প্রত্যয়ী: কোচ বিজয় শর্মার সঙ্গে মীরাবাই চানু। সোমবার। নিজস্ব চিত্র
পাঁচ বছর বয়সে এক কিলোমিটার দূর থেকে মাথায় করে নিয়ে আসতেন জলের ড্রাম। ১২ বছরের মেয়ে বনাঞ্চল থেকে দাদাদের তুলনায় অনেক বেশি ওজনের জ্বালানি কাঠ নিয়ে আসতেন বাড়িতে। পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তিরিশ কিলোমিটার দূরে প্রত্যেক দিন অনুশীলন করতে যেতেন ছোটবেলার কোচ অনিতা চানুর কাছে। মণিপুরের সেই জেদি মেয়ে সাইখোম মীরাবাই চানু টোকিয়ো অলিম্পিক্সে পদক পাবেন, আশায় সবাই। জাতীয় ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে কলকাতায় এসেছেন ছোটখাটো চেহারার বছর পঁচিশের চানু। সোমবার দুপুরে আনন্দবাজারকে দিলেন একান্ত সাক্ষাৎকার।
প্রশ্ন: ১৩০ কোটি ভারতবাসী তো বটেই, কর্ণম মালেশ্বরীর মতো অলিম্পিক্স পদকজয়ী পর্যন্ত বলছেন, এ বার আপনার পদক পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। এই প্রত্যাশার চাপ সামলাচ্ছেন কী করে?
মীরাবাই চানু: রিয়ো-তে চেষ্টা করেও পাইনি। চার বছর ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি টোকিয়োতে পদক জেতার লক্ষ্য নিয়ে। অলিম্পিক্সে নামব, চাপ তো থাকবেই। সেটা সরিয়ে পদক জেতাই তো চ্যালেঞ্জ। আমার রাজ্যের মেরি কমই আমারও আদর্শ ক্রীড়াবিদ। ওকে কখনও চাপ নিতে দেখেছেন? রিং-এ মেরি কমের ঠান্ডা মাথা আমার চাপমুক্ত থাকার প্রেরণা।
প্রশ্ন: রিয়োতেও তো আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সবাই, সেখানে পারেননি....... (প্রশ্ন শেষ হল না)
চানু: রিয়ো এখনও দুঃস্বপ্নের মতো আমার জীবনে। সেই ব্যর্থতার জের কাটাতে অনেক সময় লেগেছিল। কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে তৈরি করেছিলাম সেই সময়। নিজের বোনের বিয়েতে পর্যন্ত যাইনি। ঠিক করেছিলাম, পদকটা এনে ওকে উপহার দেব। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর অনুশীলনই করব না। কিন্তু কোচ থেকে বাড়ির সবাই বোঝালেন, টোকিয়ো অলিম্পিক্স হবে চার বছর পরে। ভেঙে পড়ার কিছু নেই। তবে এটা বলছি, রিয়োর অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।
প্রশ্ন: রিয়োর ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে কী ভাবে নিজেকে তৈরি করছেন ?
চানু: অনুশীলনের সময় বাড়িয়েছি। দিনে অন্তত ছয় ঘণ্টা অনুশীলন করি। চাপ কাটাতে এবং লক্ষ্য স্থির রাখতে নিয়মিত মনোবিদের সঙ্গে কথা বলি। গত সাড়ে তিন বছর জাতীয় শিবির থেকে মনে হয় গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থেকেছি দিন দশেক। তার ফলও পেয়েছি। ২০১৭ যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছি। যাঁকে ভারোত্তোলনে আদর্শ হিসেবে মেনে চলি, সেই কর্ণম মালেশ্বরী ছাড়া যা কেউ এখনও অলিম্পিক্স ভারোত্তোলনে পদক জেতেনি। এ বার দিদির কুড়ি বছর আগের অলিম্পিক্সের পদক-জয়ের মুহূর্তটা ছুঁতে হবে (হেসে)। তা ছাড়াও গত বছর তাইল্যান্ডে ২০০ কেজির টার্গেট পেরিয়েছি। দেখা যাক, এ বার টোকিয়োতে কী হয়।
প্রশ্ন: সিডনি অলিম্পিক্সের ব্রোঞ্জজয়ী মালেশ্বরীর কাছে পরামর্শ নেন?
চানু: পাটিয়ালার জাতীয় শিবিরে দিদি মাঝেমধ্যে আসেন। নানা পরামর্শ দেন। কী ভাবে ওজন তুলতে হবে, তা বলেন। চাপ না নেওয়ার পরামর্শ দেন।
প্রশ্ন: টোকিয়োতে আপনার পদক জেতার পথে বাধা হতে পারেন কারা?
চানু: এখনই বলা কঠিন। এপ্রিলে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ আছে তাজিকিস্তানে। সেটাই শেষ ট্রায়াল। সেখানে আমিও নামছি কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে আছি, তা দেখে নিতে। তখনই একটা ধারণা তৈরি হয়ে যাবে অলিম্পিক্সের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সম্পর্কে। তবে চিন আর কোরিয়ার ভারোত্তলোকরা শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি টোকিয়োতে নামবেন ৪৯ কেজি বিভাগে। কতটা ওজন তুললে পদক পাবেন বলে আশা করছেন?
চানু: স্ন্যাচে এখন আমি তুলছি ৮৫ থেকে ৮৭ কেজি। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১১৪-১১৫ কেজি। স্ন্যাচে ৯২ কেজির আশেপাশে ওজন তুললে চলবে। ক্লিন অ্যান্ড জার্কে ১১৮ কেজি ওজন তুলতে পারলে পদক আসবে মনে হচ্ছে। তবে এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: কাতারে অলিম্পিক্সে নামার ছাড়পত্র পেয়েছেন। সুযোগ পাওয়ার পরে প্রথম কী মনে হয়েছিল?
চানু: নিজেকে চোটমুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। চোট পেয়ে গেলেই তো সব শেষ। মনোবিদ ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মতো এগোতে হবে। খাবার নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ওজন যাতে না বাড়ে, সে দিকে নজর রাখতে হবে।
প্রশ্ন: ভারোত্তোলনের সঙ্গে বারবার জড়িয়ে পড়ে ডোপ বিতর্ক। এই বিষয়টি নিয়ে আপনি কতটা সতর্ক?
চানু: কোচ বিজয় শর্মা ও ডাক্তাররা যা বলছেন, তাই মেনে চলছি। যা খেতে বলছেন, তাই খাচ্ছি। পুষ্টিজাত (ফুড সাপ্লিমেন্ট) খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকছি। দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছি আমি। পদকের জন্য আমার এত দিনের পরিশ্রম কলঙ্কিত হয়, এমন কিছু হোক চাই না।
প্রশ্ন: অলিম্পিক্সে নামার যোগ্যতা পেয়ে গিয়েছেন। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রের জাতীয় প্রতিযোগিতায় তা হলে আপনার লক্ষ্য কী?
চানু: এই প্রতিযোগিতাকে আমি আমার প্রস্তুতির মঞ্চ হিসাবে নিচ্ছি। কতটা তৈরি সেটা বারবার দেখতে হবে। কতটা ওজন তোলা বাড়াতে পারলাম সেটাও দেখতে হবে। কোচ যে ভাবে এগোতে বলবেন সে ভাবেই এগোতে চাই। এশীয় মিটেও তো সেটাই লক্ষ্য থাকবে। টোকিয়োতে যারা আমার বিরুদ্ধে নামবে তাদের যেমন আমি দেখব, তেমন ওরাও তো আমার উপরে নজর রাখবে।
প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত যা প্রস্তুতি হয়েছে তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট?
চানু: নিশ্চয়ই। আমাদের তো শিবির চলতেই থাকে। একটা নির্দিষ্ট অনুশীলন ও অনুশাসনের মধ্যে থাকি আমরা। বিদেশে নানা টুর্নামেন্টে যাই ওখান থেকেই। রিয়োর পরে আমার অনেক উন্নতি হয়েছে, বলছেন আমার কোচ। চোটমুক্ত হয়ে নামতে পারলে পদক একটা আনতে পারব আশা করি। জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে ওজন তুলব। রিয়োর মতো খালি হাতে ফিরতে চাই না টোকিয়ো থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy