Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
সিন্ধুর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে কোহালির মতো নির্মম কসরত

ট্রেনিং গুরু ও বাবার হাতেই তৈরি বিশ্ব জয় করার নকশা

কোহালির উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে ‘স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং’ কোচ শঙ্কর বাসুর হাত। ২০১৪ আইপিএলের পরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের অন্দরমহলে বাসুর সান্নিধ্যেই নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেন তিনি।

পরিশ্রমী: শ্রীকান্ত বর্মার (বাঁ দিকে) তত্ত্বাবধানে সিন্ধুর সেই প্রস্তুতি।

পরিশ্রমী: শ্রীকান্ত বর্মার (বাঁ দিকে) তত্ত্বাবধানে সিন্ধুর সেই প্রস্তুতি।

এন জগন্নাথ দাস 
হায়দরাবাদ শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৯ ০৫:০৪
Share: Save:

বাসেলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের শহরে ফিরেছেন চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি। তার মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে পি ভি সিন্ধুর ফিটনেস ভিডিয়ো। টুইটারে ভারতের নতুন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের ট্রেনিংয়ের ছবি বেরিয়ে পড়ার পরে গোটা দেশে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। সিন্ধু ভক্তরা বিস্মিত হয়ে প্রতিক্রিয়া দিতে থাকেন।

এক শিল্পপতি পর্যন্ত টুইট করেন, ‘‘বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের মেয়ের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে কী রহস্য রয়েছে। এই কসরতকে পাশবিক বললেও কম বলা হয়। আমি তো দেখেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। নতুন প্রজন্মের প্রত্যেক উঠতি খেলোয়াড় একই রকম পরিশ্রম করতে চাইবে।’’ এই সব ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, সিন্ধু রীতিমতো ওয়েটলিফটারের মতো ওজন তুলছেন, কঠিন কসরতের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিচ্ছেন। অনেকটা যেমন ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালিকে করতে দেখা যায়।

কোহালির উত্থানের নেপথ্যে রয়েছে ‘স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং’ কোচ শঙ্কর বাসুর হাত। ২০১৪ আইপিএলের পরে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের অন্দরমহলে বাসুর সান্নিধ্যেই নিজেকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলেন তিনি। কড়া ফিটনেস অনুশীলনে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। ওজন নিয়ে কসরত করে ফোলা গালের কোহালি পাল্টে যান সিক্স প্যাকের কোহালিতে। তার পরেই অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া শুরু হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সিন্ধুর ব্যাডমিন্টন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পিছনেও রয়েছে নিজেকে শক্তিশালী করে তোলার একই কাহিনি।

কোহালির মতোই নির্মম অত্যাচার চলত শক্তি এবং ফিটনেস বাড়ানোর

‘অপারেশন বাসেল’ আসলে শুরু হয়েছিল বছর দু’য়েক আগে। ঠিক এই সময়টাতেই মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন পি ভি রামানা। তার কারণ, সিন্ধুর স্বভাবসিদ্ধ আক্রমণাত্মক খেলা হারিয়ে যেতে বসেছিল। রামানা নিজে ভলিবল খেলতেন। আক্রমণাত্মক স্পাইকার ছিলেন। তিনি ছোটবেলা থেকে মেয়েকে আগ্রাসী খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছিল, আগ্রাসন না দেখাতে পারলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সাফল্য পাওয়া যাবে না। পুল্লেলা গোপীচন্দের অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং করাটা কি যথেষ্ট হচ্ছে মেয়ের জন্য? রামানার মনে এই প্রশ্ন জেগেছিল। চোখের সামনেই তো দেখতে পাচ্ছিলেন যে, সিন্ধু সেরা খেলোয়াড়দের হারাতে পারছিলেন না। বারবার ফাইনালে হেরে যাচ্ছেন।

রামানা চেয়েছিলেন, বাকি থাকা ফাইনাল হার্ডলটিও পেরিয়ে যাক মেয়ে। না হলে সোনার স্বাদ পূরণ হবে না যে! কিন্তু কোথায় নিয়ে যাবেন মেয়েকে? কোন কর্মশালায় তৈরি হতে পারে সিন্ধু পার্ট-টু? খুঁজতে খুঁজতে একটা ঠিকানা মনে ধরল রামানার। সুচিত্রা অ্যাকাডেমি। সেকেন্দ্রাবাদের কোম্পানির এই অ্যাকাডেমির মালিক প্রদীপ এবং প্রবীণ রাজু। সরেজমিনে সব দেখে খুশি রামানা। ‘সিন্ধু পার্ট-টু’ তৈরির কর্মশালা হওয়ার মতো সমস্ত সরঞ্জামই সেখানে মজুত। প্রদীপ রাজু বলছিলেন, ‘‘সিন্ধুকে নতুন করে তৈরি করার পিছনে অনেক হোমওয়ার্ক রয়েছে। আধুনিক ক্রীড়াজগতে প্রযুক্তির ভূমিকা অনেক বেড়ে গিয়েছে। সিন্ধুকে তৈরি করেছি ক্রীড়া বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণ ভাবে মেনে।’’

সিন্ধুর ভাগ্য ভাল যে, নতুন এই অভিযানে ‘স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ’ শ্রীকান্ত বর্মাকে পেয়ে গেলেন। কে এই শ্রীকান্ত? অতীতে অন্ধ্রপ্রদেশ এবং গোয়া রঞ্জি ক্রিকেট দলের সঙ্গে ছিলেন। আমেরিকান ফুটবল টিমের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনিই সিন্ধুর ফিটনেস বিপ্লবের নেপথ্যে। ‘‘রামানা স্যর চেয়েছিলেন, সিন্ধুর কোর্টের মধ্যে নড়াচড়া ক্ষিপ্র হয়ে উঠুক। সিন্ধুর স্কিল সম্পর্কে আমাকে বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন উনি। তার পরে ওর শারীরিক ক্ষমতা অনুযায়ী আমি ট্রেনিং সূচি তৈরি করি,’’ বলছিলেন শ্রীকান্ত। সিন্ধুর খেলায় গতি, শক্তি, ক্ষিপ্রতা এবং দম বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে সূচি তৈরিতে মন দেন তিনি। যোগ করছেন, ‘‘বিশ্ব মানের অ্যাথলিটদের মতো সব ধরনের ট্রেনিং করানো হত সিন্ধুকে। গতি এবং শক্তি বাড়ানোর উপরে আলাদা করে জোর দেওয়া হত। কার্যত নন-স্টপ ট্রেনিং করে গিয়েছে ও,’’ বলছিলেন শ্রীকান্ত। তার পরেই ফাঁস করেন আবেগপূর্ণ এক কাহিনি— ‘‘এমনও হয়েছে যে, ব্যথায় ও কেঁদে উঠেছে। কারণ, যে সূচি বানানো হয়েছিল, তা রীতিমতো কষ্টকর। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়নি। কখনও হতাশ করেনি। জানতাম, এমন এক মেয়েকে পেয়েছি, যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সংকল্প নিয়ে এসেছে। যে সব রকম কষ্ট করতে প্রস্তুত।’’ কেমন ছিল সেই কষ্ট? জানতে চাওয়ায় নমুনা দিলেন শ্রীকান্ত, ‘‘এই ট্রেনিংয়ের ফলে তলপেট আর পিঠে অসম্ভব ব্যথা হত। যন্ত্রণায় কাতরাতে দেখেছি। তবু রণে ভঙ্গ দেয়নি।’’

শ্রীকান্ত জানাচ্ছেন যে, ফিটনেস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সম্পূর্ণ একটা টিমই তৈরি করে ফেলা হয়েছিল সিন্ধুর জন্য। আর সব চেয়ে বড় ‘কোচ’ ছিলেন তাঁর বাবা রামানা। সারাক্ষণ কড়া নজর ছিল মেয়ের উপরে। সিন্ধুকে নিয়েও দারুণ খুশি শ্রীকান্ত। বলে দিচ্ছেন, এখনকার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কখনওই কাঁদুনি গাননি। ইন্দোনেশিয়ান ওপেনে প্রথম এই ট্রেনিংয়ের ফল লক্ষ্য করা যায়। আর সেরা প্রতিফলন দেখা গেল বাসেলে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে। টুর্নামেন্ট শুরুর ৪৫ দিন আগে বাবা রামানা ফতোয়া জারি করে দেন। কোনও বিজ্ঞাপনের শুটিং করা চলবে না। মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তার বদলে মেয়েকে ধ্যান করাতেন রামানা। যাতে তাঁর মনঃসংযোগ বাড়ে। ‘‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের আগের ৪৫ দিন কী অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয়েছে সিন্ধুকে, কী কঠোর শৃঙ্খলা মানতে হয়েছে ওর বাবার নির্দেশে, বলে বোঝানো যাবে না,’’ মন্তব্য সিন্ধু-দ্বিতীয় পর্বের কারিগরের।

চোট-আঘাতের হাত থেকে বাঁচার রাস্তাও তৈরি করতে হয়েছিল। শ্রীকান্ত বলছিলেন, ‘‘বেশির ভাগ ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় চোটের ধাক্কায় ভোগে। সিন্ধুকে কাপ থিয়োরি, ইলেকট্রো রিকভারি জাতীয় নানা প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখা হয়েছিল। শেষ ১৫ দিন বহির্জগৎ থেকে সম্পর্ক সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাইল্যান্ড ওপেনেও খেলতে দেওয়া হয়নি যাতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তাজা অবস্থায় নামতে পারে। বাসেলে নামার আগে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। সিন্ধুর শরীরী ভাষাই বলে দিচ্ছিল, ও পাল্টে যাওয়া এক ক্ষুধার্ত বাঘ।’’

বাসেল সম্পন্ন। সামনে এ বার টোকিয়ো। শ্রীকান্ত বলে দিচ্ছেন, ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশন অলিম্পিক্স শুরু হয়ে গিয়েছে!

(লেখক ‘তেলঙ্গনা টুডে’-র ডেপুটি এডিটর এবং হায়দরাবাদের নামী ক্রীড়া সাংবাদিক)

অন্য বিষয়গুলি:

Badminton Fitness Training P.V. Sindhu Virat Kohli
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy