ম্যাচের তখন ১০ মিনিট। চেলসির যুব দল থেকে উঠে আসা ক্যালাম হাডসন-ওডোইয়ের বাঁকানো ক্রস ব্রাজিলের ডিফেন্স টপকে গিয়ে পড়ল। ব্রিউস্টার ভারসাম্য হারালেও ভলি মারলেন। সেই শট সোজা গিয়ে লাগল ব্রাজিলের গোলরক্ষক ব্রাজাওয়ের গায়ে। ফিরতি বলে আলতো জ্যাবে গোল।
যুবভারতীতে নতুন নায়কের উত্থানের সন্ধ্যায় অন্ধকারে হেনরিক সাম্পাইও ফিলপো (পাওলিনহো)!
অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের চব্বিশ ঘণ্টা আগেও আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিল ব্রাজিল তারকা। আশ্চর্যজনক ভাবে কোয়ার্টার ফাইনালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দুরন্ত হ্যাটট্রিক করা সত্ত্বেও আড়ালে থেকে গিয়েছিল রিয়ান ব্রিউস্টার। বুধবার ব্রাজিল-বধ করে ছবিটা বদলে দিল ইংল্যান্ডের নতুন তারকা।
কোয়ার্টার ফাইনালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ দিন সেমিফাইনালে ব্রাজিল। পর পর দু’ম্যাচে দু’টো দুরন্ত হ্যাটট্রিক করা ব্রিউস্টারের ফুটবলজীবনে আঁধার নেমে এসেছিল বছর দু’য়েক আগে। যখন চেলসি অ্যাকাডেমি তাকে বাতিল করে দিয়েছিল। ব্রিউস্টার প্রত্যাবর্তন ঘটাল লিভারপুলে যোগ দিয়ে। মাত্র ষোলো বছর বয়সেই অনূর্ধ্ব-২৩ লিভারপুল দলের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে এই প্রতিশ্রুতিমান স্ট্রাইকার। মুগ্ধ য়ুর্গেন ক্লপ-ও ব্রিউস্টারকে প্রদর্শনী ম্যাচে সিনিয়র দলের হয়ে খেলিয়েছেন।
শুধু তাই নয়। তাঁর জন্যই লোনে অন্য ক্লাবে খেলার জন্য ব্রিউস্টারকে ছাড়তে পারেনি লিভারপুল। ক্লপ বলেছিলেন, ‘‘এক বছর ধরেই ব্রিউস্টার আমার নজরে রয়েছে। গত কয়েক মাসে তো অভূপূর্ব উন্নতি করেছে। ব্রিউস্টার দারুণ ফুটবলার। দুর্দান্ত ফিনিশিয়ার। ব্রিউস্টার আদর্শ স্ট্রাইকার।’’
ব্রাজিল গোল শোধ করার পরে ফের চমক নতুন নায়কের। ডান দিক থেকে ফিল ফডেনের দুরন্ত পাস। বক্সের মধ্যে ব্রাজিলের প্রতিরোধ করার চেষ্টা। তবু কাট করে ঢুকে পড়ল ভয়ঙ্কর ব্রিউস্টার। ব্রাজিলের গোলকিপার ব্রাজাও আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। তবু বাঁচাতে পারল না ব্রিউস্টারের নেওয়া শট। ৩৮ মিনিটে ইংল্যান্ডকে ২-১ এগিয়ে দিল ম্যাচের নায়ক ব্রিউস্টার।
ইংল্যান্ড স্ট্রাইকারের বিধ্বংসী ফুটবলই চোদ্দো বছর পরে ব্রাজিলের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন ধ্বংস করে দিল। বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সের মধ্যে ব্রিউস্টার ভয়ঙ্কর। কিন্তু মাঠের বাইরে একেবারে অন্য রকম। মুখে শিশুসুলভ সারল্য। আদর্শ লুইস সুয়ারেজের সঙ্গে আশ্চর্য মিল রয়েছে তার। উরুগুয়ে তারকার মতোই অধিকাংশ সময় কানে হেডফোন লাগানো থাকে।
ব্রিউস্টার বলছিল, ‘‘গানই হচ্ছে আমার ভাল খেলার অনুপ্রেরণা। ম্যাচের নিজেকে উদ্বুদ্ধ করি গান শুনেই।’’ কী ধরনের গান পছন্দ? ইংল্যান্ডের নতুন তারকার উত্তর, ‘‘আমি সব রকমের গান শুনি।’’ ইংল্যান্ড শিবিরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ব্রিউস্টারে রক এবং হিপহপ গানের ভক্ত। এ ছাড়াও আফ্রিকার লোকসঙ্গীত রয়েছে তার পছন্দের তালিকায়।
ছন্দ ব্রিউস্টারের খেলাতেও। ইংল্যান্ডের এক সাপোর্ট স্টাফ ম্যাচের পর যুবভারতীতে বলছিলেন, ‘‘ব্রিউস্টারের খেলার মধ্যে আমরা লাতিন আমেরিকার ছন্দ খুঁজে পাই।’’ তার পরেই যোগ করল, ‘‘জেডন স্যাঞ্চো চলে যাওয়ার পর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, স্যাঞ্চোর অভাবপূরণ করার মতো ফুটবলার দলে কেউ নেই। ব্রিউস্টার আমাদের দুর্ভাবনা দূর করেছে। ওর জন্যই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছি।’’
আরও পড়ুন: গতিই নেই, ব্রাজিল জিতবে কি!
যাকে নিয়ে আলোচনা সেই ব্রিউস্টারকে ম্যাচের পর খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। রেফারির শেষ বাঁশি বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে সতীর্থরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার উপর। কোনও মতে তাকে উদ্ধার করে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যান ইংল্যান্ডের সহকারী কোচ। পরে উচ্ছ্বসিত ব্রিউস্টার বলছিল, ‘‘অবশেষে আমার স্বপ্নপূরণ হল। আমি দারুণ খুশি। এর আগেও বেশ কয়েকটা হ্যাটট্রিক করেছি। তবে এই হ্যাটট্রিক স্পেশ্যাল। এই ছন্দটা ধরে রাখতে চাই। সেটাই আমার লক্ষ্য’’ সঙ্গে ব্রিউস্টার যোগ করল, ‘‘এটা দলের সাফল্য। আমার একার কোনও কৃতিত্ব নেই।’’
অসাধারণ একটা মুভ থেকে হল ব্রিউস্টারের হ্যাটট্রিকের গোলটি। ফডেন আবার দুরন্ত। ক্রুয়েফকে মনে করানো টার্ন এবং ঠিকানা লেখা পাস ব্রাজিলের বক্সে। ব্রিউস্টার পৌঁছে গেল। কখনও বল থেকে চোখ সরায়নি এবং তারই পুরস্কার পেল। বল ছাড়া ব্রিউস্টারের নড়াচড়া যে কতটা নিখুঁত, তা আবার বোঝা গেল। ইংল্যান্ডের জয় নিশ্চিত করল নায়ক। কিন্তু ফডেনকেও ভোলা যাবে না।
বুধবার ছিল ইংল্যান্ড ডিফেন্ডার জোনাথন প্যাঞ্জোর জন্মদিন। ব্রিউস্টার তাকেই হ্যাটট্রিক উৎসর্গ করল। বলল, ‘‘হ্যাটট্রিক ও জয় আমার বাবা, মা এবং জোনাথনকে উৎসর্গ করছি।’’
অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ কভার করতে ইংল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসেছেন কুনটি। বেলজিয়ামের নাগরিক হলেও তিনি পেশার কারণে গত পাঁচ বছর ধরে লন্ডনের বাসিন্দা। তিনি বলছিলেন, ‘‘লিভারপুলে আমার অনেক সহকর্মী থাকে। ওদের কাছে শুনেছি ব্রিউস্টারের লড়াইয়ের কাহিনি। লিভারপুলে যোগ দেওয়ার পরেও চেলসির উপেক্ষা ভুলতে পারেনি। একা একাই বাড়তি অনুশীলন করত ব্রিউস্টার। সতীর্থদের বলত, এক দিন আমি ঘুরে দাঁড়াবোই। প্রমাণ করব, আমি শেষ হয়ে যাইনি।’’
ব্রিউস্টারকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের মধ্যেই নিঃশব্দে স্টেডিয়াম ছাড়ল পাওলিনহো। তাকে ঘিরেই চোদ্দো বছর পর অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন দেখছিল ব্রাজিল। এ দিন ব্রাজিল তারকা মাঠ ছাড়ল হতাশার যন্ত্রণা নিয়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy