রাহানে অজিঙ্ক। তবু অপরাজেয় নন।
মরাঠি ভাষায় অজিঙ্ক শব্দের অর্থ অপরাজেয়। আইপিএলের মঞ্চে যদিও রাহানে নিজের নামের সার্থকতা প্রমাণ করতে পারছেন না। প্রথম আটটি ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতে হেরে গিয়েছে তাঁর দল কলকাতা নাইট রাইডার্স। গত বারের চ্যাম্পিয়ন দলের নেতৃত্বের ওজন কি বেশি মনে হচ্ছে রাহানের?
ঘরের মাঠে প্রথম ম্যাচের পর ইডেনের পিচকে দোষ দিয়েছিলেন রাহানে। পঞ্জাবের বিরুদ্ধে ১১২ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে ১৬ রানে হেরে সব দোষ নিয়েছেন নিজের ঘাড়ে। অধিনায়ক হিসাবে তিনি সেটা করতেই পারেন, কিন্তু আইপিএলে জয় ছাড়া অন্য কিছুকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। জিতলে থাকো, হারলে সরে যাও। বার বার সেই ঘটনা ঘটেছে। কেকেআর-ও দীনেশ কার্তিককে আইপিএলের মাঝে অধিনায়কের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল। রাহানে নিশ্চয়ই সেই চাপটা বুঝতে শুরু করে দিয়েছেন।
এ বারের নিলামের আগে শ্রেয়স আয়ারকে ছেড়ে দিয়েছিল কলকাতা। গত বার তাঁর নেতৃত্ব চ্যাম্পিয়ন হলেও এ বারের আইপিএলে আর তাঁকে রাখা হয়নি। নিলামের পর তাই আলোচনা শুরু হয়ে যায় কাকে অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হবে তা নিয়ে। নিলামে ২৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনেছিল বেঙ্কটেশ আয়ারকে। দলে ছিলেন সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলের মতো ক্রিকেটারও। তাঁদের বাদ দিয়ে শাহরুখ খানের দল অধিনায়ক করে রাহানেকে। ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। বিদেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ় জিতিয়েছিলেন দলকে। সেই রাহানের উপর ভরসা করেছে কেকেআর। সিদ্ধান্তটা কি সঠিক ছিল?

কলকাতা নাইট রাইডার্সের অনুশীলনে বেঙ্কটেশ আয়ার, রিঙ্কু সিংহদের সঙ্গে অজিঙ্ক রাহানে। ছবি: রয়টার্স।
১৭ বছর বয়স থেকে রাহানেকে দেখছেন তাঁর কোচ প্রবীণ আমরে। আনন্দবাজার ডট কম-কে বলছিলেন, তাঁর দেখা শান্ত রাহানের কথা। আমরের মতে রাহানের সবচেয়ে বড় গুণ, ও সকলের কথা ঠান্ডা মাথায় শোনে। কিন্তু অধিনায়ক রাহানে কেমন? আমরে বললেন, “অধিনায়ক রাহানের সেরা সময় ছিল ২০২০-২১ মরসুমে। বিরাট কোহলিকে ছাড়া অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি জিতিয়েছিল দেশকে।” কিন্তু সেটা তো টেস্ট, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের জন্য রাহানে কি যোগ্য অধিনায়ক? আমরে বললেন, “আইপিএলে তো রাহানে প্রথম বার নেতৃত্ব দিচ্ছে না। এর আগে রাজস্থান রয়্যালস এবং রাইজিং পুণে জায়ান্টকে নেতৃত্ব দিয়েছে। অভিজ্ঞতা রয়েছে ওর।”
রাহানেকে টেস্ট ক্রিকেটার হিসাবেই দেখা হয় ভারতে। দেশের হয়ে তিনি ৮৫টি টেস্ট খেলেছেন। সেখানে আন্তর্জাতিক মঞ্চে টি-টোয়েন্টি খেলেছেন মাত্র ২০টি। এমন এক জন ক্রিকেটারকে নিলামে কেন কিনল কেকেআর? অধিনায়ক করবে বলে? ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার হরভজন সিংহ বলেছিলেন, “কেকেআরে রাহানেকে তিন নম্বরে খেলতে হবে, কারণ ওপেনারদের জায়গা পাকা। কিন্তু রাহানেকে যদি শুধু অধিনায়ক করার জন্য দলে নেওয়া হয়, তা হলে আমার মনে হয় সেটা নারাইন, বেঙ্কটেশ বা রাসেলকে করলেও হত।”
শুধু অধিনায়ক করার জন্য হয়তো রাহানেকে দলে নেয়নি কেকেআর। শ্রেয়সকে ছেড়ে দেওয়ায় নাইটদের এক জন নির্ভরযোগ্য ব্যাটার দরকার ছিল। এই মরসুমে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে (ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা) সবচেয়ে বেশি রান ছিল ৩৬ বছরের রাহানের। ৯ ম্যাচে করেছিলেন ৪৬৯ রান। স্ট্রাইক রেট ১৬৪.৫৬। প্রতিযোগিতার সেরা ক্রিকেটারও হয়েছিলেন তিনি। তাই ব্যাটার হিসাবে রাহানেকে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে ভুল বলা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন:
রাহানের থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেকগুলো। চ্যাম্পিয়ন তকমা ধরে রাখার জন্য এ বারের আইপিএলে নেমেছে কেকেআর। তেমন একটি দলকে নেতৃত্ব দিতে নামা একজনের থেকে প্রত্যাশা থাকাই স্বাভাবিক। অধিনায়ক হিসাবে রাহানের রেকর্ডও খারাপ নয়। ভারতকে ছ’টি টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে চারটিতে জিতেছিল ভারত। বাকি দু’টি ড্র হয়েছিল। এক দিনের ক্রিকেটে তিনটি ম্যাচে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহানে। তিনটিতেই জিতেছিল ভারত। টি-টোয়েন্টিতেও দেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। দু’টি ম্যাচের মধ্যে একটিতে জিতেছিল ভারত, একটি হেরেছিল। কিন্তু আইপিএলের রেকর্ড রাহানের হয়ে কথা বলবে না। এ বারের আইপিএল শুরুর আগে ২৫টি ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রাহানে। তার মধ্যে মাত্র ন’টিতে জিতেছিল তাঁর দল।
এ বারের আইপিএলে অধিনায়ক রাহানের সবচেয়ে বড় অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে পরিকল্পনার। প্রতি ম্যাচে তিনি এক ভাবে বোলার পরিবর্তন করছেন। কোন মাঠে খেলা, কোন দলের বিরুদ্ধে খেলা, তা দেখেন না রাহানে। তিনি যা ঠিক করে এসেছেন তা-ই করবেন। সোমবার ইডেনে আন্দ্রে রাসেল উইকেট নেওয়ার পর তাঁকে আর বলই করালেন না রাহানে। তিনি পিচের দোষ দেখেন, কিন্তু নিজের পরিকল্পনার দোষ খুঁজে পান না।
রাহানের জন্ম মহারাষ্ট্রে। শহরতলি থেকে উঠে এসে জায়গা করে নিয়েছেন মুম্বইয়ের মতো শহরে। কোচ আমরে বললেন, “রাহানেকে ছাত্র হিসাবে পাওয়া যে কোনও কোচের কাছে খুবই সৌভাগ্যের। মাঠে এবং মাঠের বাইরে ও খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ। যা বলা হবে, তা-ই করবে। কখনও ফাঁকি দেবে না। নিজের উইকেটের গুরুত্ব জানে। লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করেছে। কষ্ট করে নিজের জায়গা তৈরি করেছে। সেই কারণেই সেই জায়গাটার গুরুত্ব দিতে জানে।”
একটা দলকে নেতৃত্ব দেওয়া সব গুণ রাহানের মধ্যে রয়েছে বলেই মনে করেন তাঁর কোচ। আমরে বললেন, “১৭ বছর বয়সে রাহানেকে প্রথম দেখেছিলাম। ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে। দেশের হয়ে খেলেছে। ওর সেরা সময় ছিল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ় জয়। নিজে রান করেছে, দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। শুধু দেশের হয়ে সিরিজ় জয় নয়, মুম্বইকেও রঞ্জি জিতিয়েছে রাহানে।” কিন্তু এ বারের আইপিএলে অভাব দেখা যাচ্ছে রাহানের পরিকল্পনার। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ম্যাচের মাঝে পরিস্থিতি বুঝে পরিকল্পনার পরিবর্তন করতে হয়। রাহানেকে সেটা করতে দেখা যাচ্ছে না। সেই কারণেই কি রঞ্জি ট্রফিতে রাহানে অধিনায়ক করলেও মুস্তাক আলি ট্রফিতে তাঁকে দায়িত্ব দেয়নি মুম্বই? সেখানে অধিনায়ক ছিলেন শ্রেয়স আয়ার। যাঁকে এ বারের নিলামের আগে ছেড়ে দিয়েছিল কলকাতা।

অজিঙ্ক রাহানেকে ব্যাটিংয়ের পরামর্শ দিচ্ছেন কোচ প্রবীণ আমরে। —ফাইল চিত্র।
দেশ, রাজ্যের থেকে আইপিএলে নেতৃত্ব দেওয়া অনেকটা আলাদা। সেখানে প্রতি ম্যাচে থাকতে হয় অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নীচে। যে কোনও সময় অধিনায়ককে সরিয়ে দেওয়া যায়। যে কারণে রাহানেকে স্বার্থপর হতেও বলেছেন মহম্মদ কইফ। পঞ্জাব কিংসের বিরুদ্ধে আউট না হয়েও মাঠ ছেড়েছিলেন রাহানে। সন্দেহ থাকলেও রিভিউ নেননি। ভেবেছিলেন নষ্ট করবেন না। যে ঘটনার পর ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার কইফ বলেছিলেন, “রাহানের এ বার দলের জন্য স্বার্থপর হওয়া উচিত। ওর বোঝা উচিত, ও দলের অন্যতম সেরা ব্যাটার। মনে একটুও সন্দেহ থাকলে রিভিউ নেওয়া উচিত রাহানের।”
২০২১ সালে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি জিতে রাহানে দেশে ফিরেছিলেন রাজার মতো। রাস্তায় ফুল ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। চারদিকে ব্যান্ডপার্টি বাজছিল। কিন্তু রাহানের আইপিএলের মঞ্চ এত সুখের নয়। আমরে বললেন, “রাজ্য, দেশ এবং আইপিএল আলাদা জগৎ। আইপিএলে এখন কলকাতাকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, আগে রাজস্থান, পুণেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তবে রাহানে জানে এই পরিস্থিতি সামলাতে।”
এ বারের আইপিএলে কেকেআরের আর ছ’টি ম্যাচ বাকি। অপরাজেয় হতে হবে রাহানেকে। জিততে না পারলে প্রশ্ন উঠে যাবে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে।
- ১৮ বছরের খরা কাটিয়ে ট্রফি জিতেছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু। প্রথম বার আইপিএল জেতার স্বাদ পেয়েছেন বিরাট কোহলি। ফাইনালে পঞ্জাব কিংসকে ছ’রানে হারিয়েছে বেঙ্গালুরু।
- ট্রফি জেতার পরের দিনই বেঙ্গালুরুতে ফেরেন বিরাট কোহলিরা। প্রিয় দলকে দেখার জন্য প্রচুর সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের বাইরে। সেখানে হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১১ জনের। আহত ৫০-এরও বেশি। ঘটনাকে ঘিরে দায় ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে।
-
১১ মৃত্যুর জের, আইপিএল জয়ের উৎসবে কী কী করা যাবে না, শনিবার ঠিক করবে বোর্ড, আর কী কী নিয়ে আলোচনা?
-
‘লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড় হবে’! বেঙ্গালুরুতে কোহলিদের উৎসবের আগে সতর্ক করেছিল পুলিশই, তবু কেন এড়ানো গেল না দুর্ঘটনা
-
আইপিএলের শেষ পর্বে ছিলেন না, ভারত-পাক সংঘাত, না কি ‘বিশেষ’ কারণে খেলতে আসেননি স্টার্ক?
-
‘ভিড়ের চাপে স্ত্রীয়ের হাত ছুটে যায়’, পদপিষ্টে প্রিয়জন হারিয়ে কথা বলার ভাষা নেই পরিবারের
-
অফিসে খোলা পড়ে ল্যাপটপ, আরসিবি-র অনুষ্ঠান দেখেই ফিরবেন বলেছিলেন, ফিরে এল তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী কামাক্ষীর দেহ