Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
India beats New Zealand in Semi-final

ওয়াংখেড়েতে বদলাপুর! শামির ৭ উইকেট, শ্রেয়স, বিরাটের সেঞ্চুরি, ১২ বছর পর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন

১২ বছর পর আবার বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত। বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আয়ারের শতরান এবং মহম্মদ শামির সাত উইকেটে ভর করে নিউ জ়‌িল্যান্ডকে হারাল ভারত। রবিবার ফাইনাল আমদাবাদে।

cricket

শামির সঙ্গে উল্লাস রোহিতের। ছবি: পিটিআই।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৩ ২২:২৭
Share: Save:

রুদ্ধশ্বাস কিছু মুহূর্ত। টানটান উত্তেজনা। সমানে-সমানে লড়াই। চাপ, পাল্টা চাপের খেলা। বুধবার রাতে আরবসাগরের তীর দেখল সব কিছুই। সব পেরিয়ে অবশেষে স্বস্তি। ১২ বছর পর বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারত। ১২ বছর আগে যে মাঠে ট্রফি জিতেছিল তারা, সেখানেই নিউ জ়িল্যান্ডকে ৭০ রানে হারিয়ে ফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করে রোহিত শর্মার দল পাড়ি দিচ্ছে আমদাবাদে। আগামী রবিবার প্রতিপক্ষ কারা, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত।

আগে ব্যাট করে ভারত ৩৯৭ রান তোলার পর ওয়াংখেড়ের গ্যালারিতে কোনায় কোনায় উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বাকি দেশেও চিত্রটা ছিল একই। সেমিফাইনালের মতো মহা চাপের ম্যাচে নিউ জ়‌িল্যান্ড ৩৯৮ রান তাড়া করে ভারতকে হারিয়ে দেবে, এটা অনেকেই কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু ক্রিকেট মহান অনিশ্চয়তার খেলা বলেই বুকটা দুরুদুরু করল কিউয়িদের ইনিংসের অন্তত ৪৩ ওভার পর্যন্ত। ড্যারিল মিচেলের সঙ্গে জুটি গড়া কেন উইলিয়ামসন ফিরে গেলেও তত ক্ষণে গ্লেন ফিলিপস বল বাউন্ডারির বাইরে পাঠানো শুরু করে দিয়েছেন। যশপ্রীত বুমরার বলে তুলে খেলতে গিয়ে বাউন্ডারির ধারে রবীন্দ্র জাডেজার হাতে ক্যাচ তুলে নেওয়ার পরেই আবার ওয়াংখেড়েতে উৎসব শুরু। মাঝের দুটো ঘণ্টা যে অসহনীয় উৎকণ্ঠার প্রহর গিয়েছিল ৩৩ হাজার দর্শকদের মধ্যে, তা কেটে যায় ওই একটি আউটেই।

কাকে ছেড়ে কাকে নায়ক বাছা যায় এই ম্যাচে। সেরার পুরস্কার পেলেন মহম্মদ শামিই। কিন্তু অন্তত তিনজনকে সেই পুরস্কার ভাগ করে দেওয়া গেলে তবেই হয়তো যোগ্য বিচার হত। বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আয়ার না থাকলে ভারতের রান ৩৯৭ ওঠে না। সে ক্ষেত্রে এই ম্যাচ নিউ জ়িল্যান্ডের জিতে যাওয়ার কথা। আবার শামি না থাকলে কোহলি, শ্রেয়সের কৃতিত্বও দাম পায় না। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে সাতটি উইকেট নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। যে ক্রিকেটারকে বিশ্বকাপের প্রথম চারটি ম্যাচে বসিয়ে রেখেছিল ভারত, তিনি সেমিফাইনালে সাত উইকেট নিয়ে দলকে ফাইনালে তুলে দিচ্ছেন! রূপকথা বললেও অত্যুক্তি করা হয় কি?

রোহিত শর্মা টসে জেতেন কি না, তা নিয়ে আপামর ক্রিকেটপ্রেমী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। রোহিতের হাত থেকে কয়েন আকাশে উড়ে যাওয়ার সময় ওয়াংখেড়েতে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ম্যাচ রেফারি অ্যান্ডি পাইক্রফ্ট যে মুহূর্তে জানালেন টস জিতেছেন রোহিত, আরবসাগরের পাড়ে শুরু তুমুল চিৎকার। যেন ভারত ম্যাচটা ওখানেই জিতে গিয়েছে।

তবে ভারতের ইনিংসের সময়ে যা ঘটল, তাতে বোঝা যায়নি টস যার ম্যাচ তার। টসে জেতার পূর্ণ ফায়দা অবশ্য তুলেছে ভারত। রোহিত শুরুটা করলেন আগ্রাসী ভাবেই। যেমন তিনি করছেন প্রতি ম্যাচে। প্রথম ওভারে ট্রেন্ট বোল্টকে দু’টি চার মারলেন। ওই ওভার থেকে এল ১০। ওখানেই ম্যাচের অভিমুখ যেন বলা হয়ে গেল। বোল্ট এবং টিম সাউদি মিলে প্রথম পাঁচ ওভারে বেদম মার খাওয়ার পর বাধ্য হয়ে স্পিনার মিচেল স্যান্টনারকে নিয়ে এলেন কিউয়ি অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। স্যান্টনারকেও চার এবং ছয় মেরে স্বাগত জানালেন রোহিত। এক ওভারের বেশি রাখা গেল না তাঁকে।

ভারতের পরিকল্পনা তখন স্পষ্ট। রোহিত এক দিকে আক্রমণ করবেন, শুভমন ধরে খেলবেন। ৪৭ রানে রোহিত ফেরার পর ভূমিকাটা পাল্টে গেল। ক্রিজে আসা কোহলি তখন ধরে খেলবেন, শুভমন মারবেন। ঠিক সে ভাবেই এগোতে থাকলেন তাঁরা। রানও উঠতে থাকল। রাচিন রবীন্দ্র এবং গ্লেন ফিলিপসকে এনেও উইলিয়ামসন বুঝতে পারছিলেন না, ভারতীয় ব্যাটারদের আটকাতে ঠিক কী দরকার।

কিউয়ি বোলারদের উপর দাপট দেখাতে পারলেও মুম্বইয়ের প্রচণ্ড আর্দ্রতাকে হারাতে পারেননি শুভমন। ৭৯ রানের সময় পায়ের পেশিতে টান ধরল। মাঠে কিছু ক্ষণ চিকিৎসকদের পরিচর্যা নিলেন। কিন্তু মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে হল অচিরেই। কিন্তু নিউ জ়িল্যান্ডের তাতে আদৌ কোনও সুবিধা হল না। শ্রেয়স নামার পর রানের গতি কিছুটা কম হয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু ভারতের পরিকল্পনায় কোনও খামতি ছিল না। অহেতুক তাড়াহুড়ো না করে কোহলি এবং শ্রেয়স খুচরো রান নিয়ে স্কোরবোর্ড সচল রাখলেন। মাঝের এই ওভারগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ধৈর্য বজায় রাখা ছাড়া উপায় নেই। কোহলি এবং শ্রেয়স ঠিক সেটাই করলেন। কোনও রকম ঝুঁকির রাস্তায় যাননি।

৩০ ওভারের পর থেকে ভারতের রানের গতি আবার বাড়তে শুরু করল। মাঝে স্যান্টনার একটি ওভার মেডেন দিলেন। পরের ওভারেই বোল্ট দিলেন ১৭। কোহলি ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকেন শতরানের দিকে। অর্ধশতরান পূরণ করে ফেলেন শ্রেয়সও। ৪০ ওভার পেরনোর পরেই কোহলির শতরানের জন্যে উসখুস শুরু হয়ে যায় ওয়াংখেড়েতে। গ্যালারিতে তখন কর্পোরেট বক্স আলো করে বসে ডেভিড বেকহ্যাম, মুকেশ অম্বানী, সিদ্ধার্থ মলহোত্র, কিয়ারা আডবাণী।, ভিকি কৌশলের মতো খ্যাতনামীরা। এ ছাড়া ভারতীয় ক্রিকেটারদের স্ত্রীদের সঙ্গে বসা অনুষ্কা শর্মা তো ছিলেনই।

কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত এল ৪২তম ওভারে। লকি ফার্গুসনের বল ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কোয়ার লেগে পাঠিয়েই ছুটে দু’রান নিয়ে নেন। সচিনকে টপকান তো বটেই, তৈরি করেন একাধিক নজির। খোদ সচিনের উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে কোহলিকে অভিবাদন বুধবারের ওয়াংখেড়ের অন্যতম সেরা মুহূর্ত। ডেভিড বেকহ্যাম কতটা ক্রিকেট বোঝেন জানা নেই। তিনিও সোল্লাসে কিয়ারা, সিদ্ধার্থের সঙ্গে হাততালি দিতে শুরু করেন।

তিন অঙ্কের রানের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন কোহলি। সেটা হয়ে যেতেই মারতে শুরু করেন। কোনও বোলারকেই রেয়াত করেননি। তবে এ ভাবে বেশি দূর এগোতে পারেননি। ১১৭ রানের মাথায় টিম সাউদির বলে ফিরতে হয়। তবে থামছিলেন না শ্রেয়স। কোহলি আউট হওয়ার পর তাঁর রান তোলার গতি আরও বেড়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ৬৭ বলে শতরান করেন। বিশ্বকাপের ইতিহাসে ভারতীয়দের মধ্যে তৃতীয় দ্রুততম। তিনটে নজিরই হয়েছে এ বার। পাশাপাশি, টানা দু’টি ম্যাচে শতরান করলেন শ্রেয়স। মুম্বইয়ের ব্যাটার ফেরার পর রাহুলের মারে চারশোর কাছাকাছি রান তুলে ফেলে ভারত।

ম্যাচের আগে বিশেষজ্ঞেরা বলেছিলেন, পরে ব্যাট করলে প্রথম ১০-১৫ ওভার দেখে খেলতে হবে। নিশ্চয়ই সেই কথা শুনে নেমেছিলেন কিউয়ি ওপেনারেরা। তাই রাচিন এবং কনওয়ে শুরুটা খারাপ করলেন না। বুমরা হোক বা সিরাজ, দু’জনের বলই দেখে খেললেন। প্রথম পাঁচ ওভারে কোনও রক্তক্ষরণ হয়নি। কিন্তু বুমরা, সিরাজকে সামলালেই তো হবে না। মহম্মদ শামি রয়েছেন। বাংলার জোরে বোলার প্রথম বলেই তুলে নিলেন কনওয়েকে। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে খোঁচা দিয়েছিলেন কনওয়ে। বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ রাহুলের।

অষ্টম ওভারে আবার শামির ধাক্কা। এ বার শিকার রাচিন। তৃতীয় বলেই চার মেরেছিলেন। চতুর্থ বল ভেতরে ঢুকে এল। ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে সেই রাহুলের হাতেই ক্যাচ। বিশ্বকাপে অন্যতম সেরা ব্যাটার ফিরতেই ৩৩ হাজারের ওয়াংখেড়েতে কান পাতা দায়। বড় জয় যে সময়ের অপেক্ষা তার প্রহর গোণা শুরু হয়ে গিয়েছিল আরবসাগরের তীরে। কেউ বুঝতে পারেননি আগামী এক-দেড় ঘণ্টা কী অপেক্ষা করে রয়েছে ভারতের জন্যে।

উইলিয়ামসন তবু ধীরস্থির, শান্ত মানসিকতার বলে পরিচিত। চাপে পড়লেও ঘাবড়ে যান না। কিন্তু ড্যারিল মিচেল যে এতটা খুনে চেহারায় আবির্ভূত হতে পারে তা কে জানত! দুটো উইকেট হারানোর ধাক্কা অনায়াসে সামলে নিল নিউ জ়‌িল্যান্ড। বল একটু পুরনো হতেই ভারতের বোলারদের অফ ফর্ম শুরু হয়ে গেল। বুমরা, সিরাজ কেউই সফল হচ্ছিলেন না। বাধ্য হয়ে স্পিনারদের নিয়ে আসেন রোহিত। লাভ হয়নি। উপমহাদেশের বাইরে নিউ জ়িল্যান্ডের ব্যাটারেরাই স্পিনটা ভাল খেলেন। সেটা বোঝা গেল বুধবার।

যে রবীন্দ্র জাডেজা, কুলদীপ যাদবের বলে নাকানি-চোবানি খেতে দেখা যায় বাকি দেশের ব্যাটারদের, সেই দু’জনকেই অনায়াসে খেলে গেলেন উইলিয়ামসন-মিচেল। ১০ ওভারের পর থেকে মোটামুটি স্পিনারদের দিয়েই অনেক ক্ষণ টানলেন রোহিত। কিন্তু সাফল্য এল না। মাঝে এক ওভার শামি, বুমরাকে এনেছিলেন। মার খেয়ে যাওয়ায় সরিয়ে নেন। স্পিনারদের দিয়ে করানোর একটাই উদ্দেশ্য, পরের দিকে শিশির পড়লে যাতে বল গ্রিপ করতে অসুবিধা না হয়। তাতেও মিচেলের হাতে বেশ মার খেলেন দুই স্পিনারই।

তবে খেলা যত গড়াচ্ছিল ততই উইকেটের জন্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছিল। কারণ, ক্রিজে ক্রমশ জমে যাচ্ছিলেন দুই কিউয়ি ব্যাটার। তার মাঝেই উইলিয়ামসনের লোপ্পা ক্যাচ ফেলে দিয়েছিলেন শামি। দু’উইকেট নিয়ে কিউয়িদের দুই ওপেনারকে ফেরানো জোরে বোলারের উদ্দেশে শাপশাপান্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু শামি এমন একজন বোলার, যিনি স্বপ্ন দেখাতে পারেন। যিনি নতুন এবং পুরনো দু’ধরনের বলেই উইকেট নিতে পারেন। ৩৩তম ওভারে পুরনো সৈন্যের হাতেই বল তুলে দিলেন রোহিত। প্রথম বলেই এক রান নিয়ে মিচেল শতরান পূরণ করার সময়ে আবার হতাশা ওয়াংখেড়ে জুড়ে। কিন্তু চমক যে অপেক্ষা করে রয়েছে সেটা জানা ছিল না। দ্বিতীয় বলেই উইলিয়ামসনকে তুলে নিলেন শামি। দু’বল পরে ফিরলেন টম লাথামও। অর্থাৎ তৃতীয় স্পেলে একই ওভারে জোড়া উইকেট।

বোঝা যায়নি এর পরেও চমকের বাকি আছে। গ্লেন ফিলিপস এবং মিচেল মিলে আবার ভারতীয় বোলারদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আস্কিং রেট বাড়ছিল। তাল মিলিয়ে বাড়ছিল কিউয়িদের রান তোলার গতিও। বুমরার বলে ফিলিপস ফিরতেই কিউয়িদের আশা শেষ। পরের দিকে তিনটি উইকেট তুলে নিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে বিশ্বকাপে সেরা বোলিং ফিগার গড়লেন। তা-ও কি না নকআউটের ম্যাচে নিউ জ়িল্যান্ডের মতো দলের বিপক্ষে!

প্রথম চার ম্যাচে খেলানো হয়নি তাঁকে। প্রত্যাবর্তন একেই বলে! প্রত্যাবর্তনের আরেক নাম হয়তো শামি।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy