তৃপ্ত: আর্জেন্টিনাগামী বিমানে বিশ্বকাপ হাতে মেসি। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।
আমি যত বিশ্বকাপ দেখেছি, তার মধ্যে সেরা ফাইনালটা হয়ে গেল রবিবার কাতারে। মেসি দেখাল, কেন ও আর্জেন্টিনার কাছে অমূল্য। শুধু আর্জেন্টিনা কেন, বিশ্ব ফুটবলও তো এমনই চরিত্র পেয়ে ঝলমল করে। সব চেয়ে বড় ব্যাপার, এ রকম স্নায়ুর চাপের ম্যাচেও যে ভাবে মাথা ঠান্ডা রেখে গেল ও। প্রথমে ৯০ মিনিট, তার পরে একস্ট্রা টাইম, তার পরে টাইব্রেকার। একবারের জন্যও মেসিকে দেখে মনে হয়নি এমন হাড্ডাহাড্ডি, দম বন্ধ করা ফাইনাল খেলছে।
বিশ্বকাপের পুরস্কার তালিকাও কী সুন্দর ঝলমল করছে। মেসি সেরা খেলোয়াড়, এমবাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা। সেরা গোলকিপার আর্জেন্টিনার। কোনও পুরস্কার নিয়েই দ্বিমত থাকতে পারে না। এটা এমন এক রাত, যখন ফুটবলকেই ধন্যবাদ দিতে হয় এমন সুন্দর উপহার দেওয়ার জন্য। যেমন আবেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল, তেমনই উত্তেজনায় ভরা। বিশ্বকাপ যখন শুরু হল বা তার পরেও অপ্রত্যাশিত ফল আমরা দেখেছি। কিন্তু ফাইনাল হল সেরা দু’টো দলের।
আর একটা কথা। মেসিদের এই কাপ জয় কিন্তু আমাদের গোটা মহাদেশের জন্যই প্রেরণা হয়ে উঠবে। দক্ষিণ আমেরিকার সব দেশকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে, আরও স্বপ্ন দেখাবে। এখন বিদেশি কোচদের নিয়ে খুব ফলাও করে বলা হয়। লিয়োনেল স্কালোনি কিন্তু আর্জেন্টিনীয়। দায়িত্ব নেওয়ার সময় খুব বেশি অভিজ্ঞতাই ছিল না ওর। স্কালোনি দেখিয়ে দিল, ও সব দেশি-বিদেশি কোনও ব্যাপার নয়। যে পারে, সে পারে। তিনটে বড় ট্রফি কিন্তু লেখা হয়ে গেল ওর নামের পাশে। এক দিক দিয়ে মেসিদের এই কাপ জয় ইউরোপকে লাতিন আমেরিকার জবাব।
ইউরোপ বেশি কথা বললে ওদের মনে করিয়ে দিতে চাই, মাত্র ১২টা দেশ নিয়েও দক্ষিণ আমেরিকার ঘরে ১০টা বিশ্বকাপ। ইউরোপে এতগুলো দেশ। তবু সব মিলিয়ে ওদের বিশ্বকাপের সংখ্যা ১২।
কাতার বিশ্বকাপ শুরুর আগে অনেক পন্ডিতই লিখেছিল, ইউরোপীয় কোচেরা নাকি দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোকে ভোঁতা করে দেবে। এ বার ভদ্রমহোদয়গণ, আপনারা কী লিখবেন? আর্জেন্টিনা তো আপনাদের মুখের উপরে জবাব দিয়ে দিল। ব্রাজিলের জন্য শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে আর্জেন্টিনা। ওরা মনে করিয়ে দিয়ে গেল, প্রত্যেক মহাদেশের নিজেদের স্কুল আছে। ব্রাজিল যখন পরবর্তী কোচ নিয়োগ করবে, এটা যেন মাথায় রাখে।
ফাইনাল সব সময়ই পঞ্চাশ-পঞ্চাশ। তা বলে এতটা তুল্যমূল্য লড়াই হতে পারে, সত্যিই ভাবিনি। একটা দলে ছিল লিয়োনেল মেসি। অন্যটায় কিলিয়ান এমবাপে। আর এই দু’জনে দেখাল, ফুটবল ভক্তদের কাছে ওদের গুরুত্ব ঠিক কতটা।
ম্যাচটায় আর্জেন্টিনা প্রথমার্ধটা শাসন করল। তখন ওদের দেখে মনে হচ্ছিল, সামনে যা পড়বে বুলডোজ় করে বেরিয়ে যাবে। ২-০ এগিয়েও গেল ওরা। দ্বিতীয়ার্ধে শুরুর সময় আর্জেন্টিনীয় ভক্তরা গান ধরেছিল ‘ওলে’। কিন্তু প্রতিপক্ষে যদি এমবাপের মতো ফুটবলার থাকে, জয় পেয়ে গিয়েছি বলে কেউ ধরে নিতে পারে না। ছোট্ট একটা পর্বেই ম্যাচটা ঘুরিয়ে দিল এমবাপে। ফ্রান্সের হয়ে দু’গোল তো শোধ করেই দিল, প্রায় ছিনিয়েই নিচ্ছিল ম্যাচটা মেসির হাত থেকে।
একস্ট্রা টাইমের প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনাকে দেখলাম, ফের খেলাটাকে ধরতে পেরেছে। মেসি ৩-২ করে দিল। ফ্রান্স আবার গোল করল। তার পরে একদম সহজতম সুযোগ এরা পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আর্জেন্টিনার গোলকিপারের সামনে স্নায়ুর চাপে ভুগে গোলটা করতে পারল না। এই গোলটা হলে ফ্রান্স জিতে যায়। গতবার আর্জেন্টিনা ম্যাচের ৪-৩ ফলের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তবে ফুটবল ঈশ্বর বোধ হয় অন্যরকম চিত্রনাট্য লিখে রেখেছিলেন। তিনিও হয়তো চেয়েছিলেন, কাপ উঠুক মেসির হাতে। আর লিয়োর হাতে বিশ্বকাপকে ঝলমল করতে দেখে কে অভিযোগ করবে!
এত রুদ্ধশ্বাস একটা ফাইনাল। তার উপরে মেসির স্বপ্নপূরণের আবহ। সব মিলিয়ে যে রকম উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তাতে পার্শ্বচরিত্রগুলো হারিয়ে গিয়েছিল। এখন মঞ্চ ফাঁকা হতে সেই মুখগুলো মনে পড়ছে। যেমন আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেস। ওর বিশ্বস্ত হাত না থাকলে কিন্তু মেসির স্বপ্নপূরণ হওয়া কঠিন ছিল। টাইব্রেকারে এত আত্মবিশ্বাসী গোলকিপার আমি বহুদিন দেখিনি। দেখে মনে হচ্ছিল, সব ক’টা শট ও আটকে দিতে পারে। অনেক গোলকিপারকে দেখেছি, টাইব্রেকারে শট নেওয়ার আগেই ঠিক করে নেয়, কোন দিকে ঝাঁপাবে। মার্তিনেস কিন্তু তা করে না। শট নেওয়ার পরেই ও ‘মুভ’ করে। ফ্রান্সের গোলকিপার হুগো লরিসের চেয়ে একদম আলাদা ও। লরিস কিন্তু কোন দিকে শট আসবে, সেটা আগাম আন্দাজ করার চেষ্টা করে। এ রকম ভাবনায় বিপদ হচ্ছে, আগে থেকে কোন দিকে ঝাঁপাব ঠিক করে ফেলায় শট দেখে ‘মুভ’ করার সুযোগ থাকে না। আমার মনে হয়, লরিস যদি মার্তিনেসের মতো স্ট্র্যাটেজি নিত, অন্তত দু’টো টাইব্রেকার বাঁচাতে পারত।
যাই হোক, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে। আর্জেন্টিনা বা ফ্রান্সের যে কেউ বিশ্বকাপ জিতলে সেটাই ঠিক ফল হত। এরা দু’টো দলই সব চেয়ে ভাল খেলেছে এবং ফাইনালে আমরা সেরা দু’টো লড়াই দেখেছি। আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচ হেরে যাওয়ার পরে দারুণ লড়াই করেছে। ওদের সমর্থকেরা প্রবল ভাবে দলের পাশে থেকেছে। ফ্রান্সের কোচ দেশঁকে দুঃসাহসিক চরিত্র হিসেবে চিনি। ও যে কতটা ভয়ডরহীন, তা আবার প্রমাণ করল। বিশ্বকাপ খেলতে আসার আগে কোনও কোচকে যদি বলা হত, বেঞ্জেমাকে পাবে না। পোগবাকে পাবে না। এনগোলো কান্তেকে পাবে না। নিশ্চয়ই তার রাতের ঘুম উড়ে যেত। দেশঁ অন্য ধাতুতে গড়া। হাতে যে দল পেয়েছে, তা দিয়েই টানা দু’বার ফ্রান্সকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে ফেলেছিল। ফাইনালেও কী দুর্দান্ত সব পরিবর্ত মাঠে নামাল। দলটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে পাল্টা চাপে ফেলে দিল আর্জেন্টিনাকে। জিহু আর দেম্বেলে ভাল খেলছিল না। ওদের তুলে নিতে দ্বিধা করল না। গ্রিজ়ম্যান এই বিশ্বকাপে অসাধারণ খেলেছে। কিন্তু ফাইনালে নিষ্প্রভ ছিল। গ্রিজ়ম্যান ওর খেলাটা খেলতে পারছিল না বলেই এমবাপে যথেষ্ট বল পাচ্ছিল না। সেই কারণে ৭৯ মিনিট পর্যন্ত ফ্রান্স চাপে পড়েছিল। দেশঁ পরিবর্ত নামিয়ে বাজিমাত করে ফেলেছিল কারণ পরিবর্তরা অনেক বেশি বল বড়াতে থাকল এমবাপেকে। তার পরেই অন্য এমবাপে, অন্য ফ্রান্স। ওদের ভাগ্য খারাপ দু’গোলে পিছিয়ে পড়ে অসাধারণ জয়ের কাছাকাছি এসেও পারল না। মনে করতে পারছি না, শেষ কবে ফাইনালে কেউ হ্যাটট্রিক করেছে। তবে এমবাপের বয়স মাত্র ২৩। পরের বার বিশ্বকাপ জেতার লক্ষ্য নিয়ে ফিরে আসবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
আপাতত অবশ্য আর্জেন্টিনাকে অভিনন্দন জানানোর সময়। মেসিকে কৃতিত্ব দেওয়ার সময়। ওয়েল প্লেড লিয়ো, ওয়েল ডান আর্জেন্টিনা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy