ভারতীয় দলকে ভরসা দিচ্ছেন পন্থ। ছবি: টুইটার।
বীরেন্দ্র সহবাগ বাঁহাতে ব্যাট করলে কেমন হত? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত পেয়ে গিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। উত্তর, ঋষভ পন্থ।
২৪ বছরের উইকেটরক্ষক-ব্যাটার নিজের আদর্শের মতোই ডাকাবুকো। ব্যাট হাতে আগ্রাসী। ইনিংসের প্রথম বল বা ব্যক্তিগত ৯৫ রানে দাঁড়িয়েও সহবাগের মতোই বেপরোয়া। সব ধরনের ক্রিকেটেই প্রায় একই গতিতে রান তোলেন। তাঁর আগ্রাসন দলকে চাপমুক্ত করতে পারে। সহবাগের মতোই বেশি ভাবেন না ব্যর্থতা নিয়ে। মিল রয়েছে চেহারাতেও। এখনকার ক্রিকেটারদের মতো টান টান নয়। বরং কিছুটা আলুথালু গোছের। চেহারা দেখে পন্থের ফিটনেস নিয়ে সংশয় হতে পারে। কিন্তু সেই সংশয় উড়ে যায় তাঁর ব্যাটের তাণ্ডবে।
২০১৭ সালে পন্থ ভারতীয় দলে এসেছিলেন উইকেটরক্ষক হিসাবে। উইকেটের পিছনে সে সময় নিখুঁত ছিলেন না। ক্যাচ ফেলেছেন। বল গলিয়েছেন। সমালোচনা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে তাঁর ব্যাটের ধার। সে সময় ভারতীয় দলের সাজঘরে থাকতেন ঋদ্ধিমান সাহা। দেশের তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও বাংলার ঋদ্ধি তখন অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক। ঋদ্ধির থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। শিখেছেন। এগিয়েছেন। পন্থ হয়তো এখনও দুর্দান্ত উইকেটরক্ষক নন। কিন্তু শুরুর সময়ের থেকে অনেক ভাল। তাঁর বড় গুণ, ব্যাটিং অর্ডারের যে কোনও জায়গায় ব্যাট করতে পারেন। দল হঠাৎ ওপেন করতে পাঠালেও ভয় পান না। বরং আশঙ্কায় থাকেন প্রতিপক্ষ বোলাররা। পাওয়ার প্লে-র সুবিধা কাজে লাগিয়ে কী না কী করে বসেন!
পন্থের ছেলেবেলা তাঁর ব্যাটিংয়ের মতো ঝকঝকে ছিল না। উত্তরাখণ্ডের রুরকিতে জন্ম পন্থের। সেখানেই স্থানীয় কোচিং ক্যাম্পে ক্রিকেট শেখা শুরু। তখনই বোঝা গিয়েছিল প্রতিভা রয়েছে। বয়স যখন ১২ বছর, তখন আরও ভাল প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লির সনেট ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি করা হয় তাঁকে। প্রতি সপ্তাহান্তে মা সরোজ পন্থের সঙ্গে ট্রেনে দিল্লি আসতেন পন্থ। থাকতেন মোতি বাগ এলাকার একটি গুরুদ্বারে। দিল্লিতে কোথাও ঘরভাড়া নিয়ে স্ত্রী, সন্তানকে রাখার সামর্থ্য ছিল না বাবা রাজেন্দ্র পন্থের। শনি-রবিবার ক্রিকেট শিখতেন তারক সিংহের কাছে। তারকও বুঝেছিলেন, পন্থ লম্বা রেসের ঘোড়া।
দিল্লির বয়সভিত্তিক দলগুলোয় তখন বেশ ভিড়। স্থানীয় মুখের ভিড়ে পন্থের সুযোগ পাওয়া কঠিন, বুঝেছিলেন তারক। ভিন্ রাজ্যের ছাত্রের প্রতিভা কি তবে জলে যাবে। পন্থকে রাজস্থানের হয়ে অনূর্ধ্ব ১৩ এবং ১৫ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলার পরামর্শ দেন তারক। সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত দিল্লির অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পান। তার পর একে একে অনূর্ধ্ব ১৯ ভারতীয় দল, ভারতীয় দল, আইপিএল। আর তাঁকে রোখা যায়নি। দেশকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে নেতৃত্বও দিয়ে ফেলেছেন ২৪ বছরের তরুণ।
উইকেটের সামনে বা পিছনে টেকনিকে ফাঁক ছিল অনেক। কিন্তু সঙ্গে ছিল বুকভরা সাহস। এখনও সেই সাহসই পন্থের অন্যতম সম্বল। সিরিজ হেরেও তাঁর এই সাহসকে কুর্নিশ করেন জস বাটলার। ইংরেজ অধিনায়ক তো মেনেই নিয়েছেন, ভারতের বিরুদ্ধে এক দিনের সিরিজ হারতে হয়েছে পন্থের ব্যাটিংয়ের কাছেই। তাঁর মতো বাঁহাতি উইকেটরক্ষক-ব্যাটার আগে ভারতীয় দলে আসেনি। অনেকে তাঁকে ‘ভারতের অ্যাডাম গিলক্রিস্ট’ বলেন। সেই তুলনায় পন্থের আগ্রহ নেই। অনেক বেশি খুশি হন তাঁর ব্যাটিংকে কেউ সহবাগের মতো বললে।
সহবাগের মতো পন্থও টেকনিক নিয়ে বিশেষ খুঁতখুঁতে নন। কিন্তু বিপক্ষের বোলারকে মাথায় চড়তে দেওয়া পছন্দ করেন না। মেজাজে থাকলে সব বলকেই মাঠের বাইরে পাঠাতে চান। উইকেটের পিছনে চার রান বাড়তি দিয়ে ফেললে সামনে দাঁড়িয়ে বিশ রান তুলে দিতে পারেন। এই মুহূর্তে ভারতীয় দলে উইকেটরক্ষক-ব্যাটার হিসাবে পন্থকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবার সুযোগ নেই। কারণ তাঁর ধারে কাছে কেউ নেই। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জুতোয় পা গলিয়ে এগিয়ে চলেছেন। দীনেশ কার্তিক, সঞ্জু স্যামসন, ঈশান কিশন, রুতুরাজ গায়কোয়াড়, শ্রীকর ভরতরা ভারতীয় দলের কাছাকাছি থাকলেও, তাঁরা কেউ পন্থ নন। পন্থের মতো ডাকাবুকো, আগ্রাসী নন। উইকেটরক্ষক হিসাবে এগিয়ে থেকেও পন্থের সাহসের কাছে পিছিয়ে পড়েছেন ঋদ্ধিও।
বড় কোনও অঘটন না ঘটলে ভারতীয় দলের উইকেটরক্ষকের দস্তানা আপাতত পন্থের কাছেই থাকবে। প্রতিপক্ষ শিবিরে পাল্টা আক্রমণ পৌঁছে দেওয়ার জন্য দল তাঁর দিকে অনেকটাই তাকিয়ে থাকবে। কারণ সেই ভরসা দিতে পেরেছেন পন্থ। ভরসা দিচ্ছে তাঁর সাহস। যে সাহসে ভর করেই হয়তো উড়ান দেবে আগামীর ভারতীয় ক্রিকেট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy