রোহিত শর্মা (বাঁ দিকে) ও বিরাট কোহলি। বাঁহাতি স্পিনারের সামনে নড়বড়ে দেখাচ্ছে ভারতের দুই ব্যাটারকেই। —ফাইল চিত্র।
রোহিত শর্মা ১৩ বার। বিরাট কোহলি ১১ বার। শুভমন গিল ১১ বার। না, ভারতীয় ব্যাটারদের শতরানের কোনও হিসাব এটা নয়। গত চার বছরে টেস্টে বাঁহাতি স্পিনারদের সামনে ঠিক এত বারই আউট হয়েছেন ভারতের এই তিন ব্যাটার। তালিকা লম্বা। বাঁহাতি স্পিনারদের বিরুদ্ধে আউট হওয়ার তালিকায় লোকেশ রাহুল বা সদ্য জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া সরফরাজ় খানও রয়েছেন। কেন বার বার এই ছবি দেখা যাচ্ছে? কোথায় সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় ব্যাটারদের? যে দেশের ব্যাটারেরা এক সময় স্পিনের বিরুদ্ধে সাবলীল ব্যাট করতেন, সেই দেশের ব্যাটারেরা ঘরের মাঠে স্পিন খেলতে না পেরে ম্যাচ হারছেন। এই ছবিই কিন্তু তুলে দিচ্ছে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেন বার বার এটা হচ্ছে?
এর আগেও অবশ্য এই ঘটনা দেখা গিয়েছে। অতীতে ইংল্যান্ডের মন্টি পানেসর, শ্রীলঙ্কার রঙ্গনা হেরাথের সামনে খেই হারিয়েছে ভারতীয় ব্যাটিং। সেই রোগ এখন মহামারিতে পরিণত হয়েছে। নিউ জ়িল্যান্ডের বাঁহাতি স্পিনারেরা এই সিরিজ়ে ভারতের ২২টি উইকেট নিয়েছেন। মিচেল স্যান্টনার মাত্র একটি ম্যাচেই নিয়েছেন ১৩টি উইকেট। কেরিয়ারে ২৯টি টেস্টে প্রথম বার দু’টি ইনিংসে পাঁচ উইকেট বা তার বেশি নিয়েছেন স্যান্টনার। তাঁর বলে কোনও দিনই বেশি ঘূর্ণি ছিল না। উইকেটে বল করেন। কখনও সামান্য বল ঘোরে। তাতেই ভারতীয় ব্যাটারেরা কাত হয়েছেন। পুণেতে যে ১৩টি উইকেট তিনি পেয়েছেন তার বেশির ভাগই উইকেটে বল রেখে। ব্যাটারেরা ভুল লাইনে খেলেছেন। ভেবেছেন বল ঘুরবে। কিন্তু সোজা গিয়েছে। আর এক কিউয়ি বাঁহাতি স্পিনার অজাজ পটেল নিয়েছেন ন’টি উইকেট। আগের বার ভারতে এসে মুম্বইয়ে এক ইনিংসে ভারতের ১০টি উইকেটই নিয়েছিলেন তিনি। এ বার প্রথম ইনিংসে পেয়েছেন পাঁচটি উইকেট। তাঁর বল ঘোরে। কিন্তু স্যান্টনার তো দলে নিয়মিত সুযোগই পান না। তাঁর কাছে এ ভাবে আউট হওয়া প্রকাশ করে দিয়েছে ভারতীয় ব্যাটারদের দুর্বলতা।
বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ দায়ী
২০২১ সালে প্রথম বার বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হয়। টেস্টের বিশ্বকাপ। তার আগে টেস্টে সাধারণত দ্বিপাক্ষিক সিরিজ়ই চলত। কিন্তু বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর পরে বদলে গেল ছবিটা। ২০২০ সালের আগে ৫২টি ইনিংসে মাত্র সাত বার বাঁহাতি স্পিনারের বিরুদ্ধে আউট হয়েছিলেন কোহলি। এই সময়ে রোহিত ১৯টি ইনিংসে সাত বার বাঁহাতি স্পিনারের বলে আউট হয়েছিলেন। পরের চার বছরে সংখ্যাটা অনেক বেড়ে গিয়েছে। কোহলি ১১ বার। রোহিত ১৩ বার। তবে কি ফাইনালে ওঠার চাপ পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে? ফাইনালে উঠতে গেলে ম্যাচ জিততে হবে। তার জন্য প্রয়োজনে আক্রমণাত্মক ক্রিকেটও খেলতে হবে। ব্যক্তিগত মাইলফলকের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে দলকে।
কানপুরে বৃষ্টির জেরে দু’দিনের খেলা ভেস্তে গেলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারত জিতেছিল। ওভার পিছু সাড়ে ৮ রান রেট রেখে খেলেছিলেন রোহিত, কোহলিরা। ম্যাচ শেষে রোহিত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা সব ম্যাচ জিততে চান। তাই খেলার ধরন আক্রমণাত্মক হয়েছে। সেই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে গিয়েই কি ডুবছেন ব্যাটারেরা? কিন্তু আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে গেলে তো সব ধরনের বোলারের বলে আউট হবেন ব্যাটারেরা। সেখানে বাঁহাতি স্পিনারের দাপট কেন বাড়বে? এখানেই উঠে আসছে টেকনিকের কথা।
গলদ টেকনিকে
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কানপুরে শাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে ফুল লেংথের বল সুইপ করতে গিয়ে লাইন মিস্ করেছিলেন কোহলি। বল গিয়ে লাগে মিডল স্টাম্পে। একই ঘটনা দেখা যায় পুণেতে। মিচেল স্যান্টনারের প্রায় ফুল টস বলের লাইন মিস্ করেন কোহলি। আবার বোল্ড। এই লাইনের কথা জানালেন বাংলার শেষ রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “সাধারণত বাঁহাতি স্পিনারের বল ডানহাতি ব্যাটারের সামনে পড়ে বাইরের দিকে যায়। যে বলটা ফুল লেংথে পড়ে সেখানে ব্যাট ভুল লাইনে থাকলেই স্লিপে ক্যাচ বা বোল্ড বা এলবিডব্লিউ হয়ে যাবে। সেই জন্যই দরকার টেকনিক। বেঙ্গালুরুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সুনীল গাওস্কর দেখিয়েছিল, স্পিনের বিরুদ্ধে কী ভাবে খেলতে হয়। সেই টেকনিক এখন কোথায়?”
ভারতীয় ব্যাটারদের আউট হওয়ার ধরন দেখে বোঝা যাচ্ছে, বলের লেংথ বুঝতে তাঁদের সমস্যা হচ্ছে। বেঙ্গালুরুতে সামনের পায়ের বল পিছনের পায়ে খেলতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন কোহলি। ২০২০ সালের আগে সামনের পায়ে কোহলির রেকর্ড অনেক ভাল ছিল। আগে কোহলি স্পিনের বিরুদ্ধে উইকেটের সামনের দিকে অনেক বেশি খেলতেন। ক্রিকেটের পরিভাষায় ‘ভি’ (লং অফ থেকে লং অন এলাকা) তে। কিন্তু এখন অনেক বেশি স্কোয়্যারে খেলার চেষ্টা করেন তিনি। স্কোয়্যারে খেলতে গেলেই পিছনের পায়ে খেলার প্রবণতা বাড়ে। বা সামনের পায়ে সুইপ, রিভার্স সুইপ মারতে হয়। এই ধরনের শট খেলতে গেলেই বলের লাইন মিস্ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সেটাই হচ্ছে। ২০২০ সাল থেকে কোহলি সামনের পায়ে খেলতে গিয়ে বাঁহাতি স্পিনারের বিরুদ্ধে চার বার আউট হয়েছেন। পিছনের পায়ে খেলতে গিয়ে আউট হয়েছেন সাত বার।
রোহিতের আর একটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তা হল উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে খেলার প্রবণতা। আগে রোহিত বেশির ভাগ বড় শট খেলতেন ক্রিজ়ের ভিতর থেকে। কোমরের উচ্চতার উপরের বলে পুল মারতেন। কিন্তু এখন তিনি স্পিনারের বিরুদ্ধে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে খেলার চেষ্টা করেন। ফলে লাইন মিস্ করছেন। শেষ চার বছরে সামনের পায়ে খেলতে গিয়ে রোহিত আট বার আউট হয়েছেন। তার মধ্যে চার বার উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে। পিছনের পায়ে আউট হয়েছেন এক বার। একই সমস্যা দেখা গিয়েছে শুভমন গিলের ক্ষেত্রেও। তিনিও সামনের পায়ে ন’বার আউট হয়েছেন কেরিয়ারে।
সাদা বলের ক্রিকেটের প্রভাব
টি-টোয়েন্টি জমানায় ব্যাটারদের ধৈর্য অনেক কমেছে। আগে যে ভাবে টেস্ট হত এখন সে ভাবে হয় না। বেশির ভাগ টেস্টের ফলাফল হয়। সারা দিন ধরে খুব কম ক্ষেত্রেই কোনও দলকে ব্যাট করতে দেখা যায়। কী ভাবে পাঁচ দিনের মধ্যে চারটি ইনিংস শেষ হয় সে দিকেই নজর সকলের। সাদা বলের ক্রিকেট বেশি খেলায় ব্যাটারদের বল ছাড়ার প্রবণতা এখন প্রায় নেই বলেই মনে করেন সম্বরণ। তিনি বললেন, “বেশি সাদা বলের ক্রিকেট খেলায় খুব তাড়াতাড়ি শট খেলে ফেলছে ব্যাটারেরা। ক্রিকেটে বল ছাড়াও যে একটা শিল্প সেটা ব্যাটারদের বুঝতে হবে। এখন কেউ বোলারের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ভাবছে না। বোলারকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। টেস্টে সব সময় তা হয় না।”
মানসিকতায় গলদ
সবটাই কি টেকনিক? না। ক্রিকেটে মানসিকতারও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কোন ক্রিকেটার কোন মানসিক পরিস্থিতিতে রয়েছেন তা তাঁর খেলা দেখে বোঝা যায়। কোহলিই যেমন গত আইপিএলে দুর্দান্ত ফর্মে ছিলেন। কিন্তু তার পর থেকে তাঁর খেলার মান কমেছে। দু’বছর আগেও কোহলির খারাপ সময় গিয়েছিল। ২০২০ থেকে ২০২২ সালে তাঁর ব্যাটে খরা চলছিল। কোহলি নিজেও জানিয়েছিলেন, এক মাস ব্যাট ছোঁননি তিনি। খেলতেই ভাল লাগত না। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে তিনি যে ভাবে আউট হচ্ছেন, সেটা দেখেও বোঝা যাচ্ছে মানসিক ভাবে চাপে তিনি। কারণ, এখন আর সে রকম আগ্রাসন তিনি দেখান না। অনেকটাই শান্ত হয়েছেন। সেই কোহলিও আউট হয়ে ফেরার সময় জলের বাক্সে ব্যাটের বাড়ি মারছেন। বার বার একই ভুল করায় হয়তো মেজাজ হারাচ্ছেন তিনি।
বাঁহাতি স্পিনের বিরুদ্ধে যে ভারতীয় ব্যাটারদের মানসিক সমস্যা হচ্ছে সেটাও মনে করেন সম্বরণ। তিনি বললেন, “ওরা ইনিংস কী ভাবে খেলবে সেই পরিকল্পনা করতে পারছে না। কোহলি, রোহিতেরা যা শট খেলছে তা অবাক করছে। স্পিনের বিরুদ্ধে সব সময় ব্যাট প্যাডের আগে রাখতে হয়। এই সহজ বিষয়টাই তো ওরা ভুল করছে।”
ক্রিকেটের বাইরে মন
কোহলি, রোহিতেরা প্রত্যেকে তারকা। বিজ্ঞাপনে হামেশাই তাঁদের দেখা যায়। অনেক অনুষ্ঠানেও যান। বড় বড় সংস্থার দূত তাঁরা। এই সব কারণে কি খেলা থেকে মন সরছে তাঁদের? সেই কারণেই কি নিউ জ়িল্যান্ডকে অনেক হালকা ভাবে নিয়েছিলেন তাঁরা? এই ধারণা রয়েছে বাংলার রঞ্জি দলের অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্লেরও। তিনি বললেন, “নিউ জ়িল্যান্ডের থেকে ভারতের দল অনেক ভাল। নিউ জ়িল্যান্ডের জেতার ইচ্ছা অনেক বেশি। পরিকল্পনা ভাল করেছে। ভারত করেনি। আমার মনে হয়, টেকনিক্যাল বা মানসিক কোনও সমস্যা নেই। এখানে দলের থেকে ব্যক্তি বড় হয় গিয়েছে। আমরা বিজ্ঞাপন নিয়ে ব্যস্ত। ক্রিকেটের দিকে মন দিচ্ছি না। সেই কারণেই এই ফল।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy