ফাইল চিত্র।
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। কার্যত একা আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। ইটালির নাপোলিকে বিশ্ব চিনেছিল মারাদোনার সৌজন্যে। অথচ কোচিং জীবনে সাফল্যের শিখরে পৌঁছতে পারেননি তিনি।
অসাধারণ ফুটবলার হলেই যে তিনি দুর্দান্ত কোচ হবেন, তা কিন্তু নয়। আমার আদর্শ ফ্রানৎজ় বেকেনবাউয়ার পেরেছিলেন। মারাদোনা পারেননি। ভারতীয় ফুটবলেও এই নিদর্শন রয়েছে। প্রদীপদা (পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়) সফল হয়েছিলেন। চুনীদা (গোস্বামী) কোচ হিসেবে সফল নন।
কোচ হিসেবে সফল হওয়ার প্রধান শর্তই হচ্ছে অনুমান ক্ষমতা ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা। এক জন তারকা ফুটবলার যখন খেলেন, তিনি সব চেয়ে বেশি নিজের খেলার দিকেই মনোনিবেশ করেন। ফলে তাঁর পক্ষে সব সময় নিজের দলের প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। মারাদোনার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে বলে আমার ধারণা। কোচকে কিন্তু দলের সব বিভাগ নিয়ে ভাবতে হয়। সেই সঙ্গে সব সময় মাথায় রাখতে হয় প্রতিপক্ষের রণনীতি।
ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের রণকৌশল বদলে ফেলাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবেগের উপরে অসম্ভব নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। একটা ম্যাচ নানা ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। তার মধ্যে অন্যতম হল, খেলায়াড় জীবনে কী ভুল করেছিলাম, তা অনুসন্ধান করে ছেলেদের পরামর্শ দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, রক্ষণের ফুটবলারদের কোচ হিসেবে সফল হওয়ার সংখ্যাটা অনেক বেশি। তাঁর প্রধান কারণ পিছন থেকে পুরো মাঠটা তাঁরা দেখতে পারেন। কোথায় ভুলত্রুটি হচ্ছে, তা খুব সহজেই চোখে পড়ে যায়। খেলা চলাকালীন সতীর্থদের বলতে পারেন, কী ভাবে খেলা উচিত। প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গা কোনটা। ক্রিকেটে উইকেটকিপারেরও একই ভূমিকা থাকে। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিংহ ধোনির এত সাফল্যের সম্ভবত এটাও একটা কারণ।
মারাদোনা ছিলেন আক্রমণের প্রধান স্তম্ভ। ফলে খেলোয়াড়জীবনে ওঁকে সব চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের কড়া ট্যাকল এড়িয়ে গোলের রাস্তা খুঁজে বার করতে। ওঁর পক্ষে নিজের দলের রক্ষণে নজর দেওয়ার মতো পরিস্থিতি খুব একটা ছিল না। কোচিংয়ের একটা আলাদা ঝোঁকও থাকার ব্যাপার আছে। মারাদোনার মতো মহাতারকা, যিনি ফুটবলার হিসেবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করেই ফেলেছিলেন, তাঁর যদি কোচিংয়ের প্রতি আলাদা স্বপ্ন না থাকে, অবাক হওয়ার নেই।
আরও একটা সমস্যা হচ্ছে প্রত্যাশার চাপ। সমর্থকেরা মনে করেন, ফুটবলার হিসেবে যিনি এত সফল, কোচিংয়েও সেই ধারা তিনি বজায় রাখতে পারবেন। এই চাপটা অনেকেই নিতে পারেননি। মোহনবাগানের কোচ হিসেবে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে প্রথম ডার্বির আগে আমি সারা রাত ঘুমোতেই পারিনি। একটাই আশঙ্কা মনের মধ্যে বার বার ঘুরে ফিরে আসছিল, ব্যর্থ হব না তো? ছেলেরা আমার কথা ঠিক মতো শুনবে তো? ফুটবলার হিসেবে অসংখ্য ডার্বি খেলেছি। কখনও এ রকম হয়নি। ধীরে ধীরে অবশ্য ভয় কাটিয়ে উঠেছিলাম। প্রদীপদা বলতেন, ‘‘বাবলুবাবু, কোচের কাজ অনেকটা জাহাজের ক্যাপ্টেনের মতো। সমস্ত বাধাবিপত্তি এড়িয়ে সকলকে তুষ্ট করে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অতীতে তুমি কী করেছো ভুলে যেতে হবে। সব সময় শেখার মানসিকতা থাকতে হবে। দলের সমস্ত কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার। এগুলো করতে না পারলে যত বড় ফুটবলারই হও, কোচ হিসেবে কোনও দিনই সাফল্য পাবে না।’’
মারাদোনার কোচিং দেখে আমার সব সময় ফুটবলার মারাদোনার ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠত। সেই একই রকম আবেগপ্রবণ, সেই মরিয়া ভাব, টাচলাইন ধরে সেই আগ্রাসী চলাফেরা। শুধু পায়ে বলটাই যা ছিল না। কোচেদের প্রথম কাজ, আবেগকে বশে রাখা। কী মাঠে, কী মাঠের বাইরে মারাদোনা কখনও সেই চেষ্টা করার কথা ভেবেওছেন বলে মনে হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে লিয়োনেল মেসিকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো আদর করা বা ঘন-ঘন উত্তেজিত হয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে দেওয়া— কোচ মারাদোনা মানে আবেগে ভেসে যাওয়া সব ছবি। আমার মনে হয়, পেলে এই সত্যটা বুঝেছিলেন যে, ফুটবলার হিসেবে তিনি এত কিছু পেয়ে গিয়েছেন, তার পরে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা কার্যত অসম্ভব। সেই কারণে কোচিংয়ে আসেননি।
কিন্তু মারাদোনা যে ফুটবলার হিসেবে সমস্ত কিছু পেয়েও কোচ হওয়ার ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন, তা থেকেই তাঁর চরিত্রটা আরও ভাল ভাবে ফুটে ওঠে। মারাদোনা ছিলেন দুঃসাহসিক অভিযাত্রী। উথালপাতাল সমুদ্রে পড়তে পারি জেনেও পিছিয়ে আসার বান্দা নন। আর একটা কথাও বলে রাখা জরুরি। কোচ হিসেবে মারাদোনা সফল হোন না হোন, তাতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, আকর্ষণ, ঔজ্জল্য এতটুকু কমেনি। ফুটবলার মারাদোনা যে ঐশ্বরিক অনুভূতি দিয়ে গিয়েছেন সারা পৃথিবীর ফুটবলভক্তদের, তা সারা জীবনের সেরা প্রাপ্তি।
মারাদোনা যখন প্রথম বার কলকাতায় এসেছিলেন, আমি তখন মোহনবাগানের কোচ। দোভাষীর মাধ্যমে আমাদের আলাপ হয়েছিল। অফুরন্ত প্রাণশক্তি। অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, অবসরের অত দিন পরেও, বয়স হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মাঠে নেমে যে ভাবে অবলীলায় বাঁ-পায়ে বল জালে জড়িয়ে দিচ্ছিলেন, তা দেখে। মারাদোনার বাঁ-পায়ের জাদুতে তার অনেক আগে থেকেই গোটা বিশ্ব আচ্ছন্ন। বলের উপরে ওই রকম নিয়ন্ত্রণ অবিশ্বাস্য! বুধবার রাতে যখন ফুটবলের রাজপুত্রের অকস্মাৎ মৃত্যুর খবরটা শুনলাম, বাক্রুদ্ধ হয়ে যাই। মোহনবাগান মাঠে মারাদোনার সঙ্গে ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে এখনও ভেসে উঠছে অবসরোত্তর, বয়স হয়ে যাওয়া জাদুকরের পায়ে বল নাচানোর সেই দৃশ্য। বল যাঁর কথা শুনত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy