বিরাট কোহলি। — ফাইল চিত্র।
পঞ্চমীর রাত। কলকাতার রাস্তায় ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মানুষ। তার মাঝে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের ম্যাচে কত জন চোখ রেখেছিলেন জানা নেই। চোখ রাখলে নিঃসন্দেহে বিরাট কোহলির ভাল একটি ইনিংস দেখতে পেতেন। বাংলাদেশের ইনিংস শেষ হওয়ার পর থেকেই ভারতের জয় নিয়ে বেশির ভাগ সমর্থকের মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু শেষ মুহূর্তে যে ভাবে অঙ্ক কষে শতরান ছিনিয়ে নিলেন কোহলি, তা মনে থাকার মতো।
ম্যাচের শেষ কয়েকটা ওভার ভোলার মতো নয়। একটা সময় জয়ের জন্যে ২০ রান দরকার ছিল, কোহলির শতরানের জন্যেও ২০ রান। ভারতের জয় নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু কোহলির শতরান কি হবে? এটাই প্রশ্ন ছিল পুণেতে হাজির সমর্থকদের। উল্টো দিকে ছিলেন কেএল রাহুল। তিনি আবার খুচরো রান নিয়ে কোহলির পথে কাঁটা বিছিয়ে দেবেন না তো?
একেবারেই সেটা দেখা গেল না। কিছু দিন আগে শতরানের সুযোগ এসেছিল খোদ রাহুলের সামনে। তিনিও হিসাব কষে খেলেছিলেন। নিজের দোষে শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত শতরান হাতছাড়া হয়েছিল। কিন্তু বৃহস্পতিবার কোহলির ক্ষেত্রে সেটা হতে দিতে চাননি। সে কারণেই কোহলি চাইলেও রাহুল খুচরো রান নিতে অস্বীকার করেন। ফিরিয়ে দেন কোহলিকে। শেষ বলে রান নিয়ে স্ট্রাইক ধরে রাখেন কোহলি।
তবু আনন্দে চোনা ফেলে দিতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের বোলার নাসুম আহমেদ। তিনি প্রথম বলটিই ওয়াইড করেন। কিন্তু কোহলি সরে আসায় আম্পায়ার ওয়াইড দেননি। তখন হিসাব বলছিল, জিততে দরকার ১ রান। কোহলির শতরানে দরকার ৩ রান। শেষ পর্যন্ত সব মধুর ভাবেই শেষ হল। নাসুমকে ছয় মেরে দলকেও জেতালেন কোহলি, নিজের শতরানও করলেন।
উৎসবের আবহের মাঝে পঞ্চমীতেই চারে চার করে ফেলল ভারত। এ বার যাত্রা ধর্মশালার উদ্দেশে। অষ্টমী, অর্থাৎ রবিবারে মুখোমুখি নিউ জ়িল্যান্ড। ভারতের মতোই যারা এই প্রতিযোগিতায় এখনও পর্যন্ত আর এক অপরাজেয় দল। অর্থাৎ রবিবার কার্যত গ্রুপ পর্যায়ের ‘ফাইনাল’।
দুপুরে রোহিত শর্মা টসে হেরে যাওয়ায় অনেকেই সামান্য সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন। কারণ, এই মাঠে আগে ব্যাট করতে পারলে বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়। মাঠ ছোট। বাউন্ডারি মারা সহজ। যতই শাকিব আল হাসান বাংলাদেশের প্রথম একাদশে না থাকুন। বিশ্বকাপে খেলা অভিজ্ঞ ব্যাটারেরা ছিলেন। তা সত্ত্বেও যে লড়াই বাংলাদেশের থেকে প্রত্যাশা করা হয়েছিল তা দেখা গেল না।
বাংলাদেশের শুরুটা ভাল হয়নি। প্রথম দিকে যশপ্রীত বুমরা এবং মহম্মদ সিরাজের বোলিংয়ের সামনে কী রকম যেন কুঁকড়ে ছিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার লিটন দাস এবং তানজিদ হাসান। প্রথম পাঁচ ওভারে মাত্র দশ রান ওঠে। কিন্তু ষষ্ঠ ওভার থেকে খেলা বাংলাদেশের দিকে ঘুরতে থাকে। সিরাজকে দু’টি চার মারার পরেই ছন্দ খুঁজে পান লিটন। পরের পাঁচ ওভারে ৫৩ রান। অর্থাৎ প্রতি ওভারে দশের উপর। লিটনকে এমনিতেই বাংলাদেশে বার বার সমালোচিত হতে হয়। তার উপর এ দিন ছিল ভারতের বিরুদ্ধে বড় ম্যাচ। সেখানে ভাল খেলতে না পারলে দেশজ সমর্থকেরা যে দাঁত-নখ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন তা বলাই বাহুল্য। উঠত তামিম ইকবালকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গও। কিন্তু লিটন সেটা হতে দেননি।
পাঁচ থেকে দশ ওভারের মাঝে অবশ্য অনেক নাটক হয়ে যায়। তৃতীয় বলে লিটনের একটি স্ট্রেট ড্রাইভ বাঁচাতে গিয়ে গোড়ালি ঘুরে যায় হার্দিক পাণ্ড্যের। মাঠেই দীর্ঘ ক্ষণ চিকিৎসা চলে। কিন্তু খোঁড়াতে থাকা হার্দিকের পক্ষে বল করা তো দূর, দৌড়নোই সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি এক সতীর্থ এবং ফিজিয়ো কাঁধে ভর দিয়ে সাজঘরে ফিরে যান। পরে ভারতীয় বোর্ড জানায়, তাঁকে স্ক্যানের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাই ফিল্ডিং করতে পারবেন না। হার্দিকের ওভারের বাকি তিনটি বল করে দেন বিরাট কোহলি, যিনি আন্তর্জাতিক ম্যাচে বল করলেন এক বছর পর। পরিবর্ত ফিল্ডার হিসাবে নামেন সূর্যকুমার যাদব।
বাংলাদেশের ওপেনারেরা বেশ চিন্তাতেই ফেলে দিয়েছিলেন রোহিতদের। লিটন এবং তানজিদকে আটকানোর রাস্তাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল। ১৪ ওভারে জলপানের বিরতি ভারতের কাছে শাপে বর হয়ে গেল। খেলা শুরুর দু’ওভার পরেই তুলে নিলেন তানজিদকে। সবে অর্ধশতরান পাওয়া তানজিদ হাঁটু মুড়ে সুইপ করতে গিয়ে বলের লাইন মিস্ করেন। ডিআরএস নেওয়ার চেষ্টাই করেননি। দ্বিতীয় উইকেট পাওয়ার জন্যেও বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০তম ওভারে রবীন্দ্র জাডেজার বলে এলবিডব্লিউ হন এ ম্যাচে বাংলাদেশের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত।
লিটনকে অবশ্য থামানো যাচ্ছিল না। ভারতের বোলারদের খেলতে অসুবিধা হচ্ছিল না। তাঁকে ফেরালেন জাডেজাই। শুভমনের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন লিটন। পরের দিকে মুশফিকুর এবং মাহমুদুল্লা বাংলাদেশের ভদ্রস্থ স্কোর তুলতে সাহায্য করেন। শেষের দিকে মাহমুদুল্লা চালিয়ে না খেললে বাংলাদেশের রান আড়াইশো পেরনোই মুশকিল হত। কিন্তু পুণের মাঠে যেখানে তিনশো রানই নিরাপদ নয় সেখানে বাংলাদেশের আড়াইশোর কাছাকাছি রান নিয়ে কী ভাবে ভারতকে চ্যালেঞ্জ জানাবে সেটাই ছিল প্রশ্ন।
ভারতের অসাধারণ ফিল্ডিংয়ের দু’টি উদাহরণ দিতেই হবে। প্রথমে প্রথমে কেএল রাহুলের ক্যাচে ফেরেন মেহেদি হাসান মিরাজ। সিরাজের বলে খোঁচা দিয়েছিলেন মেহেদি। বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে প্রায় গোলকিপারের মতো উড়ে দিয়ে বল তালুবন্দি করলেন রাহুল। এর পরের ক্যাচটি জাডেজার। বুমরার বলে স্কোয়ার কাট করতে গিয়েছিলেন মুশফিকুর। পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিলেন জাডেজা। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসাধারণ ক্যাচ নেন। এর পরেই ফিল্ডিং কোচ টি দিলীপকে দেখিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে বলতে, রাতে সাজঘরে সেরা ক্যাচের পদকটি তাঁর গলাতেই ঝুলবে।
ভারত রান তাড়া করার পর যা ভাবা হয়েছিল সেটাই দেখা যায়। তাসকিন আহমেদ না থাকায় এমনিতেই বাংলাদেশের বোলিং কিছুটা দুর্বল ছিল। তার উপর পুণের পাটা পিচে বাংলাদেশের বোলারদের খেলতে কোনও অসুবিধাই হয়নি ভারতের। বল পিচে পড়ে সহজেই ব্যাটে আসছিল। তাই রোহিত এবং শুভমন সযত্নে সেগুলিকে বাউন্ডারিতে পাঠাচ্ছিলেন। এক সময় এটাও মনে হচ্ছিল, ম্যাচটা ভারত ১০ উইকেটে জিতবে না তো।
সেটা অবশ্য হয়নি। ৭টি চার এবং ২টি ছয় মেরে বাংলাদেশের বোলারদের উপর দাপট দেখানোর পর ফিরে যান রোহিত। ব্যক্তিগত ৪৮ রানের মাথায় হাসান মাহমুদের একটি শর্ট বল পুল করেছিলেন। টাইমিং ঠিকঠাক হয়নি। ডিপ ফাইন লেগে তৌহিদ হৃদয়ের হাতে ধরা পড়েন। তিনে নেমে কোহলি জুটি গড়েন শুভমনের সঙ্গে। পাকিস্তান ম্যাচে ১৬ রানে আউট হওয়ার পর এই ম্যাচে শুভমনকে বিন্দুমাত্র চিন্তিত দেখায়নি। অনায়াসে খেলছিলেন বাংলাদেশি বোলারদের। ৫টি চার এবং ২টি ছক্কা মেরে অর্ধশতরান করার পরে হঠাৎই অতিরিক্ত আগ্রাসী হতে গিয়ে ফিরে যান। মেহেদির বলে তুলে মারতে গিয়েছিলেন। বাউন্ডারির ধারে নিপুণ ভাবে ক্যাচ ধরেন মাহমুদুল্লা।
সহজ উইকেটে ভারতকে এর পর চিন্তার মধ্যে পড়তে হয়নি। শুভমনের পরে কোহলির সঙ্গে যোগ দেন শ্রেয়স। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক স্বচ্ছন্দে খেলে গেলেও চিন্তা থাকল শ্রেয়সকে নিয়ে। এই ম্যাচে তাঁর মাথার উপরে কোনও চাপ ছিল না। খুচরো রান নিলেই হত। সে ভাবেই খেলছিলেন। অকারণে মারতে গিয়ে উইকেট খোয়ালেন। আগের ম্যাচে অর্ধশতরান করেছিলেন। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল তিনি ফর্মে ফিরেছেন, তখনই একটা খারাপ ইনিংস খেলে নিজেকে নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন।
এই সব সমালোচনা কিছু ক্ষণের জন্যে চাপা পড়ে যাবে কোহলির ইনিংসের সৌজন্যে। রাহুলের সঙ্গে তাঁর জুটি ইতিমধ্যেই জমে গিয়েছে। এ দিন শতরান পেতে পারেন এ রকম প্রত্যাশা নিয়ে নামেননি কোহলি। কিন্তু সুযোগ আসায় হাতছাড়াও করতে চাননি। পঞ্চমীতে কোহলির শতরান আক্ষরিক অর্থের বাঙালির পুজো শুরু করে দিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy