Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Success of New Zealand Cricket

ধোনি-কোহলিদের মতো পুজোও হয় না, পোড়ে না কুশপুতুলও! ‘তারকা’ না থাকাই কিউয়িদের জোড়া সাফল্যের কারণ

বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটারেরাও। সেই স্বপ্নকে লালন করে বড় হন। ভারতের মতো প্রতিভার প্রাচুর্য, আর্থিক সামর্থ্য, জনপ্রিয়তা নেই। তাঁদের আছে পরিকল্পনা, আন্তরিকতা, সাধনা।

picture of cricket

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:২৮
Share: Save:

সচিন তেন্ডুলকর, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বিরাট কোহলিদের মতো তারকা নেই তাদের। ফলে নেই বীরপুজোও। আবার বড় প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হলে এ দেশে নিজেদের বাড়ির সামনে সচিন, সৌরভ, ধোনিদের কুশপুতুল পুড়েছে, ক্রিকেট-জনতা বিক্ষোভ দেখিয়েছে। নিউ জ়িল্যান্ডে এ সব হয় না। কেন উইলিয়ামসন বা টিম সাউদির বাড়ি কোথায়, তা-ও হয়তো জানেন না সে দেশের মানুষ। উচ্ছ্বাসের মতো হতাশাতেও তাঁরা সংযত। তারকাহীন বলেই নিউ জ়িল্যান্ডের দু’টি দল একই দিনে দু’টি প্রায় অসাধ্যসাধন করে ফেলেছে।

‘ব্ল্যাক ক্যাপস’ আর ‘হোয়াইট ফার্ন’। একই দিনে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোচনায় উঠে এসেছে দু’টি নাম। যে আলোচনার ভরকেন্দ্র নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেট। রবিবার ৩৬ বছর পর ভারতের মাটিতে টেস্ট জিতেছে নিউ জ়িল্যান্ড। তার ১১ ঘণ্টা পর প্রথম বার সাদা বলের ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছে কিউয়িরা। হোক না মহিলাদের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। বিশ্বকাপ তো বিশ্বকাপই।

ক্রিকেট বিশ্বে তথাকথিত কুলীন হিসাবে কোনও দিনই তেমন দর পায় না কিউয়িরা। আবার হেলাফেলাও করা যায় না। ১৯৯১-৯২ সালের বিশ্বকাপ যাঁদের মনে রয়েছে তাঁরা জানেন, মার্টিন ক্রোর দল বাকিদের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৩০ সালে প্রথম টেস্ট খেলে নিউ জ়িল্যান্ড। ভারতেরও দু’বছর আগে। তবু এখনও ক্রিকেট নিউ জ়িল্যান্ডের জনপ্রিয়তম খেলা নয়। সেই জায়গা দখল করে রেখেছে রাগবি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ফুটবল। পরের স্তরে থাকা বাস্কেটবল, নেটবল, ঘোড়দৌড়ের মতো খেলাগুলির মতো জনপ্রিয় ২২ গজের লড়াই। নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটকর্তারা খেলাটা নিয়ে বাণিজ্য করার কথা ভাবেননি। এখনও তেমন বিপণন করা হয় না। ইংরেজদের হাত ধরে আসা খেলাটা তাঁদের কাছে এখনও নিছক একটা খেলা। বিনোদনের মাধ্যম। সেই বিনোদনে আছে নিখাদ ক্রিকেট। বাড়তি রং যোগ করার উগ্র তাগিদ নেই।

সত্যিই কি তাগিদ নেই? আছে। উন্নতির তাগিদ আছে। আধুনিক যুগের নানা হাতছানির মধ্যেও ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ রয়েছে। প্রতিভার প্রাচুর্য না থাকলেও আন্তরিকতার অভাব নেই। এ দেশের বাবা-মায়েদের মতো দলে দলে সন্তানদের নিয়ে ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ছোটেন না নিউ জ়িল্যান্ডের অভিভাবকেরা। অস্ট্রেলিয়ার মতো নয়। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের মতোও নয়। তাই নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটে প্রতিভার জোগানও সীমিত। পরিকাঠামো কিন্তু যথেষ্ট আধুনিক। অনেক ক্রিকেট জনপ্রিয় দেশের থেকে বেশি আধুনিক। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটের এগিয়ে চলার এটাই চাবিকাঠি।

বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতও তাই। তিনি বলেছেন, ‘‘নিউ জ়িল্যান্ডে ক্রিকেট নিয়ে বিরাট উন্মাদনা নেই। ভারতের ১০ শতাংশও নেই। ওরা মনের আনন্দে খেলে। বাড়ি চলে যায়। সাফল্য পেলে যেমন প্রচুর হইচই হয় না, তেমন ব্যর্থ হলে সমালোচনাও হয় না। তাই চাপমুক্ত থাকতে পারে। বেঙ্গালুরু টেস্টে নিউ জ়িল্যান্ডের জয় অবশ্যই কৃতিত্বের। ওরা ভাল খেলেছে। তবে ভারত আত্মহত্যা করেছে। স্কুল ক্রিকেটেও ওই উইকেটে কেউ টস জিতে ব্যাট করবে না। একটা কথা মনে রাখতে হবে, লাল বলের ক্রিকেটে ওরা কিন্তু সেরা ট্রফিটা আগেই পেয়েছে। ভারতকে হারিয়েই টেস্ট বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সাদা বলের ক্রিকেটে ওদের বিশ্বকাপ জেতা হয়নি। সেই আক্ষেপ কিছুটা মিটিয়েছে মেয়েদের দল। এ বার দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। নিউ জ়িল্যান্ডে ক্রিকেট ঠিক পথে এগোচ্ছে। আরও উন্নতি করবে আগামী দিনে।’’ নিউ জ়িল্যান্ডের টেস্ট জয়কে খুব গুরুত্ব দিতে নারাজ ঝুলন গোস্বামীও। ভারতীয় মহিলা দলের প্রাক্তন অধিনায়কের বক্তব্য, ‘‘বেঙ্গালুরুর টেস্টে আবহাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমে ব্যাট করলে নিউ জ়িল্যান্ড হয়তো ইনিংসে হারত। একটা ইনিংস দিয়ে রোহিতদের বিচার করা ঠিক হবে না। এ ভাবে বিচার করা যায় না। ওরা গত বছর এক দিনের বিশ্বকাপ থেকে ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলছে। একটা ইনিংস এমন হতেই পারে।’’ নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটে তারকা নেই বলেও মানতে নারাজ ঝুলন। তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘উইলিয়ামসন কি তারকা নয়? সব ধরনের ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটার। নিজে কেউ তারকা হয় না। মানুষ তারকা তৈরি করে। নিউ জ়িল্যান্ডে ও যথেষ্ট জনপ্রিয়।’’

Picture of Kane Williamson

কেন উইলিয়ামসন। — ফাইল চিত্র।

নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেট এগোচ্ছে। কাউকে অনুকরণ বা অনুসরণ করে নয়। নিজস্ব ছন্দ তৈরি করে নিয়েছে তারা। বিশ্ব পর্যায়ে ক্রিকেটে ঝুড়ি ঝুড়ি সাফল্য নেই নিউ জ়িল্যান্ডের। পুরুষদের ক্রিকেটে নেই। মহিলাদের ক্রিকেটেও নেই। পুরুষদের এক দিনের বিশ্বকাপে দু’বার ফাইনালে উঠলেও ট্রফি জেতা হয়নি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও এক বার ফাইনালে উঠে হার। এক বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছে। এক বার টেস্ট বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই ভারতকে হারিয়ে। মহিলাদের ক্রিকেটে এক বার করে এক দিনের এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছে।

অন্য দেশের ক্রিকেটারদের মতোই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন নিউ জ়িল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা। সেই স্বপ্নকে লালন করে বড় হন। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ের পর রোহিত শর্মা ব্রিজটাউনের মাটি খেয়েছিলেন। উচ্ছ্বাসে ভেসে গিয়েছিলেন বিরাট কোহলি, হার্দিক পাণ্ড্যরা। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি কোচ রাহুল দ্রাবিড়ও। বিশ্বজয়ের পর নিউ জ়িল্যান্ডের মহিলা ক্রিকেটার অ্যামিলিয়া কের গিটার বাজিয়ে গান গেয়েছেন। সঙ্গ দিয়েছেন বাকিরা। রবিবার তাঁদের গলা ছেড়ে গান গাওয়ারই দিন ছিল। টানা ১০টা ম্যাচ হেরে বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল সোফি ডিভাইনের দল। তাঁদের নিয়ে কোনও আশা ছিল না দেশবাসীর। অথচ তাঁরাই ভারত, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন! দায়িত্ব নিয়েছিলেন দলের তিন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ডিভাইন, সুজি বেটস এবং লিয়া তাহুহু। তিন জনেই সম্ভবত নিজেদের শেষ বিশ্বকাপ খেলে ফেললেন। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ফাইনাল শুরুর আগে বেটস সতীর্থদের বলেছিলেন, ‘‘আমরা তিন জন এই দলের ঠাকুমা। তোমরা কি আমাদের শেষটা সুন্দর করে তুলতে পারবে না?’’ তিন ঠাকুমার হাতে সেরা উপহার তুলে দিয়েছেন বাকিরা। যা নিয়ে কের বলেছেন, ‘‘ডিভাইন, বেটসের মতো ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিশ্বজয়ী দলের সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। সেই স্বপ্নটা সত্যি হল।’’ রোহিতদের মতোই কেরদের যাপনের সঙ্গেও মিশে রয়েছে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। প্রত্যাশার চাপ না থাকায় বাড়তি কিছুটা সুবিধা তাঁরা হয়তো পান। তাতে বিশ্বজয়ের কৃতিত্ব এতটুকু কমে না। নিউ জ়িল্যান্ডের মহিলা দলের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে ঝুলনের বিশ্লেষণ, ‘‘টানা বেশ কিছু ম্যাচ হেরে ওরা বিশ্বকাপ খেলতে এসেছিল। দল হিসাবে পারফর্ম করেছে। ব্যক্তিগত সাফল্যের উপর নির্ভর করেনি। গোটা প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলেছে। ভারতকে হারিয়ে ছন্দটা পেয়ে যায়। সিনিয়রেরা প্রত্যেকে বাড়তি দায়িত্ব নিয়েছে। যোগ্য দল হিসাবেই নিউ জ়িল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।’’

Picture of New Zealand's women cricket team

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী নিউ জ়িল্যান্ডের মহিলা দল। ছবি: আইসিসি।

একই ভাবে রোহিতদের ভুল সিদ্ধান্তের জন্য টম লাথামের দলের টেস্ট জয়ের কৃতিত্বও কমে না। এই নিয়ে ভারতের মাটিতে তৃতীয় বার টেস্ট জিতল নিউ জ়িল্যান্ড। শেষ বার ১৯৮৮ সালে জন রাইটের দল জিতেছিল। গত ৩৬ বছরে কিউয়ি ক্রিকেটের তিন-চার প্রজন্ম অবসর নিয়ে ফেলেছে। স্বপ্ন দেখার দায়িত্ব বদল হয়েছে। স্বপ্ন দেখা বন্ধ হয়নি। ভারতে আসার আগে শ্রীলঙ্কার কাছে ০-২ ব্যবধানে সিরিজ় হেরেছিলেন লাথামেরা। তার উপর ভারতের দলে উইলিয়ামসনও নেই। বাংলার কোচ লক্ষীরতন শুক্ল বলেছেন পরিকল্পনার কথা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বেঙ্গালুরু টেস্টে ভারত অনেক ভুল করেছে। শুধু টস জিতে ব্যাটিং নেওয়া নয়। দল নির্বাচন, বোলিং— সব কিছুই আরও ভাল হতে পারত। নিউ জ়িল্যান্ড কিন্তু পরিকল্পনামাফিক ক্রিকেট খেলেছে। রাচিন রবীন্দ্র এমনি শতরান করেনি। এক মাস আগে চেন্নাইয়ে চলে এসেছিল। এখানে ব্যাটিং অনুশীলন করেছে। অন্য ব্যাটারেরাও ভাল করেছে। ওদের বোলিংয়েও পরিকল্পনার ছাপ স্পষ্ট ছিল। বড় মঞ্চে সাফল্য পেতে হলে পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। মহিলাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ওখানেও নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে হারের মাসুল দিতে হয়েছে ভারতকে। আমাদের মেয়েদের দল কিন্তু যথেষ্ট শক্তিশালী। নিউ জ়িল্যান্ড নিশ্চয়ই বিশ্বকাপ জয় উদ্‌যাপন করবে। ওরা কিন্তু আগেও বড় প্রতিযোগিতায় ভাল পারফরম্যান্স করেছে। এখন সাফল্যও পাচ্ছে। পরিকল্পনা ছাড়া হয় না।’’

ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মতো সামর্থ্য নেই নিউ জ়িল্যান্ড ক্রিকেট-এর। হাজার হাজার ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নেই। এত শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেট নেই। আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতা নেই। বেন স্টোকসের মতো অলরাউন্ডার নিজের দেশ নিউ জ়িল্যান্ডকে ছেড়ে বেছে নেন ইংল্যান্ডকে। কিউয়িদের ক্রিকেটে একটা ‘কিউটনেস’ আছে। লাল ডিউজ় আর উইলোর টুকরোর সখ্য আছে। ক্রিকেট-সভ্যতার প্রতি যত্ন আছে। নিবিড় সাধনা আর তার উপর ভিত্তি করে সৌধ গড়ার স্বপ্ন আছে। স্বপ্নপূরণের চাপ নেই, সাধ আছে। আর কঠোর শৃঙ্খলা রয়েছে। যে শৃঙ্খলার বাঁধনে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই স্টোকসের মতো ক্রিকেটারেরও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy