মোরাতার ওপর ভরসা রেখেছে স্পেন।
মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম ইটালিকে হারিয়ে শেষ চারে উঠুক বেলজিয়াম। তা হলে হয়তো স্পেনের কিছুটা সুবিধে হত। এই ভাবনা একা আমার নয়, সমস্ত স্পেনবাসীরই।
শনি ও রবিবার মাদ্রিদ শহরটা কার্যত ফাঁকা হয়ে যায়। ছুটি কাটাতে শহরের বাইরে চলে যান অধিকাংশ মানুষ। করোনার কারণে এখন অনেকেই সেই ঝুঁকি নিচ্ছেন না। সুইৎজ়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে শেষ আটের ম্যাচে টাইব্রেকারে দুরন্ত জয়ের পরে অনেকেই গাড়িতে স্পেনের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেউ কেউ আবার খেলা দেখতে লন্ডন যাওয়ার পরিকল্পনাও করছিলেন। যদিও শুনলাম, ওয়েম্বলিতে মাত্র ১২৫টি টিকিট বরাদ্দ হয়েছে স্পেনের সমর্থকদের জন্য। আমি মাদ্রিদে বসে টেলিভিশনেই খেলা দেখব।
এই ইউরোয় চিরো ইমমোবিলে, লোরেনজ়ো ইনিসিনিয়েদের খেলা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে জ়াভি হার্নান্দেস, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, দাভিদ ভিয়াদের সময়ের স্পেনকে। সেই একই রকম বিপক্ষকে তছনছ করে দেওয়ার রণনীতি। স্পেনের মানুষ সব সময়ই দৃষ্টিনন্দন ফুটবল ভালবাসে। আমাদের ফুটবল ঘরানার সঙ্গে অনেকটা লাতিন আমেরিকার মিল রয়েছে। স্পেন কোনও দিনই শক্তি নির্ভর ফুটবল খেলে না। পছন্দও করে না। ইটালি এখন সেই ফুটবলই খেলছে। শক্তির সঙ্গেই শিল্পের একটা সংমিশ্রণ তৈরি করেছেন রবের্তো মানচিনি।
বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে ইটালির ফুটবল যেমন মুগ্ধ করেছে, তেমনই রক্তচাপ বাড়িয়েছে। ইটালির দুটি রূপ দেখলাম। প্রথমার্ধে আক্রমণাত্মক ফুটবল। নিকোলো বারেল্লা ও ইনসিনিয়ে যুগলবন্দিতে বিরতির আগেই ২-০ এগিয়ে গিয়েছিল ইটালি। দ্বিতীয়ার্ধে লিয়োনার্দো স্পিনাজ্জোলা, জর্জে কিয়েল্লিনি, লিয়োনার্দো বোনুচ্চিরা বোঝাল খেলার ধরন বদলালেও রক্ষণাত্মক ফুটবলকে কী ভাবে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়, তা ওরা ভোলেনি। রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগ তিনটি বিভাগই দুর্দান্ত ইটালির। শক্তিশালী রিজার্ভ বেঞ্চ। ম্যানুয়েল লোকাতেল্লির মতো সৃজনশীল মিডফিল্ডারেরও জায়গা হচ্ছে না প্রথম একাদশে! যে দলের এ রকম গভীরতা ও ভারসাম্য রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে খেলা সহজ নয়।
অনেক অঙ্ক করে আজ খেলতে হবে লুইস এনরিকে-কে। এ বারের প্রতিযোগিতায় সেরা মাঝমাঠ যে ইটালির, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। স্পেনের জাবি আলোন্সো যে ভাবে ঠান্ডা মাথায় বিপক্ষের ছন্দ নষ্ট করে দিত, ইটালির জর্জে লুইজ় (জর্জিনহো) সেই কাজটাই নিখুঁত ভাবে করছে। দু’প্রান্ত দিয়ে মার্কো ভেরাত্তি ও বারেল্লা আক্রমণে উঠছে। সামনে থাকে ইনসিনিয়ে, ইমমোবিলো ও ফেদেরিকো কিয়েসা। এক জনকে আটকাতে গেলে বাকি দু’জন বেরিয়ে যাবে। স্ট্রাইকার ত্রয়ী কিন্তু আবার বাড়তি মিডফিল্ডারের দায়িত্বও পালন করছে। তাই ম্যাচের শুরু থেকেই স্পেনের ফুটবলারদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইটালির মাঝমাঠের ছন্দ নষ্ট করে দেওয়া। আমার মনে হয় সের্খিয়ো বুস্কেৎসের উপরেই এই দায়িত্বটা দেবে এনরিকে। দুই) স্পেনের রক্ষণ নিয়ে আমার চিন্তা হচ্ছে। ইটালির আক্রমণভাগের তিনমূর্তি যে কোনও জায়গা থেকে গোল করতে পারে। সঙ্গে মাঝমাঠের ফুটবলাররাও গোল করতে দক্ষ। এত দ্রুত গতিতে ওরা বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে ঢুকছে, সামান্য অসতর্ক হলেই বিপর্যয় অনিবার্য।
ইটালির খেলার আরও একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, পরিস্থিতি অনুযায়ী রণকৌশল বদলে ফেলার ক্ষমতা। প্রতিপক্ষ রক্ষণে ফুটবলারের সংখ্যা বাড়ালেই ওরা প্রান্ত দিয়ে আক্রমণ করছে। যা রীতিমতো আতঙ্কের। তিন) আলভারো মোরাতাদেরও চেষ্টা করতে হবে সুযোগের সদ্ব্যবহার করার। চোট পেয়ে স্পিনজ্জোলা ছিটকে যাওয়ায় কেউ কেউ মনে করছেন, ইটালির রক্ষণ একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। বোনুচ্চি, কিয়েল্লিনির মতো দুই স্তম্ভ রয়েছে। স্পিনাজ্জোলার পরিবর্ত হিসেবে বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে খুবই ভাল খেলেছে এমার্সন। সেরি আ-তে জুভেন্টাসের হয়ে মোরাতা যে-হেতু খেলে, তাই ইটালির ডিফেন্ডারদের শক্তি ও দুর্বলতা ও খুব ভাল করেই জানে। এর অবশ্য উল্টো দিকও রয়েছে। কিয়েল্লিনিরাও স্পেনীয় স্ট্রাইকারের ক্ষমতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তা ছাড়া এই ধরনের ম্যাচে এমনিতেই গোল করার পরিস্থিতি খুব একটা তৈরি হয় না। তাই সামান্য সুযোগকেও হাতছাড়া করা চলবে না। শুধু মোরাতার উপরে নির্ভর করলে চলবে না। ফেরান তোরেসকেও দায়িত্ব নিতে হবে। পাবলো সারাবিয়া যদি ম্যাচের আগে সুস্থ হয়ে উঠে তা হলে দুশ্চিন্তা কিছুটা কমবে।
ইউরো ২০১৬-তে ইটালির কাছে হেরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল স্পেনের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন। আশা করছি, মঙ্গলবার ওয়েম্বলিতে জিতেই জবাব দেবে মোরাতারা।
(লেখক ইস্টবেঙ্গলের প্রাক্তন কোচ। সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন: শুভজিৎ মজুমদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy