ক্ষমতাচ্যূত: ইমরান খান।
বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার, দেশের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক, ক্রিকেট মাঠে নেতা হিসেবে যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব প্রশ্নাতীত। ইমরান খান নিয়াজির প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন থেকে এমন নাটকীয় পতন যেন গ্রিক ট্র্যাজেডিকে মনে করায়!
অনাস্থা ভোট এনে ইমরানকে শুধু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেই সরিয়ে দিল না তাঁর বিরোধীরা, তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ারকেও ঠেলে দিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। যে রাজনৈতিক জীবন খুব সংগ্রাম করেই, ক্রিকেট মাঠের সেই হার-না-মানা মনোভাব নিয়েই গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন আমাদের প্রাক্তন অধিনায়ক।
কেন ব্যর্থ হলেন ইমরান? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক আসরে আসার প্রেক্ষাপটের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ১৯৮৭-উত্তর পাকিস্তানের মানুষ যে বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য এবং অবিচার দূর করার ডাক দিয়েছিল, তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের দেশের একের পর এক রাজনৈতিক হেভিওয়েটরা। সেই অপ্রাপ্তির জায়গা থেকে মানুষ চেয়েছিল নতুন কোনও মুখ। ক্রিকেট মাঠের সফল অধিনায়ক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে রাজনীতির বাইশ গজে পড়ে থেকে অবশেষে মানুষের হৃদয় জিতে নিতে পেরেছিলেন।
কিন্তু ক্রিকেট মাঠে যিনি দেশের মানুষের সব প্রত্যাশাই পূরণ করতে পেরেছিলেন, তিনি রাজনীতির পিচে দুনিয়া কাঁপানো অলরাউন্ডারের মতো ব্যাটিং-বোলিং করতে পারেননি। পাকিস্তানে অনেক বিশেষজ্ঞই একমত, ইমরান নিজের তরবারির আঘাতে নিজেই ঘায়েল হয়েছেন, নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মেরেছেন। ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে মগজাস্ত্র প্রয়োগ আর রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝা যে এক জিনিস নয়, তা বোধ হয় বোঝা গেল। ক্রিকেটীয় স্কিলে নয়, কূটনীতিতে সফল হওয়ার দরকার ছিল ইমরানের।
পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ উপহার দেওয়া, ক্রিকেট বিশ্বে দেশকে অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, নানা নিরপেক্ষ আম্পায়ারের অভিনবত্বের ডাক দেওয়া— ক্রিকেট ইমরান খানের অবদানের কথা মনে রাখবে। একই কথা কি বলা যাবে তাঁর রাজনৈতিক ইনিংস সম্পর্কে? পাকিস্তান জুড়ে, এমনকি বিশ্বের দরবারেও তা নিয়েই যত চর্চা। তাঁর ক্রিকেট সাফল্য এবং সুপুরুষ হওয়ার আকর্ষণের জন্য ইমরানকে নিয়ে আগ্রহ যে ছড়িয়ে রয়েছে সারা বিশ্বেই।
ক্রিকেটার ইমরানের উত্থান খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি। লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে এক সময় নিয়মিত ভাবে আসত। সেই সময় ক্রিকেটের প্লে-বয় চরিত্র হিসেবে দ্রুত উঠে আসছে ও। এক বার হল্যান্ড থেকে লন্ডনে ফিরে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি, রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। কী ব্যাপার? কেউ ঢুকে পড়ল নাকি? চিন্তিত ভাবে কিচেনে গিয়ে দেখি, ইমরান। দুধ গরম করছে। আমাকে দেখতে পেয়ে বলল, মাঝেমধ্যেই আমার ফ্ল্যাটে চলে আসে। আমার এক বন্ধুর কাছে ফ্ল্যাটের চাবি থাকত। ইমরানের সঙ্গে ওরও ভাল বন্ধুত্ব ছিল। তাই লন্ডনে আমার ফ্ল্যাটে চলে আসতে অসুবিধা হত না পরবর্তীকালে পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার হয়ে ওঠা অলরাউন্ডারের। সেই সময়ে যদিও ইমরান একা নয়, পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারের জন্যই ভাল আড্ডার জায়গা ছিল আমার লন্ডনের ফ্ল্যাট। সরফরাজ় নওয়াজ়, জাভেদ মিয়াঁদাদও লন্ডনে খেলতে এলেই চলে আসত। আমি সাংবাদিক হলেও একটা পারস্পরিক বিশ্বস্ততার জায়গা অটুট ছিল দু’তরফে।
ইমরানের সঙ্গে সম্পর্কটা যদিও সব সময় সমান থাকল না। কয়েক বছরের মধ্যেই আবিষ্কার করলাম, অন্য অনেকের কথা শুনে আমার প্রতি ওর আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। পরে জেনেছিলাম, কয়েক জন আমার সঙ্গে ওর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখে এতটাই ঈর্ষান্বিত হতে শুরু করেছিল যে, ওর কানে ফিসফিস করা শুরু করে দিল। কয়েক জন গিয়ে ওকে মিথ্যা কথাই বলল যে, আমার ফ্ল্যাটে ওর আসাটা আমি ভাল ভাবে নিচ্ছি না। ইমরান কিন্তু ওই লোকগুলোর কথাই বিশ্বাস করে ফেলল। আমার ফ্ল্যাটে আসা বন্ধ করে দিল। এখন ভাবতে বসে মনে হচ্ছে, অন্য লোকের কথা শুনে এত দ্রুত বিশ্বাস করে ফেললে দেশের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সে সফল হবে কী করে? ১৯৯২ বিশ্বকাপের সময় আরও একটা ঘটনা ঘটল, যা থেকে আবার প্রমাণ পেলাম অন্যের কথায় চট করে প্রভাবিত হয়ে যায় ইমরান। আমি ভারতীয় দলের সঙ্গে যাচ্ছিলাম একটা ম্যাচ কভার করতে। হঠাৎ অভিযোগ করে বসল যে, আমি নাকি ভারতের জয়কে ‘সেলিব্রেট’ করছি। শুনে তো আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
পরে জানতে পারলাম, দিল্লির এক সাংবাদিক ইমরানের কানে আমার ব্যাপারে বানিয়ে বানিয়ে এ সব বলেছিল। আসলে ১৯৯১-তে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবিভেদ ভুলে সংযুক্ত ক্রিকেট বোর্ড যখন গঠিত হল, ডক্টর আলি ব্যাখারের ব্যাঙ্কোয়েটে অনেক সাংবাদিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমন্ত্রিতদের মধ্যে আমি ছিলাম। লন্ডনে বসবাসকারী ‘দ্য টাইমস’-এর ভারতীয় সাংবাদিক মিহির বসু আমার নাম রাখার প্রস্তাব দেন। দিল্লির সেই সাংবাদিক ছিল না। সেই রাগেই ইমরানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বিষিয়ে তোলার এমন মহাউদ্যোগ। এর পর অ্যাডিলেড বিমানবন্দরেও প্রকাশ্যে ঝামেলা হয় আমার এবং ইমরানের। উড়ানের মধ্যে জাভেদ মিয়াঁদাদ আর রেডিয়ো পাকিস্তানের প্রোডিউসার হস্তক্ষেপ না করলে আরও অপ্রীতিকর কিছু ঘটে যেতে পারত।
তবে এর পরে কিন্তু ইমরান নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিল যে, অন্যের কথা শুনে আমার প্রতি আচরণ পাল্টে ফেলে ঠিক করেনি। লর্ডস প্রেসবক্সে এসে আমার সঙ্গে হাত মিলিয়ে যায়। পুরো পাকিস্তান মিডিয়া সেই দৃশ্য দেখল। আমিও পুরনো ঘটনা আর মনে রাখিনি এবং দু’জনে আবার আগের মতো বন্ধু হয়ে যাই। আমার মতো অনেকেই, যারা ক্রিকেটার এবং ক্যাপ্টেন ইমরানকে কভার করেছি, কাছ থেকে রাজকীয় উত্থান দেখেছি, তাদের খুবই খারাপ লাগছে প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন থেকে ওর এই পতন দেখে।
আবার এটাও তো স্বীকার করতে হবে যে, ক্রিকেট মাঠের ইমরান আর রাজনীতির বাইশ গজের ইমরান— দু’টো লোক যেন দু’টো গ্রহের। ক্রিকেট অধিনায়ক হিসেবে যে পাকিস্তান ক্রিকেটে এত সব সংস্কার এনেছে, জহুরির মতো একের পর এক প্রতিভাকে তুলে এনেছে, নিরপেক্ষ আম্পায়ারের মতো অভিনবত্ব আনার প্রধান কারিগর ছিল, সে-ই তো প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে প্রাচীনপন্থাকে আঁকড়ে শাসন করতে চাইল। বিয়ের ছবি নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গিয়েছে, তালিবানদের সমর্থন করা নিয়ে বিশ্ব ক্ষুব্ধ হয়েছে, আমেরিকার সমালোচনা করাও ছিল রাজনৈতিক ভুল। দেশের মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতিও বা কোথায় পালন করা হল? পাকিস্তানের মানুষের জীবনযাত্রার মান যেখানে ছিল, সেখানেই থেকে গিয়েছে। ইমরানের মধ্যে যে সংস্কারক প্রধানমন্ত্রীকে পেতে চেয়েছিল পাকিস্তান, সেই স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গিয়েছে।
এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রাস্তায় যে সব ব্যক্তি নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাঁদের অনেকের সঙ্গেও সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছিল ইমরান। গত কয়েক মাসে তাঁদের কাউকে কাউকে জেলেও ভরা হয়েছে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে। অনাস্থা ভোটের সময় নিজে উপস্থিতই থাকল না। রাজনৈতিক মহল যা দেখে বলছে, ‘উদ্ধত আচরণ’।
ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে প্রতিভা, দক্ষতা, ফলকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন পাকিস্তান গড়ে তুলেছিল। এখন কেউ যদি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের স্কোরবোর্ড মেলাতে বসে, দোষ দেওয়া যাবে কি?
(লেখক পাকিস্তানের নামী ক্রিকেট লিখিয়ে। ইমরান-যুগ সহ চার দশকের উপরে কভার করেছেন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy