প্রাক্তন ক্রিকেটার রজার বিন্নী, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বোর্ড সচিব জয় শাহ। ফাইল ছবি
জয় শাহ নন? নাহ্, জয় শাহ নন! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মসনদে আসীন হওয়ার জন্য এই সে দিন পর্যন্তও যাঁর নাম শোনা যাচ্ছিল, মঙ্গলবার দুপুরে তিনিই ছিটকে গেলেন দৌড় থেকে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমল শেষ হয়ে গেল বিসিসিআইয়ে। জানিয়ে দেওয়া হল, শুরু হতে চলেছে রজার বিন্নীর যুগ। গত বারের মতো শেষ মুহূর্তে বড় কোনও মোচড় (যেখানে ‘হট ফেভারিট’ ব্রিজেশ পটেলকে সরিয়ে সভাপতি হয়েছিলেন সৌরভ) না-হলে কর্নাটকের প্রবীণ ক্রিকেটারই বিসিসিআই সভাপতি হতে চলেছেন।
তবে একই সঙ্গে যা জানা যাচ্ছে, অমিত শাহের পুত্র জয় যেখানে ছিলেন, সেখানেই থেকে গেলেন। বোর্ডের সচিব। অর্থাৎ, দু’নম্বরে।
কিন্তু কেন?
জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা জানাচ্ছেন, কারণ, নরেন্দ্র মোদী চাননি। এবং তিনি সেই মর্মে আগে সঙ্কেতও দিয়ে রেখেছিলেন। গত ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লা থেকে ভাষণ দেওয়ার সময় ‘পরিবারতন্ত্র’-এর বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলে দিয়েছিলেন, ‘‘সির্ফ রাজনীতি হি নহি, দেশ কি কঁয়ি সারে সংস্থাঁও মে ভি পরিবারবাদ কি ছায়া দিখ রহা হ্যায়। ইসসে হমে নিকাল না হ্যায়।’’ অর্থাৎ,‘‘শুধু রাজনীতি নয়, দেশের বিভিন্ন সংস্থাতেও পরিবারতন্ত্রের ছায়া দেখা যাচ্ছে। এটা থেকে আমাদের বেরোতে হবে।’’
তখন প্রায় গোটা দেশ ভেবেছিল, মোদী আসলে গান্ধী পরিবারের কথা বলছেন। রাজনীতির দিক দিয়ে দেখতে গেলে সেটা ভাবাই স্বাভাবিক। কারণ, বরাবরই ‘পরিবারবাদ’-এর প্রসঙ্গে সনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধীকে নিশানা করেছেন মোদী। নিশানা করেছে বিজেপি। কিন্তু জাতীয় রাজনীতির কারবারিরা জানাচ্ছেন, একই সঙ্গে মোদী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি সরকারে তো বটেই, বিভিন্ন সংস্থাতেও পরিবারতন্ত্র তুলে দিতে চান। মোদীর ‘মন কি বাত’ বোঝেন, এমন দাবি যাঁরা করেন, তাঁদের দাবি, সে কারণেই অমিত-তনয় জয়ের বোর্ড সভাপতি হওয়া হল না। তিনি থেকে গেলেন সেই সচিব পদেই। এই অংশের বক্তব্য, যে নীতি নিয়ে মোদী এবং বিজেপি বিরোধী কংগ্রেসকে আক্রমণ করে, সেই নীতি আগে তাদের প্রণয়ন করতে হবে। নইলে সেই রাজনৈতিক আক্রমণ ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই অমিত-পুত্রকে দিয়েই সেই ‘উদাহরণ’ তৈরি করল বিজেপি। তৈরি করলেন প্রধানমন্ত্রী।
তা হলে জয়কে কেন সচিব পদেই বা রেখে দেওয়া? অনেকে বলছেন, জয় সচিব ছিলেন। সেই পদেই রইলেন। ফলে তাঁর সে অর্থে বোর্ড বা ক্রিকেট রাজনীতিতে কোনও ‘উত্তরণ’ হল না। অর্থাৎ, ‘পরিবারতন্ত্র’-এর ছায়ায় তাঁর উন্নতি হল না। আবার তিনি বোর্ডেও রইলেন। পাশাপাশিই এই বার্তাও দেওয়া হল যে, ক্রীড়া সংস্থার মাথায় রাজনীতিক বা রাজনীতির ছোঁয়া রাখতে চাইছেন না প্রধানমন্ত্রী। চাইছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
আর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে যা বলা হচ্ছে, তা আগেই জানিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন— তিনি কোনও সময়েই সভাপতির দৌড়ে ছিলেন না।
অতঃপর, কেন বিন্নী? প্রথমত, তিনি ভারতের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য। তাঁর ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন। প্রচারের আলোয় থাকতে চান না। সব থেকে বড় কথা, তাঁকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতেও সুবিধা। একই সঙ্গে বিন্নীকে বোর্ডের শীর্ষে বসালে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে এই বার্তা যাবে যে, ফুটবল বা হকির মতো ক্রিকেটেও প্রাক্তন খেলোয়াড়ের হাতেই দায়িত্ব দেওয়া হল। আরও এক ধাপ এগিয়ে বললে, এক প্রাক্তন ক্রিকেটারের হাত থেকে আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটারের হাতেই বোর্ডের দায়িত্ব গেল। সর্বভারতীয় ফুটবল সংস্থার নির্বাচনে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবে। সম্প্রতি হকি ইন্ডিয়ার সভাপতি হয়েছেন দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক দিলীপ তিরকে। সেখানে কোনও নির্বাচনই হয়নি। যদিও খেলোয়াড়ি গরিমার নিরিখে বিন্নী সৌরভের ধারেপাশেও আসেন না। তিনি শুধু ক্রিকেটারই ছিলেন। ‘চরিত্র’ হয়ে উঠতে পারেননি। সম্ভবত চানওনি। বস্তুত, একটি সূত্রের দাবি, বিন্নী নিজে সভাপতির চেয়ারে বসার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। কারণ, তিনি নিজের শহর বেঙ্গালুরু ছেড়ে খুব একটা বেরোতে চান না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে রাজি করানো হয়েছে। শেষ মুহূর্তে নাটকীয় কোনও রদবদল না ঘটলে বিন্নীই পরবর্তী বোর্ড সভাপতি হতে চলেছেন।
প্রসঙ্গত, মোদীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার সামগ্রিক ভাবেই ক্রীড়া সংস্থার মাথায় রাজনীতিক রাখতে চায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দেশের বিজেপি-শাসিত বেশ কিছু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ফুটবল প্রশাসনের শীর্ষে আসতে উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু তাঁদের সকলকেই পত্রপাঠ ‘না’ বলে দেওয়া হয়েছে। এআইএফএফের প্রশাসনিক শীর্ষপদে কোনও মুখ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অথবা রাজনীতিককে আসতে দেওয়া হয়নি।
কয়েকটি মহল থেকে বলা হচ্ছে, সৌরভকে বোর্ড সভাপতি করা হয়েছিল কোনও ‘মূল্য’ দেওয়ার বিনিময়ে। ওই সব মহলের দাবি, সেই ‘মূল্য’ ছিল বিজেপিতে যোগদান। কিন্তু সৌরভ তা করেননি। তাই তাঁকে আর একটি মেয়াদ শেষের পর আর বোর্ড সভাপতি পদে রাখা হল না। যদিও কোনও আনুষ্ঠানিক স্তরে এর সত্যতা মেলেনি। তবে এটা ঠিকই যে, সৌরভের কাছে রাজনীতিতে তথা বিজেপিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু সৌরভ ‘সক্রিয়’ রাজনীতিতে যেতে রাজি হননি।
কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, এই পর্যায়ে সৌরভ কোনও সময়ই সভাপতির দৌড়ে ছিলেন না। বিরাট কোহলীর সঙ্গে প্রকাশ্য সঙ্ঘাত-সহ বিবিধ কারণে সৌরভ দেশের ক্রিকেট প্রশাসনে খুব একটা ‘জনপ্রিয়’ নন। তিনি এ-ও জানতেন যে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ভোটে লড়লে তাঁর দশা ভাইচুং ভুটিয়ার মতো হবে (কল্যাণের বিরুদ্ধে ভোট লড়ে অতীতের ফুটবল সুপারস্টার ভাইচুং পেয়েছিলেন সাকুল্যে একটি ভোট)। মঙ্গলবার সকালেই সৌরভ ঘনিষ্ঠ এবং হিতৈষীদের জানিয়ে দেন, তিনি নন। সভাপতি হতে চলেছেন বিন্নী। হয়তো সেই কারণেই যে দিন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাঁর বোর্ডের নির্বাচনে লড়ার ব্যাপারে বাধা উঠে গিয়েছিল, সে দিনও তেমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা যায়নি সৌরভকে। মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি বলেছিলেন, ‘‘এটি আদালতের বিচারাধীন বিষয়। ফলে এই নিয়ে এখনই কিছু বলতে চাই না।’’
এখন প্রশ্ন, সৌরভ কি তাহলে আইসিসি-তে যাবেন? বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার চেয়ারম্যানের পদ নভেম্বরে খালি হচ্ছে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে নিউজিল্যান্ডের গ্রেগ বার্কলের। এ বার ভারত থেকেই কারও চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু এখানেও সৌরভের যাওয়ার ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এ ক্ষেত্রেও কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সাহায্য’ প্রয়োজন। ফলে এর পিছনেও থাকতে পারে নানা অঙ্ক। দেওয়া হতে পারে নানা ‘শর্ত’। শুধু তা-ই নয়, বার্কলে নিজে আরও তিন বছর আইসিসি-র চেয়ারম্যান পদে থেকে যাওয়ার ইচ্ছা ইতিমধ্যেই প্রকাশ করেছেন। ফলে ক্রিকেট প্রশাসক সৌরভের রাস্তা খুব মসৃণ নয়। তবে তাঁর অনুরাগীরা মনে করছেন, সৌরভ তো! শেষ মুহূর্তে সব হিসেব উল্টেপাল্টে দিয়ে কোনও না কোনও একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতেই পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy