Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Mansoor Ali Khan Pataudi

দরিদ্র পরিবারের পিতা: টাইগার পটৌডির জন্মদিনে লিখলেন কবি জয় গোস্বামী

পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ৪৩ বছর ধরে একটি বিশ্বরেকর্ড তাঁর দখলে ছিল। ২১ বছর ৭৭ দিন বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর চলাকালীন তিনি অধিনায়ক হন।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

জয় গোস্বামী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০২৩ ০৮:১২
Share: Save:

সেই ক্রিকেটারের জন্মদিন আজকে, ৫ জানুয়ারি। যিনি ৪৬টি টেস্ট খেলে একটি ডাবল সেঞ্চুরি-সহ ৬টি টেস্ট শতরান, ১৬টি অর্ধশতক ভরে নিয়েছিলেন নিজের ঝুলিতে—একটিমাত্র চোখ সম্বল করে। ৪৬ টেস্টে ২৭৯৩ রান আজকের দিনে একেবারেই কোনও গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ড নয়। কিন্তু আমরা যদি মনে রাখি একটিমাত্র চোখের ওপর নির্ভর করে এই রানগুলি করা হয়েছিল, তা হলে দেখব সারা বিশ্বের টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আর একটিও নেই। এক জন ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে চোখ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, খেলোয়াড় মাত্রেরই জানা।

সকলেই বুঝতে পারছেন এই ক্রিকেটারের নাম মনসুর আলি খান পটৌডি। টাইগার পটৌডি নামে অভিহিত করা হত তাঁকে। প্রথম টেস্ট খেলবার আগেই তিনি একটি চোখ হারান দুর্ঘটনায়। তার পর জীবনের প্রথম টেস্ট সিরিজ় খেলতে নেমে তৃতীয় টেস্টেই নিজের প্রথম শতরানটি করেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম বার খেলতে নেমে ১২৮ নটআউট থেকে যান। পটৌডি ভারতকে ৪০টি টেস্টে নেতৃত্ব দেন। তাঁর অধিনায়কত্বেই ভারত প্রথম বিদেশ থেকে সিরিজ় জয় করে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩-১ ফলাফলে। কিন্তু পটৌডি যে বিদেশ থেকে সিরিজ় জয় করে আনা প্রথম ভারত অধিনায়ক, এ কথা মানুষ প্রায় ভুলেই গিয়েছে। ২০১১ সালে ২২ সেপ্টেম্বর তাঁর প্রয়াণের পর কোনও মিডিয়ায় এই তথ্য উল্লেখিত হয়নি। যে ৪০টি টেস্টে ক্যাপ্টেন ছিলেন পটৌডি, তার মধ্যে ৯টিতে জিতেছিল ভারত। নিশ্চয়ই এও কিছু আহামরি পরিসংখ্যান নয়। তবে আমরা যদি মনে রাখি যে, পটৌডি অধিনায়ক হওয়ার আগে ৭৯টি টেস্টে ভারতের জয়ের সংখ্যা ছিল ৮, তা হলে অধিনায়ক পটৌডিকে একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। পটৌডি আবিষ্কার করেছিলেন ভারতের স্পিন চতুষ্টয়কে। অর্থাৎ চন্দ্রশেখর, প্রসন্ন, বেদী ও বেঙ্কট উঠে এসেছিলেন তাঁরই প্রয়োগ কৌশলে।

পৃথিবীর সবচেয়ে কম বয়সি টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে ৪৩ বছর ধরে একটি বিশ্বরেকর্ড তাঁর দখলে ছিল। ২১ বছর ৭৭ দিন বয়সে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর চলাকালীন তিনি অধিনায়ক হন। তাঁর শেষ অধিনায়কত্বও ’৭৪-’৭৫ সিরিজ়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধেই। টাইগার বলে তাঁকে কেন ডাকা হত তার দু-একটি দৃষ্টান্ত রাখি। ’৬৭-র ইংল্যান্ড সফর। লিড্‌স-এ প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ড ৪ উইকেটে ৫৫০ রান ডিক্লেয়ার করেছে। ওপেনার বয়কট অপরাজিত ২৪৬। বিকেলের দিকে ভারত ব্যাট করতে নেমে দিন শেষ করল ৬ উইকেটে ৮৬ রানে। উইকেটে আছেন সুব্রত গুহ ৪ এবং অধিনায়ক পটৌডি ১৪। রিলেতে শুনেছিলাম ৬ উইকেট ৭৯ রানে পড়ে যাওয়ার পর কী ভাবে গুহকে সামলে রাখছেন পটৌডি। সকালে প্রথম ওভারেই গুহ ফিরে গিয়ে ৮৬-৭-এ নামিয়ে আনলেন ভারতকে। পটৌডির সঙ্গী হলেন প্রসন্ন। ভারতের রান ১০০ পেরোবে কি? দশম উইকেট পড়ল যখন, আউট হলেন পটৌডি। ভারত ১৬৪। পটৌডি করেছেন ৬৪ রান। ২৮৪ মিনিট ক্রিজ়ে কাটিয়েছেন। ছটি ৪, একটি ৬। ৩৮৬ রানে পিছিয়ে থেকে ফলো-অন করল ভারত। ইনিংস পরাজয় শুধু সময়ের ব্যাপার। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার ৮৭, ওয়াড়েকর ৯১ হনুমন্ত সিংহ ৭৩ করে ব্যাপারটা পিছিয়ে দিলেন। আর আটকালেন পটৌডি। চতুর্থ দিনের শেষে তিনি অপরাজিত ১২৯। ভারত ৮-৪৭৫। পরের দিন আবার, প্রথম ইনিংসের মতোই শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হলেন পটৌডি ১৪৮ রানে। ভারত ৫১০। এই প্রথম ইংল্যান্ডের মাঠে ভারত ৫০০ পেরোল। যদিও ৬ উইকেটে পরাজয় ভারতের। কিন্তু ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র হেডিং দিল ‘ইন্ডিয়া: ভিকট্রি ইন ডিফিট’। আনন্দবাজারে খেলার পাতায় উঠে এল সেই শিরোনাম। ১৯৬৮ সালে উইজ়ডেন পটৌডিকে নির্বাচিত করল সে বছরের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে।

এল ’৬৭-’৬৮-র অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জ়িল্যান্ড সফর। প্রথম টেস্টের আগেই ফিল্ডিং করতে গিয়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট পেলেন পটৌডি। প্রথম টেস্টে অনুপস্থিত। দ্বিতীয় টেস্টের শুরুতেই ভারত ৫ উইকেটে ২৫। গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জি সেই ইনিংসে ৬৬ রানে ৭ উইকেট তুলবেন। একটু দেরিতে নেমে পটৌডি দাঁড়িয়ে রইলেন সারা দিন। প্রথমে সঙ্গী রুসি সুরতি (২২), পরে সেই প্রসন্ন (১৪)। দিনের শেষে ভারত ৯ উইকেটে ১৬৬। পটৌডি এখনও ক্রিজ়ে, ৭০ রানে। দ্বিতীয় দিন ৭৫ রানে পটৌডি আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইনিংস শেষ হল ভারতের। প্রথম টেস্টে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয়টিতেও জিতল। পটৌডি দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৫। তৃতীয় টেস্টে পটৌডি ৭৪ ও ৪৮। আত্মসম্মানে আঘাত লাগবে ভেবে পটৌডি রানার নেননি। এই সিরিজ়ে তিনটি টেস্টে তাঁর মোট রান ছিল ৩৩৯। লিন্ডসে হ্যাসেট রেডিয়োতে বলেছিলেন— ৭৫, ৮৫, ৭৪ করার পথে পটৌডি পায়ের আঘাতের জন্য এতগুলি সিঙ্গল ছেড়ে দিয়েছিলেন যে, তা থেকে অনায়াসে তিনি অন্তত দুটো সেঞ্চুরি পেতে পারতেন। এরপর নিউ জ়িল্যান্ড সফর এবং বিদেশে প্রথম রাবার জয়। প্রসন্ন দুটি সফরে যথাক্রমে ২৪টি ও ২৫টি উইকেট পেলেন। প্রসন্ন, তাঁর ‘ওয়ান মোর ওভার’ বইয়ে জানিয়েছেন, টাইগারই তাঁকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। প্রথম সিরিজ় জয়, বিদেশে। অথচ তা নিয়ে কোথাও তেমন আলোড়ন উঠল না ভারতে।

’৭৪-’৭৫ এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে পটৌডি ১৫ গজ দূর থেকে বল করিয়ে প্র্যাক্টিস করছিলেন। চতুর্থ বলে বোল্ড হওয়ার পরে রাজ সিংহ দুঙ্গারপুরকে ফোনে জানান, ‘‘আমাকে টিমে রেখো না, আমি আর বল দেখতে পাচ্ছি না।’’ দুঙ্গারপুর বলেন, ‘‘তোমাকে ব্যাটসম্যান হিসেবে টিমে নেওয়া হচ্ছে না, নেওয়া হচ্ছে ক্যাপ্টেন্সির জন্য।’’ প্রবল প্রতাপান্বিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২-০ এগিয়ে গেলেও পটৌডির অধিনায়কত্বে ভারত পাল্টা আঘাতে ২-২ করে। শেষ টেস্ট অবশ্য বাঁচানো যায়নি। ইডেনে ফাস্ট বোলারের বলে আহত পটৌডি প্রথমে অবসৃত হন। ফিরে এসে ফাস্ট বোলারকেই পিটিয়ে তিনটি চার ও একটি ছয়ের সাহায্যে ১৯ রান তোলেন এক ওভারে। অস্তগামী পটৌডির সেই বিদ্যুৎগতির ৩৬ ইডেন ভোলেনি। সেইটি ইডেনে তাঁর শেষ টেস্ট ইনিংস। যেমন ইডেন ভোলেনি নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর অবিস্মরণীয় ১৫৩ রান। পটৌডি তখন মধ্যাহ্নের সূর্য। ইডেন ভোলেনি ’৬৪ সালে কভারে এবং ’৬৭ সালে মিড অফ-এ যথাক্রমে কাউড্রে এবং কানহাইয়ের উড়ন্ত শটে দৌড়ে গিয়ে অবিশ্বাস্য ক্যাচ নেওয়া। ইংল্যান্ড অধিনায়ক টেড ডেক্সটার তাঁকে তৎকালীন ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠ ফিল্ডার হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

টাইগার পটৌডি ছিলেন এমন এক জন ক্যাপ্টেন যাঁকে বলা হয় দরিদ্র পরিবারের পিতা। তাঁর হাতে কোনও ফাস্ট বোলার ছিল না। ঘাসের ওপর ঘষে নতুন বলের পালিশ তুলে চন্দ্রশেখরকে বোলিং-এ আনতেন তিনি। যেটুকু সম্বল ছিল তাই দিয়েই পটৌডি আত্মসম্মানের সঙ্গে তাঁর দলকে পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর একমাত্র বই ‘টাইগার’স টেল’ ১৯৬৯ সালে প্রকাশের পর আজ বিলুপ্ত। আমরা দেশবাসী, পটৌডিকে কি সে ভাবে মনে রেখেছি?

অন্য বিষয়গুলি:

Mansoor Ali Khan Pataudi Cricket India Joy Goswami
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy