্য অবশ্য কম লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়নি। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমার বাবা জাদুসম্রাট পি সি সরকার (সিনিয়র) খুব কমই বাড়িতে থাকার সময় পেতেন। শিল্প ও উপার্জনের তাগিদে বাবাকে বাইরে বাইরেই থাকতে হত বেশি। ফলে ছোটবেলায় ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখতে মাঠে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। প্রিয় দলের খেলা দেখতাম ‘কান’ দিয়ে। অর্থাৎ, রেডিয়োয় ধারাভাষ্য শুনেই মন ভরাতাম। আমার কাছে যা মহালয়া শোনার চেয়ে কম নয়।
বালিগঞ্জে আমাদের পাড়ায় সুধীর ঘোষ বলে এক জন থাকতেন। খেলা থাকলেই ওঁর বাড়িতে আমরা যেতাম রেডিয়োয় ধারাভাষ্য শোনার জন্য। সুধীর বাবুরা ছিলেন মোহনবাগান সমর্থক। প্রিয় দল জিতলে উৎসব শুরু হয়ে যেত ওঁদের বাড়িতে। আমি চুপ করেই থাকতাম। কোন ম্যাচ ঠিক মনে নেই, একবার ভুল করে বলে ফেলেছিলাম, ইস্টবেঙ্গল হলে ঠিক দেখিয়ে দিত। সঙ্গে সঙ্গে আমার উপরে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই হচ্ছে ফুটবল নিয়ে বাঙালির আবেগ।
ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ ভক্ত হলেও আমার প্রিয় ফুটবলার ছিল মোহনবাগানের উলগানাথন। যত বার বেঙ্গালুরুতে জাদু দেখাতে গিয়েছি, ও জোর করে আমাদের নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাইয়েছে। খাওয়ার টেবলেও ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান রেষারেষি চলত। উলগা বলত, তোমাদের জন্য বেশি রান্না করেছি। যাতে ম্যাচে বেশি গোল খাও। উলগাকে পাল্টা বলতাম, পরের ম্যাচে আমরাই জিতব। তখন তোমাকেও প্রচুর পরিমাণে খাওয়াব। ভাবছি, শনিবার সকালে আমার মোহনবাগান সমর্থক স্ত্রীকেও এই কথাটা বলব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy