দু’জনই তাঁরা ভারতীয় ফুটবলের আইকন। কিন্তু চুনী-পিকে বেশির ভাগ বিষয় নিজস্ব মতাদর্শে ঐতিহাসিক ভাবে দুই মেরুর বাসিন্দা যেন! তবে ধ্যানচাঁদের এখনও ভারতরত্ন সম্মান না পাওয়া নিয়ে হকির যাদুকরের ১১১তম জন্মদিনের চব্বিশ ঘণ্টা আগে দেশের দুই কিংবদন্তি প্রৌঢ় ক্রীড়াবিদ সম্পূর্ণ একমত! প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় আর চুনী গোস্বামী দু’জনই রবিবার দাবি তুললেন, সচিন তেন্ডুলকরের পরে অন্তত এ বার দেশের দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ধ্যানচাঁদকে ভারতরত্ন দেওয়ার।
দুই পদ্মশ্রী ফুটবলারই মনে করেন, ভারতরত্ন খেলাধুলোয় হাজার অবদান রাখা সত্ত্বেও কোনও ক্রীড়াবিদকে দেওয়া হয় না, সেই ধারণার দেওয়ালটা সচিন ভেঙে দিয়েছেন। দু’বছর আগে দেশের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ভারতরত্ন হয়ে। পিকে-চুনীর প্রশ্ন, তা হলে মাঝে এক বছর কেটে যাওয়ার পরে এ বছর ধ্যানচাঁদের জন্মদিনে ভারতের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানে তাঁকে ভূষিত করা হবে না কেন? যেটা আবার কিনা এ দেশের জাতীয় ক্রীড়াদিবস হিসেবে স্বীকৃত। দু’জনেই বিশ্বাস করেন, ভারতীয় হকিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সবসেরা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ধ্যানচাঁদের যা অসাধারণ অবদান, এ দেশের কোনও খেলায় কোনও খেলোয়াড়ের সেই কৃতিত্ব নেই। এমনকী চুনী-পিকে মনে করেন, ফুটবলে তাঁদের নিজেদেরও সেই অবদান নেই। একই প্রেক্ষিতে সচিনকেও তাঁরা একটু হলেও পিছিয়ে রাখতে চান ধ্যানচাঁদের তুলনায়।
পিকে বললেন, ‘‘বিশ্ব ফুটবলে পেলে যা, ক্রিকেটে ব্র্যাডম্যান যা, হকিতে ধ্যানচাঁদ ঠিক তাই। এঁরা যে কোনও যুগের সঙ্গে নিজের খেলাকে মানিয়ে নিয়ে সবার সেরাই থাকতেন, এতটাই এঁদের উঁচুমানের স্কিল আর পারফেকশন। তাই ধ্যানচাঁদ তিরিশের দশকের হকির যাদুকর বলে এখন তাঁর ড্রিবল আটকে যেত মনে করার কোনও কারণ নেই। ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিশিয়ান-ই। পি সি সরকার সিনিয়র আজও ম্যাজিক দেখালে কেউ তাঁর ট্রিক ধরতে পারত না। ধ্যানচাঁদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়।’’
চুনী আবার বললেন, ‘‘ধ্যানচাঁদের আমলে বাকি বিশ্বে হকির স্ট্যান্ডার্ড কেমন ছিল এ সব প্রশ্ন আমার মতে অবান্তর। কোনও প্লেয়ার তাঁর নিজের সময়ই কেবল খেলতে পারে। তার আগে নয়, পরেও নয়। সেটা তার দোষ-গুণ কোনওটাই হতে পারে না। ফলে ধ্যানচাঁদের উনিশশো আঠাশ থেকে টানা তিনটে অলিম্পিক্সে হকির সোনা, তিনটে ফাইনালেই তাঁর গোল করাটা অবিশ্বাস্য কৃতিত্ব। ওই সময় আন্তর্জাতিক আসরে ভারত বলতে ভারতীয় হকি দলকেই বোঝাত। আর সেটার পিছনে ধ্যানচাঁদ। তাঁর আগে বিশ্বে আর কোনও খেলায় ভারতকে এতটা ভয়ঙ্কর দাপুটে দেখায়নি। ক্রিকেট তো অনেক পরের ব্যাপার। ফুটবলে আমার ক্যাপ্টেন্সিতে ষাটের দশকে ভারত এশিয়ান গেমসে সোনা, এশিয়া কাপে রুপো জিতেছে। কিন্তু আমাদের সাফল্যে এ দেশের ফুটবলে সেই উন্নতি ঘটেনি যা ধ্যানচাঁদের অবদানে ভারতীয় হকিতে ঘটেছিল। ওঁর পরে ভারত আরও টানা কুড়ি বছর হকিতে বিশ্বসেরা ছিল। আরও পাঁচটা অলিম্পিক্স সোনা জিতেছে।’’ পিকে তো বছর পঁয়তাল্লিশ পরেও ভেবে যন্ত্রণা পাচ্ছেন, ১৯৭০-৭২ যখন তিনি অর্জুন পুরস্কার কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সেই সময় একবার তাঁর কাছে বলা ধ্যানচাঁদের দুঃখের কথা। ‘‘ধ্যানচাঁদ যেমন ভদ্রলোক ছিলেন, তেমনই নম্র স্বভাব ছিল। সেই মানুষও সর্বোচ্চ সরকারি স্বীকৃতি না পাওয়ার দুঃখ চেপে রাখতে পারেননি। বাহাত্তর সাল হয়তো হবে। পাতিয়ালায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টসে আমাদের কমিটির একটা মিটিংয়ের সময় উনি আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তখন উনি পাতিয়ালারই এক হাসপাতালে ভর্তি। ওঁর বড় ছেলে রাজকুমারের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। অসুস্থ ধ্যানচাঁদ সেদিন আমাকে বলেছিলেন, দেখো, যেন একটা বড় সরকারি স্বীকৃতি দেশ আমাকে দেয়। বার্লিনে আমার আর আমার ভাই রূপ সিংহের নামে রাস্তা পর্যন্ত আছে। কিন্তু আমার নিজের দেশে আমি সে ভাবে গুরুত্ব পাইনি,’’ এ দিন বলছিলেন পিকে।
পিকে-চুনী দু’জনেই মনে করছেন, এর পরেও ধ্যানচাঁদের ভারতরত্ন না হওয়াটা ‘এ দেশেরই লজ্জা, গ্লানি!’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy