ভরসা: আতঙ্ক ভুলতে মেসিদের দিকে তাকিয়ে বার্সেলোনা। ছবি: টুইটার।
নো তেঙ্গো মিয়েদো। নো তেঙ্গো মিয়েদো।
স্লোগান দিতে দিতে শনিবার সকালে অভিশপ্ত সেই লা রাম্বলা অ্যাভেনিউতে বেরিয়েছিল মিছিলটা। যেখানে ৪৮ ঘণ্টা আগে হানা দিয়ে গিয়েছে জঙ্গিরা। ঝরে গিয়েছে ১৪টি তাজা প্রাণ। মিছিলে অনেকের গায়েই দেখলাম আমার প্রিয় ক্লাব বার্সেলোনার টি-শার্ট। কেউ কেউ বুকে লিওনেল মেসির ছবি আটকেই হাঁটতে নেমে পড়েছে।
এর আগে কর্মসূত্রে বেশ কয়েক বার এসেছি বার্সেলোনাতে। এ বার এই শহরে সপরিবারে ছুটি কাটাতে এসেছি এডিনবরা থেকে। ঘড়িতে তখন সকাল সাড়ে দশটা। ওষুধের দোকানে ঢুকেছিলাম আমার আট মাসের ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে। সেখানেই জানতে চাইলাম ওই স্লোগানের ইংরেজি অর্থ। দোকানদারও জানতে চাওয়া মাত্র গড়গড়িয়ে বলে দিল ‘আই অ্যাম নট অ্যাফ্রেড’। বাংলা করলে দাঁড়াবে ‘আমি ভীত নই’। আর এটাই এই মুহূর্তে গোটা বার্সেলোনার সুর। দেখলে কে বলবে আটচল্লিশ ঘণ্টা আগে এই শহরটাই ছিল ত্রস্ত, ভয়ার্ত। ভয়াবহ আক্রমণ থেকে পুরো শহরটাই যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসকে কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতে চায় বার্সেলোনার মানুষ। ভয়কে কিছুতেই বাড়তে দিতে চায় না তাঁরা।
স্কটল্যান্ডে কর্মসূত্রে থাকলেও আমরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বার্সেলোনার সমর্থক। হাততালি দিতে দিতে আমরাও ওদের সঙ্গে হেঁটে নিলাম কিলোমিটার দু’য়েক। রবিবারই রিয়াল বেতিসের বিরুদ্ধে লা লিগায় অভিযান শুরু করছে বার্সা। আমাদের পাশেই বার্সেলোনার জার্সি গায়ে হাঁটছিল জুলিয়েতা। টুকরো-টাকরা ইংরেজি জানে। আমি ভারতীয় তা জেনে নিয়ে বলল, ‘‘পরিবার নিয়ে পারলে রবিবার ক্যাম্প ন্যু-তে চলে এসো। গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দেব এটা ফুটবলের শহর। সন্ত্রাসের কোনও জায়গা নেই এখানে। ম্যাচ বাতিল হয়েছে বলে গুজব রটেছিল। কিন্তু তা ঠিক নয়। রবিবার নিরানব্বই হাজার তিনশো চুয়ান্ন আসনের প্রত্যেকটাই ভরিয়ে দেবে এই শহরের জনতা।’’ জুলিয়েতার কাছ থেকেই জানলাম রবিবার ক্যাম্প ন্যু-তে শোকজ্ঞাপনের জন্য মাঠে মেসিদের মতো সমর্থকরাও জার্সিতে কালো আর্মব্যান্ড বেঁধে মাঠে যাবে। প্রয়াতদের শ্রদ্ধা জানাতে মেসি, পিকে-দের জন্য বিশেষ জার্সি তৈরি হয়েছে। জার্সির পিঠে যেখানে নাম লেখা থাকে, সেখানে কালোর উপর লেখা থাকবে বার্সেলোনা।
মাঠে গিয়ে মেসিদের এই মরসুমের অভিষেক ম্যাচ দেখার ইচ্ছা থাকলেও যাব কী ভাবে? টিকিটই তো নেই। অনলাইনে সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে। এটাই বলে দিচ্ছে, জঙ্গিদের পরোয়া না করে গোটা বার্সেলোনাই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। শুধু বার্সেলোনা নয়। এই মুহূর্তে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে গোটা স্পেন জুড়ে। বার্সা-রিয়াল শত্রুতা নিয়ে কত কথাই তো শুনেছি। কিন্তু মিছিলে কয়েকজনকে হাঁটতে দেখলাম রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি গায়ে। মোবাইলে বিবিসি অ্যালার্টেও দেখলাম রিয়াল মাদ্রিদ কোচ জিনেদিন জিদানও গোটা ঘটনার নিন্দা করে প্রয়াতদের জন্য শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। রবিবার লা-লিগা অভিযানে নামছে রিয়াল মাদ্রিদও। রোনাল্ডোদের প্রতিপক্ষ দেপোর্তিভো লা করুনা। সেই ম্যাচের আগে জিদানও বলছেন, ‘‘আমার ক্লাবের তরফে বৃহস্পতিবারের জঙ্গি হানায় নিহত ও আহতদের শ্রদ্ধা জানাতে ম্যাচের আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করব।’’
বার্সেলোনা শহরটাই বিখ্যাত পর্যটনের জন্য। দেশ-বিদেশের বহু পর্যটককে ঘুরতে দেখছি আশেপাশে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। টিভিতেই দেখলাম রবিবারের লা লিগা ম্যাচের চেয়েও পুলিশ বেশি ব্যস্ত বার্সেলোনার বিখ্যাত ভুয়েলতা সাইকেল রেস যেন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। আন্তর্জাতিক সাইকেল রেস শনিবারই শুরু হয়েছে ফ্রান্স থেকে। বার্সেলোনায় তা ঢুকবে মঙ্গলবার। বৃহস্পতিবার বিকেলে বার্সেলোনায় পা দেওয়ার কিছু পরেই লা রাম্বলা অ্যাভেনিউতেই ঘটেছিল মর্মান্তিক ওই জঙ্গিহানা। যে বাড়িতে আমি রয়েছি সেখান থেকে ঘটনাস্থল পঁচিশ মিটারের মধ্যে। আট মাসের ছেলে আর তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে আমরা স্বামী-স্ত্রীও ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা আগে যে শহরে শ্মশানের স্তব্ধতা দেখেছিলাম সেই বার্সেলোনাই শনিবার চেনা ছন্দে।
মেসিদের প্রাণবন্ত খেলার মতোই সন্ত্রাসকে হারানোর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে বার্সেলোনা।
(লেখক স্কটল্যান্ডে কর্মরত। ছুটি কাটাতে গিয়েছেন বার্সেলোনায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy