প্রি-কোয়ার্টারে ওঠার পর দক্ষিণ কোরিয়ার উচ্ছ্বাস। ছবি: রয়টার্স
এই নিয়ে দ্বিতীয় বার এশিয়ায় হচ্ছে ফুটবল বিশ্বকাপ। প্রথম বার মধ্য প্রাচ্যে। কাকতালীয় হলেও, এই বিশ্বকাপে দেখা যাচ্ছে এশিয়ায় জয়জয়কার। বৃহস্পতিবার জাপান, শুক্রবার দক্ষিণ কোরিয়া। শুধু নকআউটে ওঠা দিয়ে বিচার করা যাবে না। গ্রুপ পর্বেও বাকি দলগুলির কালঘাম ঝরিয়ে দিয়েছে এশিয়ার দেশগুলি। কে ভুলবে বিশ্বকাপের দ্বিতীয় দিনেই সৌদি আরবের কাছে আর্জেন্টিনার হার! কার না মনে থাকবে জাপানের হাতে জার্মানির বিধ্বস্ত হওয়া!
এক ঝলকে গ্রুপ পর্বে এশিয়ার দেশগুলির পারফরম্যান্স দেখে নেওয়া যাক। ‘বি’ গ্রুপে ছিল ইরান। ইংল্যান্ডের কাছে প্রথম ম্যাচে ৬ গোল খেলেও পরের ম্যাচেই ওয়েলসকে হারিয়ে দেয়। শেষ ম্যাচে রক্ষণাত্মক খেলে আমেরিকার কাছে হেরে যায়। গ্রুপ ‘সি’-তে থাকা সৌদি আরব প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনাকে হারায় ২-১ গোলে। হয়তো এটাই এখনও পর্যন্ত প্রতিযোগিতার সবচেয়ে বড় অঘটন। তবে বাকি দু’টি ম্যাচে জিততে পারেনি। গ্রুপ ‘ই’-তে থাকা জাপান তো এক নয়, দুই মহাশক্তিকে হারিয়েছে। প্রথম ম্যাচে জার্মানি-বধ করার পর তৃতীয় ম্যাচে হারিয়েছে স্পেনকে। গ্রুপ ‘এইচ’-এ থাকা দক্ষিণ কোরিয়া হারিয়েছে পর্তুগালকে। একমাত্র এশিয়ার দেশ হিসাবে মুখ ডুবিয়েছে আয়োজক কাতার। একটি ম্যাচেও জিততে পারেনি তারা।
কাতার বাদে বাকি এশীয় দেশগুলির পারফরম্যান্স বিস্মিত করার মতোই। কাকতালীয় হলেও সত্যি, ২০০২-এ জাপান-কোরিয়ায় বিশ্বকাপ হওয়ার সময় এই দুই দেশই দারুণ খেলেছিল। প্রি-কোয়ার্টারে তুরস্কের কাছে ০-১ হারে জাপান। কোরিয়া উঠেছিল সেমিফাইনাল পর্যন্ত। কোয়ার্টারে তারা স্পেনকে টাইব্রেকারে হারায়। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে হারে তারা। উল্লেখযোগ্য ভাবে, এ বারও এশিয়ার মুখ রাখছে পূর্ব দিকের এই দেশ দু’টিই।
ফুটবল বিশ্লেষকদের মতে, এখনকার পরিস্থিতিতে এই ফলাফলকে অঘটন মনে করা হলেও, আর কয়েক বছর পর তা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অর্থাৎ, এশিয়ার দলগুলি বড় কোনও দেশকে হারালেও তাকে আর অঘটন বলা হবে না। কেন এত সফল হচ্ছে তারা?
আসলে গত কয়েক বছর ধরে টেকনিক্যালি এশিয়ার দেশগুলি অনেক এগিয়েছে। বিশেষত জাপান, কোরিয়া। পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে। তৃণমূল স্তর থেকে ফুটবলার তুলে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নির্দিষ্ট একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বছরের পর বছর যাওয়ার পর তবেই জাতীয় দলে শিকে ছিঁড়ছে তাঁদের। ফলে বিশ্বমঞ্চে নামার আগেই অনেকটা তৈরি হয়ে যাচ্ছেন ফুটবলাররা। কোনও শক্তিকেই আর ভয় পাচ্ছেন না।
জাপানকে সত্তরের দশকে শ্যাম থাপার ভারত অনায়াসে হারিয়েছে। তার পর থেকে জাপান এগিয়েছে, ভারত পিছিয়েছে। জাপানের কোচ থাকাকালীন ব্রাজিলের কিংবদন্তি জিকো একার হাতে সে দেশের ঘরোয়া ফুটবলের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন। কোনও প্রতিবাদ না করে চুপচাপ সে দেশের ফুটবল সংস্থা শুনেছিল। তার ফল পাওয়া যাচ্ছে এখন। এই জিকোই আইএসএলে এফসি গোয়াকে বছর দু’য়েক কোচিং করিয়ে গিয়েছেন। এখানেও তিনি ফুটবলের সংস্কৃতি বদলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ‘অসুবিধা’ হয়ে যেত ভারতের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর। ফলে জিকোকে কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
জাপানের যে দল জার্মানি বা স্পেনকে হারিয়েছে, তাদের অন্তত ছ’জন বিদেশি লিগে খেলেন। জাপানের দুই গোলদাতা রিৎসু দোয়ান এবং তাকুমা আসানো জার্মানির ঘরোয়া লিগে নিয়মিত খেলেন। কোরিয়ার সন হিউং মিন তো দীর্ঘ দিন ধরেই ইপিএলের ক্লাব টটেনহ্যাম হটস্পারের নয়নের মণি। সনকে ছাড়া কোনও কোচই দল নামাতে চান না। ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হ্যারি কেনও সনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সে রকমই আকর্ষণীয় পারফরম্যান্স রয়েছে কোরীয় তারকার। আর এক ফুটবলার হোয়াং হি চান খেলেন উলভ্সে। আরও বহু দেশে ছড়িয়ে রয়েছেন কোরীয় ফুটবলাররা। ফলে বিপক্ষের ফুটবলারদের সম্পর্কে একটা ধারণা ছিলই তাঁদের। জাপানের তাকুমি মিনামিনো লিভারপুল হয়ে এখন ফ্রান্সের ক্লাব মোনাকোতে। ফলে বিশ্ব ফুটবলে কোন দেশের কে কেমন খেলেন, সে সব তাঁদের নখদর্পণে। বিশ্বকাপে খেলতে গিয়ে সেটারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
আরও একটি কারণ হল, দীর্ঘ দিন একসঙ্গে থাকা। সৌদি আরবের জাতীয় দলের ৯ জন ফুটবলার খেলেন আল-হিলালে। ফলে জাতীয় দলে খেলতে এলেও তাঁদের বোঝাপড়া নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। শুধু তাই নয়, বিশ্বকাপের আগে বাকি ফুটবলাররা যখন ক্লাব ফুটবল খেলতে ব্যস্ত, তখন সৌদি আরবের ফুটবলাররা টানা এক মাস প্রস্তুতি নিয়েছেন। বিপক্ষের দলগুলিকে কাটাছেঁড়া করেছেন। তার প্রভাব পড়েছে খেলাতেও। সৌদি আরব এবং জাপানের খেলায় দেখা গিয়েছে, প্রথমার্ধে বিপক্ষের দাপট। দ্বিতীয়ার্ধে কেন তা হলে সেই দাপট বজায় রাখা গেল না? এর কারণ, সামান্য সুযোগ পেলেও কাজে লাগিয়েছে জাপান, কোরিয়া। তারা জানত বড় প্রতিপক্ষ মোটেই ম্যাচে সুযোগ দেবে না। ফলে ‘ক্লিনিক্যাল ফিনিশিং’ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের খেলায়। একটা সুযোগ, তাতেই গোল। এটাই সাফল্যের মন্ত্র। আর্জেন্টিনা এবং জার্মানি একের পর এক সুযোগ পেলেও কাজে লাগাতে পারেনি।
আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন বা পর্তুগালের সবচেয়ে বড় ভুল হল, এশিয়ার দল হওয়ায় সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াকে হালকা ভাবে নেওয়া। এ কথা কেউই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, দু’দলের খেলাতেই দ্বিতীয়ার্ধে মরিয়া প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। পিছিয়ে পড়ার পরেই তেড়েফুঁড়ে উঠতে দেখা গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy