নেপথ্যে মেলবোর্ন ক্রিকেট স্টেডিয়াম। যেখানে হবে রোহিত শর্মা (বাঁ দিকে) এবং প্যাট কামিন্সের দলের দ্বৈরথ। —ফাইল চিত্র।
আরও একটি ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট। বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) থেকে মেলবোর্নে শুরু হবে সেই ম্যাচ। ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া মুখোমুখি হবে ভারতের। বর্ডার-গাওস্কর সিরিজ়ের চতুর্থ টেস্ট এটি। সিরিজ় এখন ১-১। আশা করা হচ্ছে, ৯০ হাজারের মেলবোর্নে বৃহস্পতিবার একটিও আসন খালি থাকবে না। ইতিমধ্যেই ৮৬ হাজার টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেন ক্রিসমাসের পরের দিনে শুরু হওয়া টেস্টকে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট বলে?
বড়দিনের পরের দিন এই টেস্টের এই রকম নামকরণ হওয়ার পিছনে দু’টি তত্ত্ব আছে। অনেকে মনে করেন, বড়দিন, অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর যে সব উপহার পাওয়া যায়, সেগুলি আর সেই দিন দেখার সময় পাওয়া যায় না। তাই উপহারের বাক্স (বক্স) খোলা হয় পরের দিন, অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর। বক্স খোলা হয় বলে এর নাম হয়েছে ‘বক্সিং ডে’।
দ্বিতীয় একটি তত্ত্ব হল, ২৫ ডিসেম্বর অনেকে খেটে কাজ করেন, বিশেষ করে পরিচারকেরা। সেই কাজের জন্য তাঁদের পরের দিন ২৬ ডিসেম্বর পুরস্কারের বাক্স দেওয়া হয়। সেই কারণে এর নাম ‘বক্সিং ডে’।
অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউ জ়িল্যান্ডের মতো দেশগুলিতে ২৬ ডিসেম্বর দিনটি ‘বক্সিং ডে’ নামে পরিচিত। ক্রিকেটে ‘বক্সিং ডে’-র জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। ‘বক্সিং ডে’-র প্রথম হদিস পাওয়া যায় ১৮৬৫ সালে। তবে তখন এই নামকরণ হয়নি। শেফিল্ড শিল্ডে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (এমসিজি) ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের মধ্যে ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচ যদিও ‘বক্সিং ডে’, অর্থাৎ ২৬ ডিসেম্বর শুরু হওয়ার কথা ছিল না। ম্যাচের মাঝে একটি দিন পড়েছিল ২৬ ডিসেম্বর। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে বড়দিনের ছুটি কাটাতে পারবেন না বলে নিউ সাউথ ওয়েলসের ক্রিকেটারেরা মনখারাপ করে বসে থাকেন। তাঁদের দাবি মেনে সেই ম্যাচ বড়দিনের পরের দিন শুরু হয়েছিল। সেই ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছিল তিন দিনে। ভিক্টোরিয়া ইনিংস ও ২০ রানে জিতে যায়।
প্রথম ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয় মেলবোর্নে ১৯৫০-৫১ সালের অ্যাশেজে। সেই ম্যাচও ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয়নি। ম্যাচ হয়েছিল ২২ থেকে ২৭ ডিসেম্বর (তৃতীয় দিনের পর একটি দিন বিশ্রামের জন্য দেওয়া হত বলে তখন টেস্ট ম্যাচ ছ’ দিন ধরে হত)। চতুর্থ দিনের খেলাকে ‘বক্সিং ডে’ বলা হয়েছিল। কিন্তু তখনও এর নাম ‘বক্সিং ডে টেস্ট’ হয়নি।
১৯৬৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট খেলেছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ফের ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয়নি। কখনও ২৬ ডিসেম্বর ম্যাচ শুরু করা যায়নি, কখনও তার আগেই ম্যাচ শেষ হয়ে গিয়েছিল, কখনও সেই ম্যাচ হয়েছিল অ্যাডিলেড ওভালে।
এর পর ১৯৭৪-৭৫ অ্যাশেজ সিরিজে ছ’টি টেস্ট ছিল। সব ক’টি ম্যাচ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাতে শেষ করা যায়, সেই কারণে মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্ট দেওয়া হয়েছিল ২৬ ডিসেম্বর থেকে। আধুনিক ‘বক্সিং ডে’ টেস্টের সেটিই শুরু। তবে ১৯৮০ সালে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট নিয়ে মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট বোর্ডের চুক্তি হয়। তার পর থেকে প্রতি বছর নিয়ম করে এমসিজি-তে ২৬ ডিসেম্বর থেকে টেস্ট শুরু হয়।
ধারাবাহিকতায় এক বারই ছেদ পড়ে। ১৯৮৯ সালে ‘বক্সিং ডে’-তে টেস্ট ম্যাচের বদলে অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কার মধ্যে একটি এক দিনের ম্যাচ খেলা হয়।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া জানায়, পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘বক্সিং ডে’ টেস্টের সেরাকে তাদের দেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার জনি মুল্লাঘের নামে মুল্লাঘ পদক দেওয়া হবে।
অনেক স্মরণীয় ঘটনার সাক্ষী ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট। ১৯৮৫ সালের অ্যাশেজে ‘বক্সিং ডে’ টেস্টেই অভিষেক হয়েছিল স্টিভ ওয়ের। ১৯৮৮ সালে ম্যালকম মার্শাল ৩০০ টেস্ট উইকেট নিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালে শেন ওয়ার্ন অ্যাশেজে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। ১৯৯৫ সালে এই টেস্টেই অস্ট্রেলিয়ার আম্পায়ার ড্যারেল হেয়ার শ্রীলঙ্কার স্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরনকে বল ছোড়ার অভিযোগে বার বার ‘নো বল’ ডাকেন। সেই নিয়ে তোলপাড় হয় ক্রিকেটবিশ্ব। ২০০৬ সালে ‘বক্সিং ডে’ টেস্টেই শেন ওয়ার্ন ৭০০ টেস্ট উইকেট নেন। এখন অস্ট্রেলিয়ার খেলাধুলোয় ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট অন্যতম জনপ্রিয়।
অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয় আর এক কমনওয়েলথ দেশ নিউ জ়িল্যান্ডে। ১৯৯৮ সাল থেকে শুরু করে ২০০৩ সাল পর্যন্ত নিয়ম করে সে দেশে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয়েছে। তার পর থেকে আর নিয়মিত টেস্ট হয়নি। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সাদা বলের ক্রিকেটকে।
এই বছর ভারত-অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট খেলবে দক্ষিণ আফ্রিকা-পাকিস্তান। সেঞ্চুরিয়ানে হবে সেই ম্যাচ। দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয় ১৯১৩ সালে। জোহানেসবার্গে ইংল্যান্ডের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা হারে ইনিংস ও ১২ রানে। তার পর সে দেশে ৭৯ বছর আর ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয়নি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘বক্সিং ডে টেস্ট’ ম্যাচ হয় নিয়ম করে। ১৯৯২ সালে প্রথম ম্যাচটি হয়েছিল পোর্ট এলিজাবেথে। ১৯৯৪ সালে তা ডারবানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড মনে করেছিল, যে হেতু বড়দিনে ডারবানেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ছুটি কাটাতে আসেন, তাই সেখানেই ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট করা হবে। ১৯৯৫ সালে আবার তা পোর্ট এলিজাবেথের সুপার স্পোর্ট পার্কে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৯৬ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ডারবানেই নিয়মিত ভাবে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয়। তবে ১৯৯৩, ১৯৯৭, ২০০১, ২০০৫, ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হয়নি। কারণ এই পাঁচ বছর দক্ষিণ আফ্রিকা ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট খেলেছিল অস্ট্রেলিয়ায়।
পরের দিকে ডারবানে খারাপ আলো, বৃষ্টির জন্য বার বার ‘বক্সিং ডে’ টেস্টে বিঘ্ন ঘটেছে। সেই কারণে ২০১৪ সাল থেকে আবার তা পোর্ট এলিজাবেথে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট হচ্ছে সেঞ্চুরিয়নের সুপার স্পোর্ট পার্কে। ২০২১ সালে বিরাট কোহলিরাও সেখানে ‘বক্সিং ডে’ টেস্ট খেলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy